ফিনল্যান্ডের সুখ আর নিঃসঙ্গতার গল্প

আজ শোনাবো ফিনল্যান্ডের সুখ আর নিঃসঙ্গতা: উন্নত জীবনের ছায়াতলে লুকিয়ে থাকা অশ্রুবিন্দুর গল্প। আজকের আলোচনাটি একটু ব্যতিক্রমধর্মী। এমন একটি দেশের কথা বলবো, যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে সাতবার পরপর স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে—সেই ফিনল্যান্ড। এই ‘সুখী দেশ’-এর তকমা শুনলে মনে হতে পারে, এখানে বুঝি প্রতিটি মানুষই হাসিমুখে জীবনযাপন করে, দুঃখ-কষ্ট শব্দগুলো একেবারেই অচেনা। কিন্তু বাস্তবতা কি সত্যিই এতটা সরল, এতটা নিখুঁত?
ফিনল্যান্ডকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় কিছু নির্দিষ্ট সূচকের ভিত্তিতে—যেমন নাগরিকদের মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, খাদ্য—এ সূচকগুলোর প্রতিটিতেই ফিনল্যান্ড অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। এখানে কেউ না খেয়ে মারা যায় না, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করে না, শীতে রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে হয় না কিংবা শিশুদের লেখাপড়ার খরচ নিয়ে কেউ উদ্বিগ্ন থাকে না।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
শিক্ষা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্তও। স্বাস্থ্যসেবা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রদান করা হয়। যদি আপনার চাকরি না থাকে, সরকার সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা দেয়, যাতে অন্ততপক্ষে আপনার পরিবারের ন্যূনতম জীবনধারণ সম্ভব হয়। আপনার সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ সরকার দেয়। আপনি যদি কর্মক্ষম না থাকেন, রাষ্ট্র আপনার জীবনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। এ কারণেই তো বলা হয়, ফিনল্যান্ড একটি ‘সুখী দেশ’।
কিন্তু প্রশ্নটা হলো—সুখ কি শুধুই রাষ্ট্রীয় সেবা? শুধু কি খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান আর শিক্ষা পেলেই মানুষ সত্যিকার অর্থে সুখী হয়?
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
এখানেই এসে পড়ে ফিনল্যান্ডের এক ভিন্নতর, অদৃশ্য কিন্তু গভীর বাস্তবতা। দেশটি একদিকে যেমন উন্নত সামাজিক নিরাপত্তা দিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশকে পথ দেখায়, ঠিক তেমনই এটিও বিশ্বের অন্যতম উচ্চ আত্মহত্যার হারের দেশ। আত্মহত্যা—একটি শব্দ, যা প্রতিটি উন্নত দেশের নীরব অন্ধকার রূপ।
বিজ্ঞাপন
ফিনল্যান্ডে বছরে প্রায় আট মাস শীত। চারপাশে তুষার, ধূসরতা, নিঃস্তব্ধতা। মানুষ ঘরের বাইরে কম বের হয়, পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ হয় না, আলাপচারিতা কম হয়। এখানে ‘প্রাইভেসি’ শব্দটি শুধু একটি সামাজিক রীতি নয়, একপ্রকার অন্তর্মুখী জীবনের অনিবার্যতা। আপনি আপনার ঘরের মধ্যে একা বসে আছেন, বাইরের পৃথিবীকে যেন দূরের কোনো এক গ্রহের মতো মনে হয়। এ নিঃসঙ্গতা ধীরে ধীরে রূপ নেয় বিষণ্ণতায় আর বিষণ্ণতা অনেক সময় নিয়ে যায় আত্মধ্বংসের পথে।
রাষ্ট্র তো আপনাকে আশ্রয় দিয়েছে, শিক্ষা দিয়েছে, চিকিৎসা দিয়েছে। কিন্তু আপনি যদি একা থাকেন, আপনার যদি বন্ধু না থাকে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন, যদি কোনো ভালোবাসার মানুষ না থাকে পাশে, যদি আপনি কারো কাছে নিজেকে উজাড় করে প্রকাশ করতে না পারেন, তবে সেই নিঃসঙ্গতা আপনাকে ভেতর থেকে গিলে খেতে শুরু করে। আপনার বাবা-মায়ের সঙ্গে, ভাই-বোন, স্ত্রী বা সন্তানের সঙ্গে যদি সম্পর্ক জটিল হয়ে যায়, সেই যন্ত্রণা তো আর কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এসে সমাধান করতে পারবে না।
এটা কোনো রাষ্ট্রের ব্যর্থতা নয়। বরং এটিই মানুষের বাস্তবতা—মানুষ শুধু খাবার খেয়ে বাঁচে না, মানুষ বাঁচে সম্পর্ক, সাহচর্য, ভালোবাসা আর মমতার পরশে। কোনো মানুষের জীবনে যদি সেই জৈবিক চাহিদার বাইরের আবেগিক চাহিদাগুলো অপূর্ণ থেকে যায়, তবে সে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে আর একসময় হয়তো সে চলে যায় এমন এক পর্যায়ে, যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না।
বিজ্ঞাপন
তাই ফিনল্যান্ডের মতো একটি দেশ, যাকে আমরা বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ‘সুখী দেশ’ বলি, তার চিত্র এতটাও সাদামাটা নয়। একদিকে উন্নত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, অপরদিকে ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতা, বিষণ্ণতা, আত্মহননের প্রবণতা। সুখ আর দুঃখ এখানে একে অপরের পাশাপাশি বসবাস করে। যেন দিন আর রাত—একটি আরেকটিকে ছায়া দিয়ে ধারণ করে।
আপনি যদি ফিনল্যান্ডে থাকেন, হয়তো দেখবেন, মানুষের জীবনে সমস্যা নেই এমন নয়। তাদের সমস্যা আছে কিন্তু তা রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে—মানসিক সমস্যা, সম্পর্কের সমস্যা, আত্মপরিচয়ের সংকট, জীবনের অর্থহীনতা নিয়ে উদ্বেগ। এ সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত হয় দীর্ঘ শীতকাল, কম সূর্য আলো, সীমিত সামাজিক মেলামেশা—যা আরও বেশি করে একাকিত্ব বাড়িয়ে তোলে।
বিজ্ঞাপন
এই একাকিত্ব কি তাহলে শুধু উন্নত দেশে? না, তা নয়। আমাদের মতো দেশে—বাংলাদেশ বা ভারতেও তো আত্মহত্যা হয়। অথচ এখানে তো মানুষ কথা বলে, মিশে চলে, প্রতিবেশীদের সাথে আড্ডা দেয়, চায়ের দোকানে গরম তর্ক চলে। এত আলাপচারিতা, এত মানুষ থাকা সত্ত্বেও কেন মানুষ আত্মহত্যা করে?
আসলে মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যা সব সমাজেই থাকে, সব দেশে থাকে। কেউ প্রেমে ব্যর্থ হয়, কেউ সংসারে ঠকে, কেউ আর্থিক বিপর্যয়ে পড়ে, কেউ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবে আমাদের দেশে এক বড় পার্থক্য হলো—আমরা অনেক বেশি সামাজিক। আমরা কথা বলি, অন্যের দুঃখ শুনি, সহানুভূতির জায়গা তৈরি হয়। এ বিষয়গুলো অনেক সময় কাউকে জীবনের গভীর অন্ধকার থেকে ফিরিয়ে আনে।
তবুও আত্মহত্যা আমাদের সমাজেও হচ্ছে, সেটা সত্যি। সুখ এখানে এক আপেক্ষিক ধারণা। যেমন প্রচুর ধনী মানুষ আছে, যারা নিঃসঙ্গ। তাদের আছে বিলাসবহুল জীবন কিন্তু নেই শান্তি। মাইকেল জ্যাকসনের ছিল অর্থ, খ্যাতি, বিশ্বজয়—কিন্তু ছিল না হৃদয়ের সুখ। মেরিলিন মনরোর ছিল রূপ, স্টারডম কিন্তু ছিল না অভ্যন্তরীণ শান্তি। তাই তারা একদিন চলে গেলেন নেশায়, বিষাদে, নিঃসঙ্গতায়। উইটনি উইস্টোনের মতো বিখ্যাত গায়িকাও আত্মহত্যা করেন।
বিজ্ঞাপন
ফিনল্যান্ডের এই বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ফিনল্যান্ড শুধু সুখী দেশের প্রতীক নয়—এটি একটি আয়না, যেখানে দেখা যায় আধুনিক জীবনের আরেক বাস্তবতা। উন্নয়ন মানেই শুধু প্রযুক্তি আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়; উন্নয়ন মানে মানুষের মানসিক চাহিদা, ভালোবাসা, সম্পর্ক এবং জীবনের প্রতি গভীর উপলব্ধির দিকেও নজর দেওয়া।
আমরা যদি সত্যিই সুখী দেশ গড়তে চাই—তবে তা শুধু অবকাঠামো দিয়ে নয়, হৃদয়ের অবকাঠামো দিয়েও গড়া দরকার। একাকিত্ব যেন মানুষের নীরব মৃত্যু না হয়ে দাঁড়ায়—এ চেষ্টাটাই হোক আমাদের পরবর্তী সভ্যতার লক্ষ্য।
এসইউ/জেআইএম
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন