স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যালও মানতে অনীহা, এখনো ভরসা হাতের ইশারা
স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা সক্রিয় রয়েছে। তারপরও যানবাহন নিয়ন্ত্রণে সড়কে আছেন ট্রাফিক সদস্য। সম্প্রতি রাজধানীর বাংলামোটরে/ছবি: জাগো নিউজ
- ২২ মোড়ে বসেছে নতুন ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি
- স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি কার্যকর আটটি স্থানে
- সিগন্যাল ছাড়ার সময় নির্ধারণে এআই ব্যবহার
- মানছেন না অধিকাংশ গাড়ির চালক
- সড়কে থাকতে হচ্ছে ট্রাফিক সদস্যদের
- নতুন পদ্ধতি নিয়ে প্রচার ও জরিমানায় জোর
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড় বা ইন্টারসেকশনে চালু করা হয়েছে নতুন স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা। সবুজ, হলুদ ও লাল বাতি জ্বালানোর সময় নির্ধারণে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এ উদ্যোগ থেকে বাস্তবে তেমন সুফল মিলছে না। অধিকাংশ চালক সংকেত মানছেন না। লাল বাতি উপেক্ষা করেই যানবাহন চলছে। তাই সড়কে বিশৃঙ্খলা এড়াতে এখনো ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের হাতের ইশারার ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে।
মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করা ট্রাফিক সদস্যদের ভাষ্য, নিয়ম অমান্য করে দ্রুত সিগন্যাল পেরিয়ে যাওয়াই যেন গাড়িচালকদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা জানান, রাজধানীর প্রধান প্রধান মোড়ে একযোগে এ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু না থাকায় অধিকাংশ চালকের এ সম্পর্কে ধারণা নেই। তাই ভুল করেও সংকেত অমান্য করছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। একই সঙ্গে তাদের পরামর্শ, যারা নিয়ম মানবে না তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
কেউ নিয়ম মানেন না। সিগন্যাল বন্ধ থাকলেও সুযোগ পেলেই গাড়ি টান দেন। বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও অটোরিকশার চালকরা বেশি ঝামেলা করেন। ট্রাফিক সদস্যরা সিগন্যাল বন্ধ করে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলেও তারা গাড়ি চালিয়ে দেন।- বাংলামোটরে দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্য
সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ২২টি মোড়ে নতুন করে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি বসানো হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৪টি এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আটটি মোড়। এর মধ্যে আটটি স্থানে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি কার্যকর করা হয়েছে।
মোড়ে স্থাপন করা হয়েছে উন্নত বিশ্বের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ট্রাফিক সিগন্যাল/ছবি: জাগো নিউজ
সরেজমিনে বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার ও বাংলামোটর মোড়ে দেখা গেছে, সিগন্যালের স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি সক্রিয় থাকলেও যানবাহন নিয়ন্ত্রণে একাধিক ট্রাফিক সদস্য সেখানে ব্যস্ত সময় পার করছেন। মোড়গুলোতে উন্নত বিশ্বের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে নির্দিষ্ট সময় পরপর লাল, হলুদ ও সবুজ বাতি জ্বললেও তারা চালকদের সেই পুরোনো পদ্ধতি, অর্থাৎ হাতের ইশারায় নিয়ম মানাতে বাধ্য করছেন। সেই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি ও মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্যদের সঙ্গে বেতারযন্ত্রে যোগাযোগের মাধ্যমে সড়কবাতি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এরপরও সুযোগ পেলেই বন্ধ সিগন্যালেও গাড়ি চালিয়ে দিচ্ছেন চালকরা। এছাড়া, সিগন্যালে পথচারীদের পারাপারের জন্য জেব্রাক্রসিং থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলোর ওপরই যানবাহন থেমে থাকতে দেখা গেছে।
