ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আমার বইমেলা

আন্তর্জাতিক মেলা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে বইমেলাকে

ড. মাহবুব হাসান | প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাংলা ভাষাকে যেমন মায়ের মতো ভালোবাসি, বইমেলাকেও সেই মতো ভালোবাসতে শিখেছি। এটা অভ্যাসের ফল। কিন্তু মাতৃভাষা তো মায়ের দেওয়া, যেন তাঁর গর্ভজাত হয়েই আমরা শিখেছি, ধীরে ধীরে, প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ মাতৃস্তন্য পানের মতো শিখে নিয়েছি সেই ভাষা ও তার ইশারা-ইঙ্গিত। সেই মায়ের দেওয়া ভাষা তো আমার প্রতি মুহূর্তের আশীর্বাদ। আমার শ্বাস নেওয়ার মতো উপাদান। আমার সামাজিক রাজনৈতিক চেতনার নির্মাতা বাংলা ভাষা।

আমরা যখন ইংরেজিতে কথা বলি, তখন বাংলাভাষী বলে আমার থিংকিং প্রসেস ও থিংকিং ভাষায় সেই ইংরেজির বাক্যটিকে বাংলায় ভেবে নিয়ে তার অনুবাদ করি। আবার যখন কোনো ব্রিটিশ বা ফরাসি বা স্প্যানিশ ভাষী যখন বাংলায় কথা বলে বা বলতে চায়, তখন সে তার মাতৃভাষায় সেই বাংলা বাক্যটি সৃষ্টি করে নেয়, তারপর সে তা অনুবাদ করে বাংলায়, মনে মনে বা অন্তরে অন্তরে বহমান থিংকিং প্রসেসে।

আমার এ কথাগুলো বলার পেছনে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা আর সাংস্কৃতিক সত্তার বিবেচনাটি আমি লক্ষ্য রেখেই বলেছি। সংস্কৃতিও রাজনীতিকরণ হতে পারে, আমাদের প্রায় অলক্ষ্যেই, কিন্তু সেই প্রবাহটি থাকে খুবই অন্তর্লীনভাবে।বাংলা ভাষাও ধারণ করে বহুভাষিক চেতনার রাজনীতির উপাদান, বহুচেতনার সম্মিলন ঘটে তাই ভাষিক বয়ানে। সৃষ্টিশীল মানুষ তাই ভাসতে থাকেন দোদুল্যমান পেন্ডুলামের মতো।

আজকের বইমেলা নিয়ে বলবো আরও পরে, তার আগে বলি আমার প্রথম যৌবনের বইমেলা নিয়ে। তখন আমরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সবে ফিরেছি কলেজ-ক্যাম্পাসে। যা কিছু দেখি নতুন ঠেকে। যে শহর আমার চেতনার মতো আপন ভেবেছি, সেই শহরও অচেনা লাগে। ৯ মাসের অদেখা, আর পাওয়ারের ঝকঝকে চারদিক আমাকে আনন্দের সাগরে ভাসায়।

১৯৭২ সালে যেদিন বাংলা একাডেমিতে যাই, দেখি এক বা দুটি সাদা চাদরের ওপর বেশ কিছু বই সাজিয়ে বসেছে একজন। কাছেই একজন সুদর্শন যুবকোত্তর মানুষ (পড়ে জনেছি তিনি চিত্তরঞ্জন সাহা, পুঁথিঘর এবং সৃজনশীল প্রকাশনা মুক্তধারার মালিক তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় মুক্তধারা প্রকাশনী সৃষ্টি করেন। সেখানে থাকতেই কয়েকটি বই প্রকাশ করেন।) আমার চেতনায় ও আমার দেখা সেটা প্রথম বইমেলা।

সে বছর আর কোনো প্রকাশনীকে বাংলা একাডেমি চত্বরে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। পরের বছর আরও কয়েকটি প্রকাশনী যোগ দেয় বটে, কিন্তু যে অর্থে মেলা তা তখনও হয়ে ওঠেনি। তবে, আরও কয়েক বছর পর বাংলা বাজারের প্রকাশকরা একত্রিত হয়ে মেলা বসান একাডেমি চত্বরে। কীভাবে তারা করেন সেটা বাংলা একাডেমি ভালো বলতে পারবে। কারণ ওই প্রতিষ্ঠানের চত্বরেই মেলাটি হয়েছিল এবং প্রজ্ঞাবান ও পুরোনো প্রকাশকদেরও তা মনে থাকতে পারে। তাদের নথিপত্রেও পাওয়া যাবে সঠিক তথ্য-উপাত্ত। আমি যতদূর জানি প্রকাশকদের সমিতি আছে। তারা বেশ সংগঠিত। নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের নেতৃত্ব বদল হয়।

