ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ফেডারেল ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক কি দায় এড়াতে পারে?

প্রকাশিত: ০৪:৩৬ এএম, ১৫ মার্চ ২০১৬

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ হ্যাকিং বা চুরি হয়েছে। আমেরিকার ফেডারেল ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক এ জমা  ওই টাকা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অগোচরে ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনে এবং ২০ মিলিয়ন ডলার শ্রীলংকায় পাঠানো হয়েছে। ফিলিপাইন সরকার তাদের দেশে ওই অর্থ প্রবেশ করেছে এমনটি স্বীকার করলেও শ্রীলংকার পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়েছে। শ্রীলংকা স্বীকার করুক আর না করুক বাংলাদেশের ১০১ মিলিয়ন ডলার যে  চুরি হয়েছে সেই বিষয়টি সত্য। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, গত ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিস থেকে  ফেডারেল ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ককে ৩৫টি নির্দেশনা যায়। ওই নির্দেশনার মধ্যে ৫টি নির্দেশনা আমলে নিয়ে ফেডারেল ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক মোট ১০১ মিলিয়ন ডলার বা ১০ কোটি ১০ লক্ষ টাকা ছাড় করে। ৫টি নির্দেশনা ছাড় করার পর একটি নির্দেশনায় ইংরেজি ফাউন্ডেশন বানান ভুল হওয়ায় ফেডারেল ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কের সন্দেহ হয় এবং তারা বাকি নির্দেশনাগুলো আটকে দেয়। হ্যাকিং চক্রের ইংরেজি বানান ভুলের কারণে বাংলাদেশের কয়েক’শ মিলিয়ন ডলার রক্ষা পায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই অর্থ লোপাটের সাথে দেশি না বিদেশি চক্র জড়িত তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায় নি। তবে তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের ধারণা বিদেশি হ্যাকিং চক্রের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকতে পারে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই অর্থ লোপাটের সাথে যে চক্রই জড়িত থাক না কেন এর দায়ভার ফেডারেল ব্যাংক অফ নিউ ইয়র্কও এড়াতে পারে কি? একটি রাষ্ট্রের রিজার্ভের অর্থ যদি কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে বেহাত করা সম্ভব হয়; তাহলে হাজার হাজার ডলার খরচ করে রাষ্ট্রীয় ওই অর্থ ফেডারেল ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক এ রাখার দরকার কি? যদিও ফেডারেল ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের কোনো সিস্টেমের ত্রুটির কারণে ওই হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটেনি। ওই ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক হবার ফলে।

বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে সারাবিশ্বই হ্যাকিং ঝুঁকিতে রয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত বিশ্বেও প্রায়শই হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে জালিয়াতি চক্র লক্ষ লক্ষ ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ এ ধরনের পরিস্থিতি প্রথম মোকাবেলা করলেও ফেডারেল ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক এর যে কোনো দেশের সার্ভার হ্যাক হয়ে হ্যাকাররা অর্থ জালিয়াতি করতে পারে- সেই বিষয়টি তাদের অজানা থাকার কথা নয়। তাদের ক্লায়েন্টদের সার্ভার হ্যাকিং হলেও তাদের অর্থ নিরাপদে থাকবে এমন ব্যবস্থা তারা করেনি কেন? এই বিষয়টি সবাইকে অবাক করেছে।

ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সেবা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা না থাকলেও ব্যাংকের একজন গ্রাহক হিসেবে দেখেছি যখন কোনো বড় অংকের টাকা আমার একাউন্ট থেকে অন্য একাউন্টে স্থানান্তরণ করা হয় তখন আমাকে ফোন দিয়ে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। কিছুদিন পূর্বে ইউরোপের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে যেয়ে দেখেছি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাত্র ৪০ ডলার স্থানান্তরণ করা হলেও ব্যাংক থেকে আমাকে ফোন করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। আমার সম্মতি পাওয়ার পরই তারা অর্থ ছাড় করেছে। আর একদিনে কতবার টাকা তোলা বা অন্য একাউন্টে পাঠানো যাবে তা ব্যাংক হিসাব খোলার সময়েই বলে দেয়া হয়েছে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ব্যাংকিংয়ের এ সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করলে এই ধরনের ঘটনা ঘটত না তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

শুধু হ্যাকিং নয়, প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণেও টাকা পাঠানোর নির্দেশনা যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে কোনো  ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া টাকা পাঠানোর নির্দেশ যাওয়ার সাথে সাথে টাকা পাঠিয়ে দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত? যদিও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ ছাড়ের নির্দেশ  যাওয়ার পর তারা বার্তা পাঠিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হতে চেয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ইংরেজি ফাউন্ডেশন বানান ভুলের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হলে তারা যখন অর্থ ছাড় করা বন্ধ করে দিয়েছে তখন তারা সাথে সাথে ওই সন্দেহ সত্য কিনা তা যাচাই করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে ফোন করেনি কেন? অথবা অর্থ ছাড় বন্ধ করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থ ছাড়ের জন্য কোনো যোগাযোগ না করায় ওই অর্থ যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ছাড় করতে বলা হয়নি; অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষ এ কাজ করছে এমন বিষয়টি ভাবার মতো দক্ষ কর্মকর্তা কি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে নেই? -বিষয়টি আমাদের বিস্মিত করেছে।

ফেডারেল ব্যাংক অব নিউ ইর্য়ক নিশ্চয় জানে যে, তার ব্যাংকে সংরক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কোনো ব্যক্তির বা ব্যাংকের নিজস্ব অর্থ নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের অর্থ। তারা কেন সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এই প্রশ্ন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা যেতে পারে? পাশাপাশি ফাউন্ডেশন বানানের ভুলের কারণে নির্দেশনার বাকি অর্থ ছাড় করা বন্ধ করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যখন কোনো যোগাযোগ করা হয়নি তখন তারা অর্থ বন্ধ করার পাশাপাশি ফিলিপাইন ও শ্রীলংকার যে ব্যাংকগুলোয় অর্থ ছাড় করা হয়েছে তাদেরকেও সন্দেহের বিষয়টি অবহিত করে আপাতত ওই অর্থ ছাড় না করার জন্য নির্দেশনা পাঠাতে পারতো। এমন তো নয় যে, হ্যাকাররা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিউ ইর্য়ক ফেডারেল ব্যাংক থেকে ফিলিপাইন ও শ্রীলংকায় অর্থ পাঠিয়ে তা সাথে সাথে হংকংয়ে পাচার করেছে। তারা প্রথমে ওই অর্থ ফিলিপাইনের একাধিক হিসাবে পাঠিয়েছে। তারপর ওই অর্থ তুলে স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তর করে ক্যাসিনো বা জুয়ার আসরে বিনিয়োগ করে ওই অর্থকে বৈধতা প্রদান করার পর অন্য একটি রাষ্ট্র তথা হংকংয়ে পাচার করেছে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হ্যাকারদের অনেক সময় লেগেছে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সন্দেহ হওয়ার সাথে সাথে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করতো, আমারিকা, বাংলাদেশ, ফিলিপাইন ও শ্রীলংকার কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতো; তাহলে জালিয়াতি চক্রের পক্ষে ওই অর্থ ব্যাংক থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না।

তবে প্রশ্নগুলো উত্থাপনের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের ব্যাংকের গাফিলতিকে ঢাকতে চাইছি না। বরং ভষ্যিৎতে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বাংলাদেশের টাকা কতটুকু নিরাপদ সেই প্রশ্ন উত্থাপন করছি। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে হ্যাকিং স্বাভাবিক ঘটনা। ভবিষ্যতেও এই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তাই এখনই ভাবতে হবে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক আমাদের টাকা কতটুকু নিরাপদে রাখছে সেই বিষয়টি। পাশাপাশি আমরা মনে করি হ্যাকাররা যতই শক্তিশালী হোক না কেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার যোগসাজশ ছাড়া এই ধরনের ঘটনা ঘটা অসম্ভব। তাই নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দলমতের উর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে দোষী কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এই ঘটনার সাথে যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্টতা থাকেন; তবে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যুদ্ধাপরাধীর বিচারে মতো এই যুগের বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরকে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে বিচারের দাবি করছি।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন