ধর্ম সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়

ধর্ম মানুষের নৈতিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে আর মন্দকর্ম থেকে বিরত রাখে। যারা সৎকর্মশীল তাদের জন্য ধর্ম সব সময়ই হেদায়াতের কারণ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, ‘সৎকর্মশীলদের জন্য হেদায়াত এবং রহমত স্বরূপ, যারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং পরকালে দৃঢ়বিশ্বাস রাখে, এরাই তাদের প্রভু-প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হেদায়াতে প্রতিষ্ঠিত আর এরাই সফল হবে।’ (সুরা লুকমান, আয়াত: ৩-৫)।
যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ উন্নত ও যুগোপযোগী জীবন বিধান নিয়ে এসেছেন। কেননা আল্লাহ কারো ওপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করেন না। মানব শিশু মানবীয় সমস্ত বৈশিষ্ট্য ধারণ করলেও একমাত্র পরিণত বয়সেই সে এর সমস্ত কিছুর উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। তাই বলে এর আগে তাকে দেয়া শিক্ষা তো মূল্যহীন নয়। যেমন আমরা সবাই জানি, পশু জন্ম নিলেই পশু কিন্তু মানুষ জন্ম নিলেই মানুষ নয়, তাকে পুনরায় মানুষ হিসাবে জন্ম নিতে হয়।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
মানুষ যখন মন, মেধা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিপূর্ণতা লাভ করলো, তখনই পরিপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ আল কুরআন নাজিল হলো। বিশ্ব যখন মানুষের হাতের মুঠোয়, তখনই বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন ঘটে। তার (সা.) পূর্বের কোনো নবি বিশ্বনবি হওয়ার দাবি করেননি। আবার কোনো অন্ধবিশ্বাস বা সাম্প্রদায়িকতার নাম ধর্ম নয়।
ধর্ম হলো স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে সেতু-বন্ধন সৃষ্টিকারী পথ-নির্দেশনা। ধর্ম মানুষের জন্য বয়ে আনে কল্যাণ। ধর্ম মানুষকে এই শিক্ষা দেয় যে, তার জীবনের উদ্দেশ্য কী, কী তার করণীয় এবং কীভাবে জীবনকে সৌন্দর্য মণ্ডিত করতে পারে।
ধর্ম মানুষকে উত্তম আচার-ব্যবহারের শিক্ষা দেয়। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘উত্তম নৈতিক চরিত্র ও আচার-ব্যবহারের ন্যায় নেকির পাল্লা ভারী করতে আর দ্বিতীয় কোনো আমল নেই। আর আল্লাহ অশ্রাব্য গালমন্দ ও কটুকথা বলে এমন ব্যক্তিকে খুবই ঘৃণা করেন।’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ)
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
হজরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, মহানবি (সা) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ হলেন নম্র ও দয়ার্দ্র, তিনি প্রতিটি কাজে নম্রতা ও দয়ার্দ্রতা প্রদর্শন পছন্দ করেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ)। আরেকটি হাদিসে এসেছে হজরত আবু হুরাইরাহ (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুমিন ব্যক্তি সরল ও ভদ্র প্রকৃতির হয়ে থাকে, কিন্তু পাপী ব্যক্তি ধোঁকাবাজ ও নির্লজ্জ হয়।’ (সুনানে আবু দাউদ)
যুগে যুগে মানুষ যখন অজ্ঞতাকে আলিঙ্গন করে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তখনই ধর্ম প্রবর্তক ও সংস্কারকেরা স্রষ্টার পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা ও মুক্তির শাশ্বত উপায় নিয়ে এই ধরাধামে আগমন করে মানব জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। অনেকের ধারণা, ধর্মের জন্যই পৃথিবীতে রক্তপাত বেশি হচ্ছে অথচ কোনো ধর্মই রক্তপাতের কথা বলেনি বা কোনো ধর্মই চায় না সমাজে অশান্তি বিরাজ করুক। বরং ধর্ম একটা ফলবতী গাছ ধ্বংস করতেও বারণ করে। ধর্ম মানুষকে স্বীয় প্রবৃত্তি দমন করার মাধ্যমে সহিষ্ণুতার