শিক্ষা
সংস্কৃতি আমাদের ফেরাতে পারে

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন সাংস্কৃতিক চর্চা আমাদের ফেরাতে পারে জঙ্গিবাদ থেকে। রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, তার এই জঙ্গিবাদবিরোধী বক্তব্য দুটো দিকের উন্মোচন করছে। এক. দেশের ভেতরে জঙ্গিবাদ আছে এবং তা বেশ জোরেশোরেই আছে। দুই. ওই জঙ্গিবাদের অন্ধ আক্রোশ থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে পারে সংস্কৃতি, সাংকৃতিক চর্চা।
‘দেশে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে সাংস্কৃতিক চর্চা’ রাষ্ট্রপতির এই কথা আমাদের এটাই মনে করিয়ে দেয় যে আমরা কোন সমাজে বাস করছি। কেননা আমাদের সমাজে জঙ্গিবাদ লালনের সুযোগ ও সুবিধা অবারিত রয়েছে। এই আধুনিক যান্ত্রিক প্রাগ্রসর জীবনে যদি অন্ধ জঙ্গিবাদের চর্চা চলতে থাকে, তাহলে আমরা কীভাবে সেই অন্ধত্ব ঘুচাবো? সেই অন্ধত্ব ঘুচাতে পারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিসহ যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড— এটাই রাষ্ট্রপতির অভিমত।
বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৯ ও ২০২০ সালে ১৮ গুণীজন এবং দুই সংগঠনকে শিল্পকলা পদক প্রদান অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এসব কথা বলেন রাষ্ট্রপতি। (সমকাল২৩/০৯/২২)
সংস্কৃতি লালন-পালন হয় মানুষের প্রতিদিনের জীবনধারায়, তার ধর্মীয় রিচুআলে, তার মানবিক ও মানসিক প্র্যাকটিসের মাধ্যমে। এগুলোর শিক্ষা দেয় স্কুল-কলেজসহ বিদ্যার্জনের আয়তনগুলো।
দেশে বর্তমানে তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। এক. সরকারি স্কুলগুলোতে যে কারিকুলামে শিক্ষা দেওয়া হয়, সেটাই প্রধান। বেসরকারি স্কুলগুলোতেও তা চালু আছে। সেই সঙ্গে ইংলিশ ভার্সন চালু আছে। দুই. ইংলিশ মিডিয়াম কারিকুলাম, যা ইউরোপীয় ও আমেরিকান শিক্ষা কারিকুলাম থেকে ধার করা। একশ্রেণির মানুষ মনে করে আজকের এই প্রতিযোগিতার আন্তর্জাতিক বাজারে ইংরেজির আপাতত বিকল্প নেই।
শিক্ষার মাধ্যম ও প্রাগ্রসর চিন্তার উপাদান হিসেবে তাই ইংরেজি শিক্ষা জরুরি। তবে সেখানে বাংলাদেশের সরকারি কারিকুলামের কোনো ছায়া নেই। তিন. মাদরাসা শিক্ষা। এখানে সরকারি কারিকুলামও চালু করেছে সরকার। মাদরাসার শিক্ষার প্রধান ভাষা আরবি, যা একটি বিদেশি ভাষা। তবে সেই ভাষা শেখানোটা জরুরি বলে মনে করে না তারা। তারা কোরআন শিক্ষার ওপরই জোর দেন। কিন্তু কোরআনের মৌলিক যে জ্ঞান ও তার সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত শেখানো হয় বলে মনে হয় না। বর্তমানের আধুনিক আরবি ভাষা ও সাহিত্যের স্পর্শ সে শিক্ষায় কতোটা আছে, এনিয়ে তর্ক আছে।
তিন ধরনের শিক্ষার ভেতর দিয়ে দেশের শিশু ও যুবকরা বেড়ে উঠছে। এই তিনের সমন্বয়ে যদি একটি জাতীয় শিক্ষা করিকুলাম চালু করা যায়, তাহলে কি জঙ্গি চেতনার জন্ম নিতো? সরকার শিক্ষা কারিকুলামের একটি সংস্কার সাধনের মাধ্যমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কাজ করছেন। যতটুকু শুনেছি, তাতে মনে হয়েছে সেই ব্যবস্থায় শিশুদের মেধা বিকাশের একটি ভালো পথ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কারিকুলামে কি কি অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সে সম্পর্কে তেমন কিছুই আমরা জানি না।
আমাদের নতুন প্রজন্মের শিশুরা কি কারিকুলামের শিক্ষায় শিক্ষিত হবে সে ব্যাপারে আমরা যদি অন্ধকারে থেকে যাই, তাহলে কি বিতর্কমুক্ত হতে পারবো? আমরা মনে করি, সরকার নতুন কারিকুলামে যে সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছে, সেই বিষয়ের কনটেন্ট কি কি থাকবে তার রূপরেখা জানানো উচিত। সেটা যেমন জাতীয় সংসদের মাধ্যমে হতে পারে, তেমনি হতে পারে গণশুনানির মাধ্যমেও। তারপর সেই ফলাফল নিয়ে গোটা সংস্কার করা করিকুলাম বাস্তবায়িত হলে জাতির উপকারই হবে।