১৯৭৯ বা ৮০ সালে একাডেমি যুক্ত হয় তাদের সঙ্গে। প্রথমদিকে সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা আর একাডেমি যৌথভাবে আয়োজন করে এই মেলা। কালক্রমে এককভাবে বাংলা একাডেমিই এর স্বত্বাধিকার অর্জন করে।

`আদর্শ’ নামের একটি প্রকাশনা সংস্থাকে এ বছর বাংলা একাডেমি কোনো স্টল বরাদ্দ দেয়নি। কেন বাংলা একাডেমি আদর্শকে স্টল দেয়নি। কেন দেয়নি তা তাদের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে। সেটা এখানে তুলে দিচ্ছি, যাতে পাঠক বুঝতে পারেন রহস্য কোথায় লুকিয়ে আছে, তা বুঝতে পারে।

“এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি কর্তৃক উল্লেখিত অমর একুশে বইমেলা–২০২১ নীতিমালা ও নিয়মাবলির (সংশোধিত) ধারা ১৪.১৪ অনুসারে, ‘অশ্লীল, রুচিগর্হিত, জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি কটাক্ষমূলক, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় এমন বা জননিরাপত্তার জন্য বা অন্য যেকোনো কারণে বইমেলার পক্ষে ক্ষতিকর কোনো বই বা কোনো পত্রিকা বা অন্য কোনো দ্রব্য অমর একুশে বইমেলায় বিক্রি, প্রচার ও প্রদর্শন করা যাবে না।”

বাংলা একাডেমির এই নীতিমালার সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্তত চারটি ধারার মিল লক্ষ করা যায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮–এর ২৫ ধারায় ব্যক্তির ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি, ২৮ ধারায় ধর্মীয় অনুভূতি, ২৯ ধারায় মানহানি এবং ৩১ ধারায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অজুহাতে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এই ধারাগুলোর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তা বাংলা একাডেমির বইমেলা নীতিমালার ধারার ক্ষেত্রেও করা যায়।

যে বাংলা একডেমির ঘোষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ‘সমকালীন শিল্প ও সাহিত্য সংরক্ষণ এবং গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে জাতির মানসিক বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধন’ সেই বাংলা একাডেমির বইমেলার নীতিমালার ভাষা ও শর্ত যখন কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনুরূপ হয়, তখন তা আশঙ্কাই তৈরি করে। শ্লীল-অশ্লীল, রুচি-অরুচি, মানহানি, অনুভূতি—এ বিষয়গুলোর কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা বা মানদণ্ড নেই। এগুলো একেক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে একেক সময় একেক রকম হতে পারে। (প্রথম আলো/০২/০২/২৩)

এই নীতিমালা যারা চাপিয়ে দিয়েছেন বাংলা একাডেমির ওপর, সেই সরকারি নেতানেত্রীদের রাজনৈতিক বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রেই রুচিগর্হিত। তাদের শারীরিক ভঙ্গি অশ্লীল (সব সরকারি আমলেই) সেটা কি একাডেমি লক্ষ্য করেনি?

উদ্ধৃত অংশ থেকেই পাঠক বুঝতে পারবেন বাংলা একাডেমি কেন প্রকাশনা সংস্থা আদর্শকে স্টল দেয়নি। আমরা যারা লেখালেখি করি, তাদের কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছি না। সংবিধান আমাদের প্রত্যেককে মতো প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে নিরঙ্কুশভাবে। সেখানে বাংলা একাডেমি যে ‘অমর একুশে বইমেলা-২০২১ নীতিমালা ও নিয়মাবলির সংশোধিত ধারা ১৪.১৪ অনুসারে যা যা উল্লেখ করেছে, সেগুলো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা কি তলিয়ে দেখা হয়েছে?

রুচি, কুরুচি, ভিন্ন রুচি ইত্যাদি তো ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত বিষয়। সেই বিষয়ে কেউ যদি তার সাংবিধানিক অধিকার কায়েম করতে চায়, তাহলে তাকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কি সংবিধানসম্মত হয়েছে? নাকি ক্ষমতাসীন সরকারের নিজস্ব অভিরুচিতে যা নিষিদ্ধ, সেটাই বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের রুচি হিসেবে গৃহিত হয়েছে? আর কথিত ডিজিটাল আইনের কুখ্যাতি তো আছেই। সরকার বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও তার অধীন বাংলা একাডেমি নিজেদের স্বার্থ রক্ষার নামে যে সব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা লেখকের স্বাধীনতাকে খর্ব করে।

এটা আমরা কীভাবে মেনে নেবো, যখন আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে তখন কি করা উচিত বলে মনে করবেন একাডেমি কর্তৃপক্ষ? মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাসহ যারা ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তারা যদি এমন বই লিখতেন, তাদের অধিকারের বিষয়টি কেন তারা মনে রেখে নীতিমালা প্রস্তুত করলেন না?

এই নীতিমালাটি যদি পরবর্তীকালে, অন্য সরকারের আমলে একই ভাবে চালু থাকে, তাহলে তখন এখনকার লেখক কর্মকর্তাদের ওপর তো তা নাজিল হতে পারে, তাদের ভালো, রুচিশীল বইকেও অশ্লীল আখ্যা দিয়ে মেলায় বিক্রয়যোগ্য নয় বলে, সেই প্রকাশককে তার অন্যান্য প্রকাশিত বইসহ মেলার বাইরে ঠেলে দিতে পারে। অর্থাৎ একটি বইয়ের জন্য প্রকাশকের এক হাজার বইকেও প্রায় নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলে, তাকে কি ন্যায় বলা যাবে? সেটা কি ভেবে দেখেছেন একাডেমি কর্তৃপক্ষ?

আমার মনে পড়ছে জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনামলে নাটকসহ সব ধরনের ম্যানাস্ক্রিপ্ট কর্মকর্তাদের দিয়ে পড়িয়ে/ চেক করিয়ে, পারমিশন নিয়ে আসতে হতো। সেই সামরিক পরিস্থিতি কি এখন বিরাজ করছে?

বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলার পরিসর বেড়েছে। বাংলা একাডেমি চত্বর ছেড়ে বাইরে মেলা করার প্রস্তাব নিয়ে বাগবিতণ্ডা হয়েছে অতীতে, বহুবার। অমর একুশের মর্যাদা হানি হবে এরকম বিবৃতিও দিয়েছেন এদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল কবি-সাহিত্যিক মহল। আজ যখন বাংলা একাডেমি চত্বর ছেড়ে বা চত্বরকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত সম্প্রসারিত করায়, এই মেলার শোভা বেড়েছে। পাঠক, লেখক ও ক্রেতাদের জন্য সুপরিসর আনন্দদায়ক হয়েছে। নিশ্চয় এখন অমর একুশের মহানত্ব হানির কবলে পড়েনি। বরং তা বেড়েছে। ভবিষ্যতে এই মেলাটি আরও বড় ও আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ ও উদযোগ নিতে হবে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রসার ও এর পরিধি বাড়ছে অনুবাদের সহযোগিতায়।

বিভিন্ন ভাষায় বাংলা বইয়ের অনুবাদ আরও ব্যাপক করে তুলতে হবে, এটাই আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে পৌঁছানোর উপায়। সেই উদ্যোগ নেওয়া উচিত সরকারি তরফ থেকে। অনুবাদের একটি ছোট সেল আছে বটে এখন একাডেমির, তবে তা জাতির সৃষ্টিশীল ও মননশীল সাহিত্যের অনুবাদের জন্য খুবই ছোট। সরকার যদি বরাদ্দ বাড়িয়ে দেয়, তাহলে একশ অনুবাদকের একটি এক্সক্লুসিভ সেল গড়ে তোলা যায়। এবং প্রতি বছর যদি একশটি বই প্রকাশ করতে পারে একাডেমি এবং সেগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে পরিবেশনার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আমরা লাভবান হবো।

এটা মনে রাখতে হবে যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে বাংলা ভাষা। দেশে দেশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে সৃষ্টিশীল মানুষ ও পাঠকদের আগ্রহ বাড়ছে। সেই আগ্রহকে ক্যাশ করতে হলে আমাদের দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের বইমেলা আন্তর্জাতিক মেলা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এর ব্যতিক্রমে আমরা নিজেদের তুলে ধরতে পারবো না আন্তর্জাতিক পাঠকের সামনে।
০২/০২/২৩

লেখক: কবি, সাংবাদিক, লেখক।

এইচআর/ফারুক/এমএস