ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

এ যেন বিশ্ববাসীর ঋণ ফিরিয়ে দেওয়ার অনন্য প্রয়াস

তোফাজ্জল লিটন | নিউইয়র্ক | প্রকাশিত: ০৫:৩০ পিএম, ১৪ মে ২০২২

নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের এরিনা থিয়েটার। যেখানে একাত্তর সালের প্রথম আগস্ট পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও সংগীতশিল্পী জর্জ হ্যারিসনের আয়োজনে হয়েছিল কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। সেদিন বিশ্ব নাগরিকদের ভালোবাসার ঋণে আবদ্ধ হয়েছিল মুক্তিকামী, স্বদেশবঞ্চিত, দরিদ্র বাংলার মানুষ। ৫১ বছর পর শুক্রবার (৬ মে) বাংলাদেশ আয়োজন করে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী।

বিশ্বব্যাপী খ্যাতনামা রক ব্যান্ড অ্যাম্বাসেডর স্কোরপিয়নের ও বাংলাদেশের চিরকুট ব্যান্ডের পরিবেশনা দেখতে ১৩ হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল এ বর্ণাঢ্য সঙ্গীতায়োজনে। কনসার্টের সমস্ত আয় সারা বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর শিশু-কিশোরদের সাইবার সিকিউরিটি সচেতনতা তৈরির কাজে ব্যয় করা হবে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এ যেন ছিল বিশ্ববাসীর ঋণ ফিরিয়ে দেওয়ার অনন্য প্রয়াস। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর আমেরিকান রাজনীতিবিদ ও তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি। সে কথায় যারা বিশ্বাস করতেন অথবা এখনো করেন, তাদের তিন মিনিটের তিনটি তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে উন্নয়নশীল বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের কাহন। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এমন মাহেন্দ্রক্ষণ আসে কালেভদ্রে।

jagonews24

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইসিটি বিভাগের হাইটেক পার্ক এই আয়োজন করেছে। নেই তেমন কোনো প্রচারণা, বাংলাদেশের বড় কোনো ব্যান্ড দল আসেনি। নেই আমেরিকান কোনো ব্যান্ডদল। এমন অনেক নেতিবাচক ধারণা নিয়ে অনুষ্ঠানে এসেছিলাম। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে দুই ধাপের নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে দীর্ঘ খোঁজাখুঁজি করে নিজের আসনটি পাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়।

কনসার্ট শুরু হওয়ার কথা রাত ৮টায়। পরিচিত অনেক মানুষের দেখা পাই আশপাশে। শেতাঙ্গ আমেরিকানও দেখছি। ২০৭৮৯ আসন সমৃদ্ধ এ হলে অগণিত সিট খালি দেখে নেতিবাচক ধারণা বাড়ে ক্রমশ। ভুলে যাই ঠান্ডা ও দিনব্যাপী ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির কথা। আমার সিটের কাছে যাওয়ার পথে দেখেছিলাম প্রতি প্রবেশপথের পাশে আছে স্নেকস, অ্যালকোহল ও নন অ্যালকোহল পানীয়ের বুথ।

বিজ্ঞাপন

jagonews24

একটি বসেছে শুধু স্কোরপিয়ন ব্যান্ডের পোলো শার্ট ও হুডি নিয়ে। স্নেকস নিতে এসে দেখি স্করপিয়ন বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। আমাদের হলের প্রবেশপথগুলোতে দর্শকের ভিড় বাড়ে। আবার হলে ঢুকে দেখি লোকে লোকারণ্য। প্রাচীন গ্রিক থিয়েটারের আদলে নির্মিত এই এরিনা থিয়েটার মিলনায়তনটি অন্তত ১৩ হাজার দর্শকের সমাগম। পাহাড়ের পাদদেশের মতো সমতলে বিশাল মঞ্চ। বাকি তিন দিকে দর্শক। স্তরে স্তরে আসনগুলো উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে।

মঞ্চ থেকে দর্শক গ্যালারি যেন বর্ণিল আলোর উচ্ছ্বাস। দর্শক গ্যালারিতে বর্ণিল আলো পড়লে মনে হয় রংধনুর কল্লোল বইছে। মঞ্চে গ্রাফিক্সের খেলা। ক্রিস্টাল ক্লিয়ার সাউন্ড। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে মঞ্চের সামনে শ’খানেক মনিটরের কাজ করছেন কর্মী বাহিনী। এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।

বিজ্ঞাপন

শতকরা ৬০ ভাগ দর্শক ইউরোপিয়ান। হাজার তিনেক হবেন আমন্ত্রিত বাংলাদেশি দর্শক। ফোন করে অনেক বন্ধু বলেছে টিকিট কাটতে পাচ্ছি না। অনেকেই গেটের সামনে এসে ফেরত গিয়েছেন। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বিলবোর্ডে লেখা উঠেছে সোল্ড আউট।

jagonews24

ঠিক রাত আটটায়ই অনুষ্ঠান শুরু হয়। তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বিশ্ব নাগরিকদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে স্বাগত বক্তব্যে ৫০ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নের কথা তুলে ধরেন। বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের পথ ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার আইটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

আগামী বছর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্লোবার সাইবার সিকিউরিটি বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া শুরু করবে ইউএনডিপি। তার বক্তব্যে সায় জানিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখর করে বাংলাদেশি দর্শকরা। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী কাদেরী কিবরিয়া।

এ সময় তার সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন মুক্তযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, মো. নুরুল আমিন ও অপরাজিতা হক। হল ভরা দর্শক এ সময় দাঁড়িয়ে সম্মান জানায় বাংলাদেশকে। অভূতপূর্ব এই দৃশ্যে অনেক মুক্তিযোদ্ধারা অশ্রুসিক্ত হয়েছেন।

jagonews24

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের ব্যান্ড ‘চিরকুট’ গত ২০ বছর ধরে মৌলিক গান করছে। এবার প্রথমবারের মতো বিশ্ব দরবারে এতবড় মঞ্চে উঠেছে তারা। দলটির প্রধান ভোকাল শারমিন সুলতানা সুমী শুরু করেন ‘ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটির দিয়ে। দলের অন্যান্য সদস্য ও বাংলাদেশি দর্শকরা তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলায়। তাদের ব্যান্ডের পুরাতন জনপ্রিয় কয়েকটি গানের পর সুমী গেয়েছিলেন ‘শোনো একটি মুজিবের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি’ গানটি।

এত বড় আয়োজন উপলক্ষে চিরকুটের নতুন কোনো গান না পেয়ে অনেকেই আশাহত হয়েছেন। নগর বাউল জেমস আসলে এ কনসার্টের পূর্ণতা পেতেন বলে প্রবাসীরা মনে করেন। তাদের ২০ মিনিটের পারফরমেন্স শেষে মঞ্চে আসে জার্মানির বিখ্যাত রক ব্যান্ড দল স্কোরপিয়নস। মঞ্চের বাদ্যযন্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি পরিবর্তনের সময় বড় স্ক্রিনে দেখানো হয় বাংলাদেশের উন্নয়নের তথ্যচিত্র।

১৯৬৫ সাল থেকে রক ও মেটাল গান গেয়ে জগৎখ্যাত হওয়া স্কোরপিয়নস মঞ্চে আসা মাত্রই দর্শকসারি প্রাণ ফিরে পায়। অলিভিয়া তার কিশোরী কন্যাকে নিয়ে এসেছেন স্কোরপিয়নস গান শুনতে। ‘আমি কিশোরী বয়স থেকে স্কোরপিয়নসের গানের জন্য পাগল। আমার মেয়েও তাদের জন্য একই রকম ভাবে পাগল’।

বিজ্ঞাপন

jagonews24

বলছিলেন জার্মানির দর্শক অলিভিয়া। একের পর এক জনপ্রিয় সব গান মাতিয়ে তোলে গোটা মিলনায়তন। মঞ্চ থেকে গ্যালারি একাকার হয়ে যায় সম্মিলিত কণ্ঠে। এ যেনো ১৩ হাজার মানুষের এক যৌথ পরিবেশনা। এ কনসার্টের প্রতিপাদ্য ‘লেট দ্য মিউজিক স্পিক’ আক্ষরিক অর্থে বাস্তবায়ন করেছে স্কোরপিয়ন।

৫১ বছর আগে একই মঞ্চে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করে সে সময়ের প্রখ্যাত ব্যান্ড তারকা জর্জ হ্যারিসনকে স্মরণ করে স্কোপিয়নস। তারা গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্টকে ‘বাংলাদেশ নাইট’ বলে অভিহিত করে। বুকে হাত রেখে বাংলাদেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তার স্ত্রী ক্রিস্টিনাকে নিয়ে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে তার প্রিয় ব্যান্ড দল স্কোরপিয়নস এর গান উপভোগ করছিলেন।

jagonews24

২০০০ ও ২০০৬ সালে নিউইয়র্কের প্রবাসী বাঙালিরা ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে সাড়ে চার হাজার আসন সমৃদ্ধ হলে অনুষ্ঠান করেছিল। এরিনা থিয়েটারে এটাই বাংলাদেশিদের প্রথম আয়োজন। প্রায় ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ের এই সুবিশাল অনুষ্ঠানে কেন জর্জ হ্যারিসন, রবিশঙ্কর পরিবারের কাউকে সম্পৃক্ত করা হয়নি?

কনসার্ট উপলক্ষে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিসে ৪ মে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছিলেন, আমরা জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা কনসার্ট ফর বাংলাদেশ নামটি ব্যবহার করতে দিতে চাননি। তিনি ১৯৭১ সালের কনসার্ট ফর বাংলাদেশের স্মৃতি নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকতে চান। রবিশঙ্কর পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। তারা কেউ যুক্ত হতে চাননি । এটি আমাদের অপরাগতা।

নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, এত বড় একটি আয়োজনের সঙ্গে থাকতে পেরে গর্ববোধ করছি। আমাদের এই আয়োজন আমেরিকার সরকারের সঙ্গে আরও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহযোগিতা করবে বলে বিশ্বাস করি। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে এসেছিলেন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম. শহীদুল ইসলাম, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা।

কনসার্টের জন্য বাংলাদেশ সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ১০ কোটি টাকা। ব্যয়বহুল এ কনসার্ট সফল ও সার্থক করতে এজন্য পৃষ্ঠপোষকতার করেছে বাংলাদেশের সিটি গ্রুপ, ওয়ালটন, আবুল খায়ের স্টিল (একেএস), ইউনাইটেড গ্রুপ, বিকাশ, দারাজ ও এডিএন।

সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সফল এই আয়োজন নিউইয়র্কে বসবাসরত পাঁচ লাখ বাঙালির মাথা উঁচু করেছে। তাই অনেক বাঙালি কনসার্ট শেষে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে থেকে বের হয়ে মধ্য ম্যানহাটনে গলা ছেড়ে স্লোগান দিয়েছে জয় বাংলা বলে।

এমআরএম/এএসএম

বিজ্ঞাপন