শিক্ষা দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সমাজে বিশৃঙ্খলা করার কোনো শিক্ষা ইসলামে পাওয়া যায় না। যারা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে তারা শুধু শান্তিকামী মানুষেরই শত্রু নয় বরং তারা মহান আল্লাহতায়ালারও শত্রু। ইসলাম আমাদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন পরিহার করে বিনয়ী এবং নম্র হয়ে চলার শিক্ষা দেয়। কাউকে হত্যার ব্যাপারে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফয়সালা করা হবে, তা হবে রক্তপাত অর্থাৎ হত্যা সম্পর্কিত।’ (বুখারি)
ধর্ম মানুষকে মানুষের জন্য শান্তি কামনা করার শিক্ষা দিয়েছে আর ইসলামে পারস্পরিক সালাম বিনিময়ের প্রথা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এখনো প্রায় সব ধর্মেই বিভিন্ন ভাবে এই প্রথা প্রচলিত আছে। ধর্ম অস্ত্র-ধারণ করতে বলেছে শুধু মাত্র আত্মরক্ষার জন্য। আর আত্মরক্ষা করার অধিকার সবারই আছে। তাহলে ধর্মের দোষ হবে কেন? সর্বদা পরিবর্তনশীল এই ধরাধামে মানুষ যখন স্বীয় সংকীর্ণ স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে, ধর্ম তখন শিকার হয় অপব্যাখ্যার, ব্যবহৃত হয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে। তখন ধর্ম হয় করো জন্য লাভজনক এবং কারো জন্য স্বপ্ন। ধর্ম যখন ‘লাভজনক’ হয় তখন আমরা সৃষ্টির কল্যাণে কাজ না করে শুধু মোনাজাতে স্রষ্টার সান্নিধ্য কামনা করি; জ্ঞানচর্চা ছেড়ে আমিত্ব ও স্বার্থের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে অন্যায় ও পাপাচারে লিপ্ত হই তখন ধর্ম হয়ে ওঠে কারো নিকট বাহ্যিক আড়ম্বরতা এবং কারো নিকট উপার্জনের উৎস।
ধর্ম মানুষকে এই পার্থিব জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে অনন্ত জীবনের পথে নিয়ে চলে। দর্শন অথবা বিজ্ঞান এখনো বলতে পারেনা, জীবনাবসানের পর মানুষের আত্মার প্রকৃত অবস্থা কি হবে? ধর্ম মানুষকে চিরস্থায়ী ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী স্রষ্টার সাথে সংযোগ সৃষ্টি করার মাধ্যমে মানব জীবনকে অর্থবহ ও উচ্চ মর্যাদা দান করে। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হওয়ার রহস্য নিহিত।
বিজ্ঞাপন
তাই যুগে যুগে ধর্ম মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছে। নয়তো একটা প্রাণীর জীবন থেকে মানুষের জীবনের ভিন্নতা কি শুধুই মেধায়? জীবন্ত ধর্মে আল্লাহর অসন্তুষ্টির নাম জাহান্নাম এবং সন্তুষ্টির নাম জান্নাত। ‘বিবেক’ নামক বিচারক তো নিজের হৃদয়ে বসা। সে যে রায় দিবে, নিজেকে সে সেখানে পাবে। আর এই বিচারক প্রতিটি কাজের, প্রতিটি কথার এমন কি প্রতিটি দৃষ্টির তাৎক্ষণিক একটি রায় দিয়ে থাকে। তাই আমরা বলতে পারি, ধর্ম মানুষের জন্য কল্যাণজনক। একজন মানুষ সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন সে যদি তার ধর্মের পরিপূর্ণ অনুসরণ করে চলে তাহলে পরিবার, সমাজ ও দেশে কোনো ভাবেই বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে না।
আজকে সর্বত্র যে অশান্তি এর মূল কারণ হলো মানুষ তার ধর্মের আদেশ নিষেধ মেনে চলছে না। বিশ্বের সব ধর্ম সংঘাত নয়, সহনশীলতায় বিশ্বাসী। কোনো ধর্মই অন্যায় অত্যাচারকে প্রশ্রয় দেয় না। তাই বর্তমান সংঘাতময় বিশ্বব্যবস্থায় শান্তি-সংহতি ফিরে আনতে ধর্মীয় সহনশীলতার অতীব প্রয়োজন।
আমাদের সকলের উচিত হবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সাথে উত্তম আচরণ করা আর ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা। আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা অনুসরণ করে চলার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
masumon83@yahoo.com
বিজ্ঞাপন
এইচআর/এমএস
বিজ্ঞাপন