আরও পড়ুন
১৭ বছর পর খুললো মিরপুরের ৬০ ফিট সংযোগ সড়ক
নতুন ট্রাফিক সিগন্যালে ধীরে ধীরে মানুষকে অভ্যস্ত করতে হবে
চট্টগ্রাম: ভারী যান চলাচলে বেহাল মাঝিরঘাট সড়ক, ধুলা-কাদায় অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা
সিগন্যালে ভিন্নতা
বিভিন্ন মোড়ে একেক দিকের সড়কে সিগন্যাল বন্ধ ও চালুর ভিন্ন ভিন্ন সময় দেখা গেছে। মগবাজার থেকে বাংলামোটরমুখী সড়ক ৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ড, বাংলামোটর থেকে শাহবাগগামী সড়ক ২ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড, শাহবাগ থেকে কারওয়ান বাজারের দিকের সড়ক ২ মিনিট ৫২ সেকেন্ড এবং শাহবাগ ও হাতিরপুল থেকে মগবাজারগামী সড়ক ৪ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড বন্ধ রাখার পর সবুজ বাতি জ্বালাতে দেখা গেছে।
কারওয়ান বাজার মোড়ে দেখা যায়, বাংলামোটর থেকে ফার্মগেট যেতে ১ মিনিট ৪০ সেকেন্ড, বাংলামোটর যেতে দেড় মিনিট, হাতিরঝিলের দিকে যেতে ৩ মিনিট ২৫ সেকেন্ড ও হাতিরঝিল থেকে ফিরতে ৩ মিনিট ১৪ সেকেন্ড সিগন্যালে থাকতে হচ্ছে। এছাড়া, ফার্মগেট সিগন্যালে ফার্মগেট থেকে জাহাঙ্গীর গেটের দিকের সড়কে ১ মিনিট ১ সেকেন্ড, খামারবাড়ি ও সংসদ ভবন থেকে কারওয়ান বাজারের পথে ১ মিনিট এবং জাহাঙ্গীর গেট থেকে কারওয়ান বাজার যেতে দীর্ঘ সময় পরপর লালবাতি জ্বলতে দেখা গেছে।
ট্রাফিক ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশন নিয়ে আসতে হলে যারা নিয়ম মানবে না তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ভিডিও নজরদারির মাধ্যমে হোক আর যেভাবেই হোক, জরিমানা তাদের দিতেই হবে। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া যাবে না।- বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ
বিজয় সরণি মোড় পার হওয়ার জন্য গাড়িগুলোকে ফার্মগেট থেকে জাহাঙ্গীর গেটের পথে সিগন্যালে ২ মিনিট ১৩ সেকেন্ড, জাহাঙ্গীর গেট থেকে ফার্মগেটের সড়কে ৩ মিনিট ১৯ সেকেন্ড, জাহাঙ্গীর গেট থেকে সংসদ ভবনের দিকে ৪ মিনিট ২৫ সেকেন্ড এবং সংসদ ভবন ও জিয়া উদ্যান থেকে ফার্মগেট ও সাতরাস্তাগামী সড়কে ৩ মিনিট ২৩ সেকেন্ড লালবাতিতে আটকে থাকতে হচ্ছিল।
সিগন্যাল মানতে অনীহা
নতুন ব্যবস্থা নিয়ে কথা হয় বাংলামোটর মোড়ে দায়িত্বরত এক ট্রাফিক সদস্যের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজের কাছে নানান সমস্যার কথা তুলে ধরেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, সিগন্যাল বাতি বসানো হলেও এতে সমস্যা সমাধানের কোনো কার্যকর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কেউ নিয়ম মানেন না। সিগন্যাল বন্ধ থাকলেও সুযোগ পেলেই গাড়ি টান দেন। বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও অটোরিকশার চালকরা বেশি ঝামেলা করেন। ট্রাফিক সদস্যরা সিগন্যাল বন্ধ করে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলেও তারা গাড়ি চালিয়ে দেন।
এই ট্রাফিক সদস্য বলেন, ‘যেখানে সিগন্যালের মাধ্যমে সব নিয়ম মেনে যানবাহন চলার কথা, সেখানে আমরা উপস্থিত থেকেও নিয়ম মানাতে পারছি না।’
কারওয়ান বাজার মোড়ে দায়িত্বরত আরেক ট্রাফিক সদস্য বলেন, অধিকাংশ সময় সিগন্যাল ছাড়ার আগেই গাড়ি ছেড়ে দেয়। দেখা যায়, ট্রাফিক সদস্য একদিকে দায়িত্ব পালন করছেন আর অন্যদিকে লাল বাতি জ্বালানো আছে। কিন্তু গাড়িচালক আশপাশে ট্রাফিকের কাউকে না দেখলেই সুযোগ নিয়ে সংকেত অমান্য করেন।
সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি ও সড়কবাতি নিয়ন্ত্রণের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ/ছবি: জাগো নিউজ
এদিকে একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ ঘুরে দেখা গেছে, সেখান থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে সড়কে নজরদারি করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক ট্রাফিক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন দায়িত্বরত কর্মী। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আনিছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে কোনো ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অভ্যস্ত হতে মানুষের একটু সময় লাগে। নতুন এ পদ্ধতি এতদিন তো ছিল না। আবার সারা ঢাকা শহরেও নেই। হঠাৎ করে এ স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালে গিয়ে অনেকে মনে করেন, এখানে হয়তো নাই। এটি যদি পুরো ঢাকা শহরে একসঙ্গে করতে পারতাম তাহলে সবাই বুঝতো যে সিগন্যাল মেনে চলতে হবে। পুরো শহরে যেহেতু একসঙ্গে হয়নি, সুতরাং এটি মানাতে একটু সময় লাগবে।’
আনিছুর রহমান জানান, স্বয়ংক্রিয় এ পদ্ধতি বর্তমানে চালু আছে আটটি সিগন্যালে। মোট ২২টি মোড়ে তা চালু করা হবে।
আরও পড়ুন
ট্রাফিক পুলিশদের ‘নীরব ঘাতক’ ঢাকার বায়ুদূষণ
নতুন ট্রাফিক সিগন্যালেও ত্রুটি, ভরসা সেই ‘হাতের ইশারা’
দখল-দূষণের কবলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক
এআই ব্যবহার
সিগন্যালে লাল-সবুজ বাতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এ সময় ব্যবস্থাপনা হচ্ছে আমাদের মাধ্যমে। একটি এআইয়ের মাধ্যমে প্রোগ্রাম করা আছে। এতে আমরা জানি যে গাড়ির পরিমাণ কত এবং কোন জায়গায় কতক্ষণ লাগবে। সে অনুযায়ী ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের আলাদা ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ আছে। সেখান থেকে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়।’
বর্তমান ব্যবস্থায় এআই দিয়ে হিসাব ও নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় জানিয়ে আনিছুর রহমান বলেন, ভবিষ্যতে তাদের সম্পূর্ণ ট্রাফিক সিগন্যাল এআইয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা আছে। সেই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, এখন যানবাহন নিয়ম ভঙ্গ করলে তারা সিগন্যালে স্থাপিত সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমেই সেগুলো শনাক্ত করে মামলার আওতায় নিয়ে আসছেন।
জরিমানা ও প্রচার
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ কাজী সাইফুন নেওয়াজের মতে, ট্রাফিক ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশন নিয়ে আসতে হলে যারা নিয়ম মানবে না তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ভিডিও নজরদারির মাধ্যমে হোক আর যেভাবেই হোক। জরিমানা তাদের দিতেই হবে। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া যাবে না। তাহলে মানুষের ভেতরে একটি বার্তা যাবে যে, তিনি যদি সিগন্যাল অমান্য করেন তাহলে তাকে জরিমানা গুনতে হবে। তারপরও যদি নিয়মের মধ্যে না আসে তখন দেখতে হবে মানুষ কেন মানছে না? প্রযুক্তিতে কোনো ভুল আছে কি না, পরিচালনায় কোনো সমস্যা আছে কি না। এসব চিহ্নিত করতে হবে।
সড়কের মাঝখানে এসে গাড়ি থামাতে হচ্ছে ট্রাফিক সদস্যকে/ছবি: জাগো নিউজ
সেই সঙ্গে এ নিয়ে প্রচার চালানোর ওপর জোর দেন সাইফুন নেওয়াজ। তিনি বলেন, ‘সিগন্যালগুলো যে কার্যকর এ বার্তা মানুষের মধ্যে জানাতে হবে। যেহেতু এ পদ্ধতির সঙ্গে মানুষ অভ্যস্ত নয়, সেহেতু আমাদের কোন কোন জায়গায় সিগন্যালগুলো কার্যকর সেটি মানুষকে জানাতে হবে, প্রচার করতে হবে। যাতে প্রত্যেক মানুষের কানে পৌঁছায় যে ঢাকার কোন কোন সিগন্যাল ডিজিটালাইজেশন হয়েছে এবং সেখানে নিয়ম না মানলে শাস্তির আওতায় আনা হবে। এটি প্রচুর পরিমাণে প্রচার করতে হবে। কারণ তা অনেকেই জানেন না। সবাইকে জানাতে হবে। এক মাস পর কঠিন জরিমানার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। যদি ১০০ শতাংশ জরিমানার আওতায় আনা যায় আর এ বার্তাটি সবার কানে পৌঁছানো যায়, তাহলে ভবিষ্যতে অনেক জায়গায় এ ডিজিটাল ট্রাফিক ব্যবস্থা কার্যকর করা সম্ভব হবে।’
কেআর/একিউএফ/এমএমএআর/এমএফএ/এএসএম