ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

এক মেশিন মেরামতে ৪২ চিঠি ও কৃষণ চন্দরের গল্প

মোস্তফা হোসেইন | প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

উর্দু কথাসাহিত্যিক কৃষণ চন্দরের লেখা একটি গল্প অনেকেরই মনে থাকার কথা। সেই যে,জাম গাছের নিচে চাপা পড়েছে এক ব্যক্তি। গাছ কেটে সেই ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে গিয়ে মালী থেকে সরকারের মন্ত্রী পর্যন্ত ফাইল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করার সে কী কসরত! এটি গল্প হলেও বাস্তবতায় এর দেখা মেলে।কৃষণ চন্দরের গল্পে যেমন একজন মানুষকে বিপদগ্রস্ত হতে দেখা যায়,মানুষটির প্রাণ বাঁচানোর চেয়ে যেমন সরকারি আইন-কানুনের পেছনে দৌড়াচ্ছে মালি, ক্লার্ক থেকে সচিব পর্যন্ত,তেমনি মনে হচ্ছে- বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের কিছু অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার বিষয় পর্যালোচনা করলে।

সম্প্রতি এমন একটি সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, ঢাকার একটি পত্রিকায়। একটি হাসপাতালের একমাত্র এমআরআই যন্ত্রটি ১০ কোটি টাকায় কেনার ৩ বছর চালানোর পর সেটি নষ্ট হয়ে যায়। একবার মেরামতের পর আবার নষ্ট হয়ে পড়ে।এরপর শুরু হয় চিঠি পাঠানোর পালা। মেরামতের জন্য ৪ বছরে মাত্র ৪২বার চিঠি দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দফতরে।

কিন্তু চিঠির পর চিঠি দেওয়ার ফল হচ্ছে,স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বার কয়েক পরিদর্শন। আর তখনই রুমের তালা খোলা হয়েছে ৪বছরের মধ্যে।আর এই দুরবস্থাটি কোনো পল্লী চিকিৎসাকেন্দ্র কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নয়, বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। যেখানে প্রতিদিন শতাধিক রোগীকে এমআরআই করতে হয়।

আইসিও বেড না থাকায় প্রতিদিন রোগী মারা যাচ্ছিল। অথচ করোনারও অনেক আগে সেখানে ১০টি আইসিও বেড গুদামে পড়ে ছিল। চিকিৎসায় সংকট তীব্র হওয়ার পরও সেগুলো ব্যবহার উপযোগী করা যাচ্ছিল না। সেই চিঠি চালাচালির মতো ঘটনা ঘটলো সেখানে।একসময় বেডগুলো সেট করা হলো হাসপাতালে। মাঝখানে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারালো আইসিও সুবিধা না পেয়ে।

সরকারি হাসপাতাল হওয়ার কারণে এখানে সাধারণ রোগীরা ৩ হাজার টাকা খরচ করে এমআরআই করতে পারতেন। সেখানে তাদের যেতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে। আর এই জন্য ব্যয় করতে হচ্ছে ১২-১৫ হাজার টাকা। যা গরিব রোগীদের পক্ষে অস্বাভাবিক বোঝা হিসেবে গণ্য।এই ৪২বার চিঠি পাঠানোর পরও যন্ত্রটি সচল না হলেও আমলাতান্ত্রিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল এমন বলা যাবে না। সেই কৃষণ চন্দরের গল্পের মতো ফাইল চালাচালি নিশ্চয়ই হয়েছে। ফল কী হয়েছে তা সংবাদেই বিবৃত আছে।

মেরামতের জন্য ৭ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে সরকারকে। একবার মেরামত করার পর চলেছে ১ বছর। আবার মেরামত করলে কয় মাস চলবে তা নিশ্চিত নয়। এমতাবস্থায় আবারও ৭ কোটি টাকা ব্যয়ের যৌক্তিকতা প্রশ্নাতীত নয়।যদি ২/৩ কোটি টাকাও খরচ হয় সেটাও কি যথাযথ হবে?যদি মেরামতের ৬মাস এক বছরের মধ্যে আবারও নষ্ট হয়ে যায়,তখন মেরামতের পুরো টাকাই যে গচ্চা যাবে। ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা সন্দেহযুক্ত ব্যয় না করে ১০কোটি টাকায় আরেকটি মেশিন ক্রয় কি যথাযথ নয়?

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানে ৪ বছর ধরে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত মানুষ, মাত্র ৭ কোটি টাকার কারণে,এটা কি সহজবোধ্য হতে পারে? এত বড় হাসপাতালে যেখানে কমপক্ষে ২/৩টি মেশিন থাকা জরুরি,সেখানে ১টা থাকলেও তা অকেজো এবং চিঠি চালাচালির চাপে পড়েছে।সর্বশেষ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,এমআরআই মেশিনটি মেরামতশেষে ট্রায়ালে আছে।

এত বড় হাসপাতালে এনজিওগ্রাম মেশিন দুইটা তার মধ্যে একটা এখন সচল আছে। কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী এই বছরের শেষ নাগাদ আরও দুটি এমআরআই মেশিন যুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু সেই আশা পূরণে কত চিঠি চালাচালি হবে সেই আশঙ্কা তো থেকেই যায়। সংবাদ প্রকাশের পরদিন ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপকালে অনুমান হয়েছে তাদের আন্তরিকতা আছে। প্রশ্ন হচ্ছে,এই আন্তরিকতার প্রতিবন্ধকতা কোথায়।
প্রসঙ্গক্রমে চট্টগ্রামের একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য অতি জরুরি যন্ত্রপাতি চিকিৎসা বিষয়েও যে কতটা অবহেলা তার অসংখ্য প্রমাণ ছড়িয়ে আছে সরকারি হাসপাতালগুলোতে। উদাহরণ হিসেবে তিনি করোনাকালের কথা বললেন। আইসিও রোগী হঠাৎ করে এত বেড়ে গেলো,যে চিকিৎসা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়লো।

আইসিও বেড না থাকায় প্রতিদিন রোগী মারা যাচ্ছিল। অথচ করোনারও অনেক আগে সেখানে ১০টি আইসিও বেড গুদামে পড়ে ছিল। চিকিৎসায় সংকট তীব্র হওয়ার পরও সেগুলো ব্যবহার উপযোগী করা যাচ্ছিল না। সেই চিঠি চালাচালির মতো ঘটনা ঘটলো সেখানে।একসময় বেডগুলো সেট করা হলো হাসপাতালে। মাঝখানে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারালো আইসিও সুবিধা না পেয়ে। বেডগুলো যখন হাসপাতালে স্থাপন করা হলো ততদিনে করোনার প্রকোপ কমে গেছে।

এই অবস্থা শুধু চট্টগ্রামে নয়। মোটামুটি সারাদেশের চিত্র একই। পত্রিকাগুলো এসব সংবাদ প্রকাশ করে।জীবন বাঁচানোর এসব যন্ত্রপাতি বিষয়ে গাছাড়া ভাব এতই প্রকট যে, সংবাদগুলোও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। পত্রিকার ভিতরের পাতায় সিঙ্গেল কলাম কিংবা বড়জোড় ২ কলামজুরে জায়গা পায় সেসব। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর করুণ হালের চিত্র দেখতে গিয়ে সার্চ দিতেই বেরিয়ে আসে গোপালগঞ্জে অযত্নে অবহেলায় ১৫টি অ্যাম্বুলেন্স ও কয়েকটি গাড়ি মাটিতে মিশে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে,(ইনকিলাব ৩ মার্চ ২০২৫); পাবনা জেনারেল হাসপাতালে প্রায় আট মাস ধরে নেই এক্সরে ও সিটি স্ক্যান মেশিনের ফিল্ম। এতে প্রতিদিন সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন হাজারো রোগী।

হাসপাতালেই ২০০ টাকায় এক্সরে করার সুযোগ থাকলেও ফিল্ম সংকটের কারণে রোগীদের বাধ্য হয়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা খরচ করে বেসরকারি ক্লিনিকে এক্সরে করাতে হচ্ছে। (সময় নিউজ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)। এমন অসংখ্য খবর প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশে হচ্ছে।কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে কমই।হোক পত্রিকায় সংবাদ এতে কিছু আসে যায় না। হাসপাতাল যেখানে রোগাক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা হবে কীভাবে? আর এই দুরবস্থার জন্য শুধু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরই এককভাবে দায়ী করার সুযোগ কম। কারণ মুক্তবাজারের সুবাদে প্রতিটি শহরের অলিগলিতে গড়ে উঠেছে প্রাইভেট ক্লিনিক। যেগুলোতে উচ্চমূল্যে তারা সেবা বিক্রি করে থাকে।এরা সিন্ডিকেট করে রোগীদের তাদের কাছে টানে। আর প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো সেই সুযোগ গ্রহণ করছে। এদের সিন্ডিকেট সবজায়গাতেই কাজ করছে। সরকারি হাসপাতালের কিছু মানুষও যে এর সঙ্গে যুক্ত এমন কথাও শোনা যায়।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে সাধারণত গরিব মানুষই বেশি চিকিৎসা নিতে যায়। সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবাকে বিঘ্নিত করে কিছু মুনাফালোভী এবং তাদের সহযোগীরা। এদের সহযোগিতা করে লালফিতার দৌরাত্ম্য। সেই উর্দু কথাসাহিত্যিক কৃষণ চন্দরের জামগাছ কাহিনীর মতো। অথচ এই দুরবস্থার কুশীলবদেরও রোগী হতে হয়, চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যেতে হয়। অসুবিধাগুলো যে তাদেরও পোহাতে হয় না হলফ করে বলবে কে? এই দুরবস্থা থেকে বাঁচার পথ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার সততা ও মানবতাবোধ।

লেখক : সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন