চট্টগ্রাম-৮ আসন
বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে তরুণদের নিয়ে টক্কর দিতে চায় এনসিপি
এরশাদ উল্লাহ, ডা. আবু নাসের ও জোবাইরুল হাসান আরিফ
পাঁচলাইশ-চান্দগাঁওয়ের ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে এলাকা ও বোয়ালখালীর গ্রামীণ জনপদ নিয়ে চট্টগ্রাম-৮ আসন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে এরই মধ্যে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি। অন্তর্কোন্দল নিয়ে বিএনপিতে কিছুটা অস্বস্তি থাকলেও জামায়াত-এনসিপি অনেকটা নির্ভার হয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে।
বিগত এক দশকে রাজনীতির পালাবদল, দলীয় সিদ্ধান্ত, কেন্দ্র-তৃণমূল সম্পর্ক, ভোটার মনস্তত্ত্ব- সব মিলিয়ে এ আসনের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে গেছে। সীমানা পরিবর্তনের পর ২০০৮ থেকে এ আসনে টানা ক্ষমতায় ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী। দেশের বৃহৎ এ দলটি এবার নির্বাচনি মাঠে নেই। অন্য দলগুলোর প্রার্থীদের কাছে ভোটারদের প্রত্যাশা অনেক।
নির্বাচনি এলাকার প্রধান সমস্যার মধ্যে রয়েছে জলাবদ্ধতা, খাল–ড্রেন ভরাট, বর্ষায় পানি জমা, কালামিয়া বাজার-বহদ্দারহাট-চকবাজার লিংকে ভয়াবহ যানজট, মাদক ও কিশোর অপরাধ, বোয়ালখালীর সড়ক-ঘাট-নৌযান সংকট প্রভৃতি।

পাঁচলাইশের শহুরে মধ্যবিত্ত ও কর্মজীবী ভোটাররা রাজনৈতিক দলের তর্কাতর্কির চেয়ে জীবনযাত্রার সমস্যাকে বেশি গুরুত্ব দেন। তারা চান জলাবদ্ধতা, ট্রাফিক জ্যাম, বর্জ্য সংকট, নগরসেবা- এসব ইস্যুতে দলগুলো দ্রুত সাড়া যেন দেয়। বিএনপি-জামায়াত উভয়ই এখানে তুলনামূলকভাবে দুর্বল।
চান্দগাঁওয়ের ছোট ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী ভোটাররা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হলেও জামায়াতের প্রভাবও রয়েছে এখানে। দলীয় সংগঠনের ওপরে নির্ভর করে দুই পক্ষই এখানকার ভোট ধরে রাখে।
বোয়ালখালী অংশে আবার রয়েছে ধর্মীয় ও গ্রামীণ ভোটার। ধর্মীয় অনুভূতি, ব্যক্তি-ইমেজ, সামাজিক সম্মান এসব বিষয়কে প্রাধান্য দেন এখানকার ভোটাররা।

চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপি থেকে লড়বেন বর্তমান নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ। জামায়াতে প্রার্থী ডা. আবু নাসের। পাশাপাশি মাঠে সরব উপস্থিতি আছে এনসিপি মনোনীত প্রার্থী জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক জোবাইরুল হাসান আরিফ।
বিএনপিতে দলীয় কোন্দল-অসন্তোষ
চট্টগ্রামের রাজনীতিতে পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁওয়ে বিএনপি নেতারা দীর্ঘদিন সংগঠনে প্রভাব রেখেছেন। কিন্তু ২০১৪, ২০১৮ ও পরবর্তীসময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আন্দোলন-সংগ্রাম, মামলায় জড়িয়ে পড়া এবং কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে নির্বাচন বর্জন- এসব কারণে এ অঞ্চলে বিএনপি সংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এবার মনোনয়ন কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকলে ভোট বিভাজন হতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোয়ালখালী উপজেলার এক নেতা জাগো নিউজকে জানান, এখানে তিনটি গ্রুপের রাজনীতি হয়। তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আছে। নমিনেশন ঘিরে সে কোন্দল আরও বেশি সামনে এসেছে। এখানে সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এম মোর্শেদ খান, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান ও বর্তমান নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ তিন মতের। বিএনপির সাধারণ ভোটাররা গ্রুপিংয়ের মারপ্যাঁচ বোঝে না। তাদের কোনো না কোনো পক্ষ নিতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষ মনে করে এ গ্রুপিং জিইয়ে থাকলে বিএনপির এ আসন পুনরুদ্ধার করা কষ্টসাধ্য হবে।
আরও পড়ুন
চট্টগ্রাম-১২/জয়-পরাজয়ে ফ্যাক্ট হতে পারে ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ ভোটার’
চট্টগ্রামের ১৬ আসন/গুলশানে বিএনপির সভায় ডাক না পেয়ে হতাশ অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশী
ঢাকা-১৭ আসন/প্রচারণা-আলোচনায় আন্দালিব পার্থ-খালিদুজ্জামান, ফের মাঠে হিরো আলম
ফাঁকা কক্সবাজার-২, বাকি তিন আসনে পুরোনোতেই ভরসা বিএনপির
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর বিএনপির এক নেতা বলেন, পাঁচলাইশ–চান্দগাঁও অঞ্চলে সাংগঠনিক পুনর্গঠন নানা কারণে ধীরগতিতে চলছে। তৃণমূলে ‘দলীয় গ্রুপিং’, ‘পুরোনো-নতুন নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব’ এবং মনোনয়নপ্রত্যাশীদের পরস্পরবিরোধী অবস্থান কর্মীদের গতিশীলতা কমিয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে যাদের এক সময় শক্ত প্রভাব ছিল, তাদের অনেকে এখন মাঠে কম সক্রিয়। তরুণ ভোটারদের মধ্যে দলটির গ্রহণযোগ্যতা আছে, কিন্তু সংগঠনের ঘাটতি সেই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না।

স্থানীয়রা মনে করেন গ্রুপিংয়ের রাজনীতি বাদ দিয়ে এক হয়ে গেলে বিএনপির জয় ঠেকানো ‘অসম্ভব’। চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপি মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী ও নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করি। জনকল্যাণমুখী কাজ করেছি। বিভিন্ন সময়ে এলাকার গরিব অসহায়দের মধ্যে ত্রাণ, ইফতার সামগ্রী বিতরণ করেছি। জনগণের মধ্যে ধানের শীষের গণজোয়ার দেখতে পাচ্ছি। গণসংযোগে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। জনগণ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচন করলে আমি বোয়ালখালীর জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করবো।’
জামায়াতের শক্ত ভোটব্যাংক
পাঁচলাইশ-চান্দগাঁও-বোয়ালখালীতে জামায়াতের একটি শক্ত ভোটব্যাংক রয়েছে। গত কয়েক বছরে দলটি স্থানীয়ভাবে সেবামুখী কার্যক্রম, মানববন্ধন ও জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে। ৫ আগস্ট পরবর্তীসময়ে জামায়াত মহানগর ও বোয়ালখালীতে বিনামূল্যে চিকিৎসা ক্যাম্পসহ জনকল্যাণমুখী কাজ করেছে। যার ফল নির্বাচনে পাবেন বলে মনে করেন দলটির প্রার্থী।
জামায়াত মনোনীত প্রার্থী ডা. আবু নাসের জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি গ্রামগঞ্জ, শহর-নগর, ঘরে ঘরে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। আলহামদুলিল্লাহ, ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। জনগণ আমাদের ডাকে সাড়া দিচ্ছে, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, আশ্বস্ত করছে। আমি বিভিন্ন সময়ে জনকল্যাণমূলক কাজ করেছি। বিভিন্ন দুর্যোগে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, রমজানে ইফতার সামগ্রী বিতরণসহ বিভিন্নভাবে সামাজিক কাজকর্মে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি। ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প করেছি। আমি আশাবাদী জনগণ আমার পক্ষে রায় দেবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসাখাতের উন্নয়নে কাজ করছি। কলকারখানা প্রতিষ্ঠা, নারী শ্রমিকদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, বেকার সমস্যা রোধ, মাদক সমস্যা দূরীকরণসহ বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে প্রায়োরিটি বেসিসে কাজ করছি এবং সামনে নির্বাচিত হই বা না হই কাজ করে যাবো।’
তরুণ প্রজন্মকে টার্গেট করে এগোচ্ছে এনসিপি
রাজনীতি ও ভোটের মাঠে নতুন। কিন্তু সাহস আর অদম্য শক্তিতে চষে বেড়াচ্ছেন মাঠ। করছেন সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগ। ব্যাপক সাড়া মিলছে বলেও জানান নেতাকর্মীরা। টার্গেট করেছেন তরুণ প্রজন্ম ও তরুণ ভোটারদের।

