ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ হোক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ০২ নভেম্বর ২০১৯

সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের দেশে ফেরার প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করছিলাম। সম্প্রতি উদ্বেগের সাথে লক্ষ্যণীয় যে, দেশে নারী শ্রমিকদের মৃতদেহ আসার সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। যারা বেঁচে ফিরেছেন সেই নারী শ্রমিকরা ধর্ষণসহ নানাভাবে নির্যাতিত হওয়ার যেসব অভিযোগ করেছেন তাতে মনে হবে, আমরা যাদের গৃহকর্মী হিসেবে পাঠাচ্ছি বর্বর সৌদিরা তাদের কেবলই যৌনকর্মী হিসেবে বিবেচনা করছে।

মরুর বুকে বাংলার নারীর কান্না কেউ শুনছে না, না দূতাবাস, না প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, না মানব রপ্তানিতে জড়িত বায়রা। নারীরা দেশে এসে যা বলছে, সেই কান্না গণমাধ্যমে উচ্চারিত হলেও তা নিয়ে সামাজিক কোন আলোড়ন নেই। সরকার নিরব, নাগরিক সমাজ নিরব, সমাজ-সচেতনতার দাবিদার রাজনৈতিক দলগুলোও কিছু বলছে না। সত্যি কথা হলো, মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সৌদি আরবে অদক্ষ নারী কর্মী পাঠিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বহু প্রচারিত গর্ব ও আত্মতৃপ্তির নেপথ্যে রয়েছে বহুসংখ্যক নারীর জীবন যন্ত্রণার মর্মান্তিক ইতিবৃত্ত।

বিদেশ যাওয়া মানেই স্বপ্নপূরণ নয়। প্রান্তিক মানুষ রুজির টানে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। উন্নত জীবনযাপনের আশায় ভিটেমাটি বিক্রি করে কিংবা উচ্চ হারে সুদে টাকা ধার নিয়ে বিদেশে যাওয়া এই নারীরা একেবারেই ভালো নেই। নির্যাতন সইতে পারছেন না, কেউ কেউ অত্যাচারিত হয়ে মারা যাচ্ছেন, আর কেউ কেউ হতাশ ও মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে ফিরছেন। যারা বিদেশে কাজের আশায় যাচ্ছেন সেই শ্রমিকদের কত ভাগের ভাগ্যের উন্নতি হচ্ছে? এমন প্রশ্নের কোন উত্তর নেই কারও কাছে। কিন্তু আমরা জানি নব্বই ভাগই অতি কষ্টে দিন গুজরান করছে।

আমরা লক্ষ্য করছি, সামাজিক মাধ্যমে মানুষ এ নিয়ে কথা বলছে, সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধের দাবি করছে। কিন্তু সরকার কিছু বলছে না। আমরা সব জেনে শুনেও আমাদের নারীদের কেন হিংস্র জানোয়ারের কাছে সোপর্দ করছি ইতিহাস নিশ্চয়ই এ জাতির কাছে এর জবাব চাইবে। যারা ফিরছেন, তাদের প্রায় সকলের গল্পটাই এক। দালালদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন, এক ধরনের কাজের আশা দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্য কাজে বাধ্য হয়েছেন বা কর্মক্ষেত্রে নির্যাতন, প্রতারণার শিকার হয়েছেন। সৌদি বাসাবাড়িতে কাজের শুরুতেই যৌন প্রস্তাব দেয়া হয়। সম্মত না হলে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। যৌন প্রস্তাবে রাজি না হলে খাওয়া বন্ধ, একপর্যায়ে মেরে হাত পা ভেঙে দেয়া হয় এবং বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়। এরপর পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে যায়। পরবর্তীতে চিকিৎসা দেয়ার পর সেখানকার এজেন্টের মাধ্যমে তাকে আবারো ওই বাড়িতেই ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। একজন নয়, একাধিক পুরুষ পালাক্রমে এই গৃহকর্মীদের বিকৃত কায়দায় যৌন নির্যাতন করে।

এসব কাহিনি সবার জানা। যারা ফিরেছেন তারা সবাই ট্রমায় বসবাস করছেন। কেউ কেউ পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের পরিবারগুলো সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে আর্থিক ও সমাজিক ভাবে। অভিবাসী নারীকর্মীরা প্রতিনিয়ত হয়রানি, প্রতারণা, শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও বিভিন্ন যৌন নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতনের শিকার নারী অভিবাসী কর্মীরা দেশে ফিরে এলে তাদের পরিবারও এদের গ্রহণ করতে চায় না বলে অনেকে জানিয়েছেন।

কতটা পরাধীন এ দেশের মেয়েরা, বুঝতে পারি এসব ঘটনায়। হয়তো তাদের মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করা হয় না। যদি হতো তাহলে বারবার তাদের এভাবে পাঠানো হতো না সৌদি আরবে। তারা ফিরে এসে নিজেদের কথা বলছে, কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ নিশ্চুপ। তবে কি আমরা ধরেই নিয়েছি যে, সৌদি আরবে আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার ধরে রাখতে নারীর যৌনতাই একমাত্র বিক্রয়যোগ্য উপাদান? নাকি এরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বলে, আতি দরিদ্র ও ক্ষমতাহীন মানুষ বলে আমরা নিরবে সব মেনে নিচ্ছি?

বিদেশে জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উপর বড় ভাবে নির্ভর করছে অর্থনীতি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিদেশে জনশক্তি রফতানি আমাদের অর্থনীতিতে বড় আবদান রাখে বলেই কি আমরা আমাদের নারীদের এভাবে হায়েনার সামনে পাঠিয়ে চুপচাপ থাকব? জাতির কাছে প্রশ্ন - নির্যাতনের শিকার নারী শ্রমিকদের আইনগত অধিকার কী এবং কোন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তারা নিজেকে সামাল দেবে, নিজের অধিকার রক্ষা করবে, ন্যায়বিচার পাবে?

সামগ্রিকভাবে অভিবাসনের ক্ষেত্রে যে দালালচক্র সক্রিয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলে অভিবাসীদের ঝুঁকি কমে আসবে। বিদেশ গিয়ে কাজ করতে যিনি সক্ষম, দক্ষ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম তাকেই পাঠানো উচিত। অভিবাসন প্রক্রিয়াকে গুণগত দিক থেকে উন্নত করতে শুধু সরকার নয়, বেসরকারি পর্যায়েও সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে।

আমাদের শ্রমিকরা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। কিন্তু এই দেশগুলোর যে সামাজিক সংস্কৃতি, সেখানে রয়েছে বিষাক্ত নিঃশ্বাসের বাস। অনেকে বলছেন, যেসব নারী কর্মী হিসেবে যাবেন তাদের যাওয়ার পূর্বে কর্মস্থলের বিষয়ে সঠিক ধারণা দিতে হবে। নিজেদের মনোসামাজিক দিকে প্রস্তুতি রাখতে হবে। অন্যদিকে নারী কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও সেটি মনিটর করার দিকে জোর দিতে হবে। লেবার উইং এ নারী কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে যাতে নারীকর্মীরা তাদের বিষয়ে খোলামেলাভাবে আলোচনা করতে পারে। এগুলো সবই ভাল প্রস্তাব। কিন্তু বাস্তবতা এখন ভিন্ন। আমরা জানি নারীর প্রতি, বিশেষ করে দরিদ্র দেশ থেকে কাজ করতে যাওয়া নারীর প্রতি, সৌদিদের দৃষ্টিভঙ্গি কখনও বদলাবে না। তাই আর কোন সংশয়ের অবকাশ নেই, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক রফতানি বন্ধ করাই এখন উত্তম ব্যবস্থা।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস