ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

চীন-ভারতের মহামারি কূটনীতির শেষ পরিণতি কী

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ০৯:১০ এএম, ২০ মে ২০২১

কোভিশিল্ড নামে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা, আর স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কোভ্যাক্সিন- এই দুটি টিকাই তৈরি করেছে ভারত। অন্যদিকে সিনোফার্মের টিকাসহ চীনা টিকা নিয়ে চীনারা শুরু থেকে টিকার বিশ্ববাজার দখলের চেষ্টায় ছিল। বাংলাদেশ শুরু থেকেই কোভিশিল্ড এবং সিনোফার্মের টিকা পেতে আগ্রহী ছিল। চীন-ভারতের টিকা কূটনীতির চিপায় পড়ে শেষ পর্যন্ত কোভিশিল্ড আনার ব্যাপারে চুক্তি করে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ভারতের বেসরকারি মালিকানাধীন সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার উৎপাদন দক্ষতা বাড়াতে এখাতে বিনিয়োগও করে। টিকা কূটনীতিতে বিফল হয়ে দূরে সরে যায় চীনারা।

চুক্তি করলেও শেষ পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত টিকা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ভারত করোনাভাইরাসের টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচিতে সৃষ্টি হয়েছে সঙ্কট। অনিশ্চয়তাও। টিকা কেনার এজেন্ট ছিল বেক্সিমকো। তারা নিজেরা ব্যর্থ হয়ে সেরাম থেকে প্রাপ্য টিকার চালান আনার জন্য ভারত সরকারের ওপর চাপ দিতেও বলেছিল বাংলাদেশ সরকারকে কারণ সেরামকে দেড় কোটি ডোজ টিকার জন্য অগ্রিম অর্থ দিয়েছে বাংলাদেশ, তাই সেটি ভারত আটকাতে পারে না। সেরাম থেকে তিন কোটি ডোজ টিকা কেনার জন্য বাংলাদেশ চুক্তি করেছে। ভারত থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া ২০ লাখ ডোজ টিকাসহ বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এক কোটি ২ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে।

চীনা প্রভাব মোকাবিলার করার কূটকৌশল হিসেবে টিকা কূটনীতি নিয়ে সবার আগে মাঠে নামে ভারত। ভারত এই ভ্যাকসিন কূটনীতির উদ্যোগ নিয়েছিল এ অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব মোকাবিলার অংশ হিসেবে। ভারতের বক্তব্য হচ্ছে, চীন এই টিকার বিষয়টিকে তাদের বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের অংশ করেছে। এমনকি তাদের 'সফ্ট পাওয়ার'কে জোরদার করার জন্য তাদের 'স্বাস্থ্য সিল্ক রোড' উদ্যোগেও এই টিকার বিষয়টিকে খোলাখুলিভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বিপরীতে ভারত ‘টিকাজাতি’ আর ‘টিকাজাতীয়তাবাদ’-এর উর্ধে উঠে ‘টিকামৈত্রী’ প্রচারণার আওতায় কোটি কোটি টিকা তৈরি করে ৬০টির মতো দেশকে পাঠিয়েছে। ভারতে উৎপন্ন টিকার কিছু চালান বিনামূল্যে পাঠানো হয়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, ভূটান, নেপাল, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, সেশেলস ও বাহরাইনে। বাণিজ্যিক রফতানি করেছে ব্রাজিল ও মরক্কোসহ আরও কয়েকটি দেশে।

ওষুধ তৈরিতে ভারত একটা পরাশক্তি বলা যায়। তারা বিশ্বের ২০ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন করে। তার মধ্যে আছে মোট টিকার ৬২ শতাংশ। অনুমোদন পাওয়ার আগেই ভারত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তৈরিতে দুঃসাহস দেখিয়েছি সেরামকে দিয়ে। বাংলাদেশ সে উৎপাদনে অর্থ দিয়ে শরিক হয়েছিল।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসে এখন দেখা যাচ্ছে ভারত টিকা কূটনীতিতে চীনের কাছে ব্যর্থ হতে চলছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে ভারতে। পবিত্র গঙ্গার জল অপবিত্র হয়ে উঠেছে লাশের পর লাশ ভেসে উঠায়। প্রায় দুই হাজার লাশ উঠানো গঙ্গা থেকে। শ্মশানে স্থান পাচ্ছে না বলে বানারসিতে গিয়ে মরার শখ মিটে যাচ্ছে হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসীদের। অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে এরচেয়ে বড় ধাক্কা খায়নি প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার। তারউপর, গোমূত্র-গোবর খেয়ে, গায়ে গোবর মেখে করোনা দূর করার প্রচারে লিপ্ত বিজেপি নেতারা বিশ্বের কাছে ভারতের ইমেজকে হাস্যকর করে তুলেছে।

বাংলাদেশ অবশেষে টিকা কূটনীতির শিকার হয়ে চীন ও রাশিয়ার দিকে হাত বাড়িয়েছে ভ্যাকসিনের আশায়। দু’দেশের সঙ্গে টিকা নিয়ে চুক্তির বিষয়টিও অনেকদূর এগিয়েছে। চীন থেকে উপহার হিসেবে চলতি মে মাসেই এসেছে পাঁচ লাখ ডোজ সিনোফার্মের করোনাভাইরাস টিকা।

ভারত চীনকে টিকা দিয়ে ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে অভিযোগ করলেও চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলছেন, টিকার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মধ্যে কোনো উগ্র প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত নয়, সংঘাত তো নয়ই। কোভিড -১৯ মহামারি নিয়ে সহযোগিতা দৃঢ় করার লক্ষে চীন গত ১০ মাসে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে চার দফা বহুপক্ষীয় ভার্চুয়াল সম্মেলন করেছে।

সার্ক দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা অংশ এতে অংশ নিয়েছিল। চীনের স্টেট কাউন্সিলর এবং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ২০২০ সালের জুলাইয়ে তার মহামারি কূটনীতিক উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সহায়তা ও কৌশলগত কর্মসূচি নিয়ে সম্মেলনের সিরিজটি উদ্বোধন করেছিলেন, যার সর্বশেষটি ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। চীন তার আগ্রাসী কূটনীতির ধারায় ভ্যাক্সিন কূটনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সুসংযুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এই সম্মেলনে।

জুলাই বৈঠকে চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিসি) এবং ট্রান্স-হিমালয়ান মাল্টি-ডাইমেনশনাল কানেকটিভিটি নেটওয়ার্কের সঙ্গে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলকে যুক্ত করার বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছিল। তৃতীয় সম্মেলনে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য বেল্ট এবং রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পের পাশাপাশি চিকিত্সার জন্য সহায়তার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ওয়াং ই বলেছিলেন, ‘আমরা সিপিইসি এবং ট্রান্স হিমালয়ান কানেকটিভিটি নেটওয়ার্ককে সক্রিয়ভাবে প্রমোট করব, আফগানিস্তানে করিডোরের সম্প্রসারণকে সমর্থন করব এবং আঞ্চলিক সংযোগের লভ্যাংশ আরও বাড়িয়ে দেব।’

চতুর্থ দফার আলোচনায় করোনাকে যৌথভাবে প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ; বহুপাক্ষিকতা বজায় রাখতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমর্থন নিয়ে করোনভাইরাসকে রাজনীতিকরণ ও কলঙ্কিতকরণ এড়ানো; যৌথভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্প্রদায় গঠন; অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতা পুনরায় শুরু করা; শিল্প ও সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিআরআই অবকাঠামো প্রকল্পের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা; এবং ডিজিটাল ক্ষেত্রে নতুন অর্থনৈতিক বৃদ্ধি পয়েন্ট তৈরির বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়।

চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওয়েই ফেঙ্গি দক্ষিণ এশিয়ায় সামরিক জোট স্থাপনের জন্য এই অঞ্চলের বাইরের শক্তি তথা মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রস্তাবিত কোয়াড গ্রুপের বিরোধিতা করার জন্য শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশকে আহ্বান জানিয়েছেন। চীনকে ঘিরে কোয়াডের হম্বিতম্বি বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের নজর কাড়তে শুরু করেছে এই অনানুষ্ঠানিক জোট। বাংলাদেশ সফরে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর এজেন্ডা ছিল কোয়াড থেকে বাংলাদেশকে দূরে রাখা। আর সেটাই অতি সম্প্রতি প্রকাশ্যে বলে দিয়ে ঢাকাস্থ চীনা রাষ্ট্রদূত বেকায়দায় পড়েন এবং বাংলাদেশকেও তার পররাষ্ট্রনীতিতে প্রকাশ্যে নাক গলানোর বিষয়ে আপত্তি জানাতে দেখা যায়। চীন কোয়াডকে ন্যাটো বা ইন্দো-প্যাসিফিক রিজিয়ন-এর মতোই একটি সামরিক জোটের সূচনা হিসেবে দেখেছে।

ওয়াং ই সেপ্টেম্বরে রাশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান এবং মঙ্গোলিয়া সফর করেছিলেন; অক্টোবরে কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, লাওস এবং থাইল্যান্ড; নভেম্বর জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া; এবং ডিসেম্বর মাসে নেপাল এবং পাকিস্তান সফর করেন। এই সফরগুলিতে চীনের প্রতিবেশী কূটনীতির অংশ হিসেবে সম্পর্ক বাড়ানো, সহযোগিতা আরও গভীরতর করা এবং সামরিক পারস্পরিক বিশ্বাসকে উন্নীত করার কথা বলেছে।

চীনের এই কূটনৈতিক প্রয়াসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সাউথ ইস্ট এশিয়াকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট এবং বহুমুখী আন্তর্জাতিক পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রেখে চীনের স্বার্থ রক্ষা করা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে সামরিক সহায়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি করোনা মহামারি কূটনীতি থেকে মহামারি রাজনীতির দিকে যায় কিনা সেটাই আশংকার বিষয় এখন। চীনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলিকে নির্ধারণ করতে হবে যে তারা নন-অ্যালাইনমেন্ট নাকি মাল্টি- অ্যালাইনমেন্ট দিকে যাবে। এদের অনেকের চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- দুটিকেই যেমন প্রয়োজন, তেমনি ভারতকেও উপেক্ষা করা কঠিন।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/এএসএম