আমরা বলি জাতির শিরদারা শক্ত-পোক্ত করে গড়ে তোলে শিক্ষা। যেহেতু শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ, তাই তাদের গড়ে তুলতে যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা জরুরি। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, আমার ধারণা, সেই পরিপ্রেক্ষিতেই তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। এখন আমরা এটা বলতে চাই সাংস্কৃতিক চর্চা বলতে আমরা কি বুঝি।
আমাদের মধ্যে এই ধারণাই বহমান যে নাটক-সিনেমা-গান-বাজনাসহ যা কিছু আনন্দদানের অনুষ্ঠান তাই সাংস্কৃতিক চর্চার প্রধান অবলম্বন। আসলে শিল্প-সাহিত্যসহ মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ডই সাংস্কৃতিক চর্চার অন্তর্গত। ধর্ম ও ধর্মীয় রিচুয়াল কি সংস্কৃতির অন্তর্গত, এই প্রশ্ন অনেকের মনেই জাগে, আছে। অবশ্যই ধর্ম ও রিচুয়াল সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় প্রবাহ। তাই ধর্মকে সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক চর্চার বাইরে রেখে দেওেয়া যায় না। কিন্তু মাদরাসা শিক্ষা, এদেশে প্রমাণ করেছে, তাদের মেধাবিকাশের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বড় ভূমিকা রাখতে পারেনি। সেটা তাদের নেওয়া কারিকুলাম ও শিক্ষা দেওয়ার রীতি পদ্ধতির কারণে ঘটেছে।
আমরা দেখেছি, আমাদের সমাজে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদের বেশ বড় তৎপরতার নায়করা এসেছে মাদরাসা থেকে। কিন্তু সেটাই কি সব? হলি আর্টিসান হত্যাকাণ্ডের নায়করা তো আমাদের প্রাগ্রসর সমাজের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত পরিবার থেকেই এসেছে। তাহলে গলদটা কোথায়?
হুজি বা জেএমবি ইত্যাদি জঙ্গি গ্রুপের সদস্যরা রাজনৈতিকভাবে প্রশিক্ষিত, যারা আফগান তালেদানদের কাছে শিক্ষা নিয়েছে। কিছু নিয়েছে ইরাক ও সিরিয়ায়। যারা এদের প্রশিক্ষিত করেছে, তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কালচারের আলোকেই এদের মস্তিষ্ক নির্মাণ করেছে। এরা যে বাংলাদেশের মৌলিক সাংস্কৃতিক চেতনা থেকে বহুদূরে সরে গেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আসলে পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেওয়া ইসলামের বিপরীতে– মৌলবাদকে রাজনৈতিকভাবে নির্মাণ করে আমাদের হেয় করতে উপহার দিয়েছে। মুসলমান মানেই ফান্ডামেন্টাল বা মৌলবাদি এই তকমা দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে গোটা পশ্চিমা রাজনৈতিক আধিপত্য চাপানোর কৌশল মাত্র। এখনো পশ্চিমাদের সেই মিথ্যা চাপের অধীনেই আমরা রয়ে গেছি।
সমাজ কাঠামোর ভেতরে থাকা ভুল ধারণাগুলো পাল্টাতে হবে। নাটক-সিনেমা-সাহিত্যের পাশাপাশি নানান সামাজিক কর্মকাণ্ড চালানোর অন্য কোনো বিকল্প নেই। ১৮ জন ব্যক্তি ও দুটি প্রতিষ্ঠানকে শিল্পকলা পদক দিয়ে যে চর্চার অঙ্গন সাজানো হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা পুরো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালু করতে হবে। আমাদের স্কুল শিক্ষার কারিকুলামে সংস্কৃতি বিষয়ক পাঠ থাকতে হবে। তা না হলে শিশু-কিশোর মনে আমাদের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক পরিচর্যা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ এ কারণে যে তিনি আমাদের নতুন উদ্যমের পথটি দেখিয়ে দিয়েছেন। তবে কাজটা তৃণমূল স্তর থেকে চালু না করলে, কেবল নগর ও মহানগরভিত্তিক চর্চা গোটা সমাজে ইতিবাচক ফল দেবে না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কবি, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এমএস