এ আসনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রার্থী দলটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক জোবাইরুল হাসান আরিফ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা চমৎকার সাড়া পাচ্ছি। জনগণ চাচ্ছে যারা গণঅভ্যুত্থানের শক্তি তাদের বিজয়ী করতে। আমাদের কেন্দ্রভিত্তিক কমিটির কাজ চলমান। জনগণের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে। তবে বাবলা হত্যাকাণ্ড নিয়ে জনগণের মধ্যে এখনো ভীতি কাজ করছে। আমাদের রাজনীতি জনগণের জন্য। নদীর এপার-ওপারের মানুষের বেকারত্ব দূর করাই হলো আমার মূল ইশতেহার।’
ভোটারদের প্রত্যাশা
সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম-৮ আসনে যিনিই নির্বাচিত হোক আমরা এমন একজন কার্যকর সংসদ চাই, যিনি এলাকাটার দীর্ঘদিনের কালুরঘাট ব্রিজ নিয়ে কাজ করবেন। আওয়ামী আমলে বাসদের এমপি হওয়ায় যতদূর উন্নয়ন হওয়ার কথা তার ছিটেফোঁটাও হয়নি। প্রার্থীরা শুধু প্রতিশ্রুতি দেন, আমরা এবার কাজ দেখতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘বোয়ালখালী শহরের একদম লাগোয়া উপজেলা। উপশহর হিসেবে অনেক উন্নয়ন হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু আওয়ামী আমলে নেতারা উন্নয়নের নামে বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে নিজেদের পকেটে পুরেছে।’
চান্দগাঁওয়ের বেসরকারি চাকরিজীবী ওমরগণি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা উন্নয়নের গল্প শুনেছি, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। নগরের জলাবদ্ধতা নিয়ে অনেক ইশতেহার শুনেছি। এবার যে জলাবদ্ধতা নিয়ে ইশতেহার দেবে এবং যার দ্বারা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে তাকেই আমরা ভোট দেবো।’

ফরহান হোসেন নামে আরেকজন ভোটার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এলাকার হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা খুবই দুর্বল। একজন জনপ্রতিনিধি যদি স্বাস্থ্যসেবার মানটা বাড়াতে পারেন, তাহলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। আমরা এবার বুঝে-শুনে-দেখে ভোট দেবো।’
ভোটের হিসাব-নিকাশ
আসনটিতে মোট নিবন্ধিত ভোটার (সাম্প্রতিক গণনা/ইসি হিসাব) ৫ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৬৩ হাজার ৫৪৩ জন ও নারী ভোটার ২ লাখ ৫৪ হাজার ১০৯ জন।
সীমানা পরিবর্তনের পর ২০০৮ ও ২০১৪ সালে মঈন উদ্দিন খান বাদল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল থেকে নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন নিয়ে নির্বাচিত হন তিনি। ২০২০ (১৩ জানুয়ারি) উপ-নির্বাচনে বাদলের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া আসনে আওয়ামী লীগের মোছলেম উদ্দিন আহমদ বিজয়ী হন। ২০২৩ (২৭ এপ্রিল) উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নোমান আল মাহমুদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে আবদুচ ছালাম স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করে বিজয়ী হন।
এমআরএএইচ/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম