ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

চোখ জুড়াবে শ্রীলঙ্কার বিস্ময়কর ‘সিগিরিয়া’

ভ্রমণ ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:১৮ পিএম, ১৪ মার্চ ২০২২

শাকিল বিন মুশতাক

বিস্তৃত সবুজে পেখম মেলা ময়ুর। আমাদের দেখে সবকটা পেখম মেলে ধরে যেন স্বাগত জানালো তার সাম্রাজ্যে। দেখা গেল গাছবাড়ি বা ট্রি হাউজ। গাছের ওপর তৈরি ছোট ছোট এসব গাছবাড়িতে বসে ক্ষেত পাহারা দেন চাষিরা। আওয়ার বিগেস্ট অ্যাসেট ইন শ্রীলঙ্কা ইজ ‘স্মাইল’, হেসেই জানালেন শ্রীলঙ্কান ট্যুর গাইড সুধেশ উইকরামারাত্না।

আগের দিনের হেরিটেন্স কান্ডালামা রিসোর্টে ছেড়ে ছুটে চলেছি সিগিরিয়ার পথে। সিগিরিয়া কি? কোথায়? এখানে গিয়ে লাভ কি? আসছি সেসব কথায়। তবে তার আগে একটু শুরুর কথা সেরে নেই। শ্রীলঙ্কান ট্যুরিজম অথরিটির দেওয়া শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ২০ আসনের বাসটিতে ৬ জন ভ্রামণিক বেশ আরামেই গা ছেড়ে দিয়ে বসেছি। এর মাঝে দুজন নামী আলোকচিত্রী রয়েছেন। আবীর আবদুল্লাহ ও আজিম খান রনি।

অন্যদের মধ্যে আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। বাইসাইকেলে বিশ্বের অনেকগুলো দেশ ঘুরে ফেলা মানুষটির নেতৃত্বেই ঘুরতে আসা। সঙ্গে আছেন জ্যেষ্ঠ গণমাধ্যমকর্মী জাকারিয়া মণ্ডল। চুপচাপ নিবিষ্ট মনে দেখে নেন সবকিছু, মেপেও নেন বোধহয়। আরও আছেন সোনালী আঁশ নিয়ে কাজ করা এস এম সাজ্জাদ হোসেন। চালান নিজের একটি ব্লগ সাইট। সমানতালে চালান মোবাইল আর ডিএসএলআরও।

jagonews24

সবার সঙ্গে আছি আমি এই সামান্য লেখক। বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে শ্রীলঙ্কার পর্যটন মন্ত্রণালয় ট্যুর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) এর ১০ জন ও বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের ৬ জন সদস্যের জন্য এই ফ্যাম ট্রিপের আয়োজন করে।

ফ্যাম ট্রিপ মানে হলো ফ্যামিলিয়ারাইজেশন ট্রিপ বা পরিচিতি ভ্রমণ। সৌজন্য টিকিটে বিমান সেবা দিয়েছে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস। সঙ্গে সার্বক্ষণিক তৎপর শ্রীলঙ্কান টুরিজম অথরিটির কর্মকর্তা। আর পুরো আয়োজনের পেছনের কারিগর হিসেবে তত্ত্বাবধায়নে থেকেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রদূত ও তার দূতাবাসের কর্মীরা।

৭ রাত ৮ দিনের ভ্রমণের প্রথম দিনটি পেরিয়ে দ্বিতীয় দিনে সিগিরিয়ার পথে ধাবমান আমাদের ছোট্ট দলটি। যে স্থানটিতে ছিলাম অর্থাৎ কান্ডালামা, সেই কান্ডালামা থেকে সিগিরিয়ার দূরত্ব প্রায় সাড়ে ১২ কিলোমিটার। আগের দিন ছিলাম মূলত কান্ডালামা হেরিটেন্স রিসোর্টে। ওটা নিজেই এক পর্যটনকেন্দ্র ছিল। আর এখনকার গন্তব্য এক দারুণ প্রত্নতত্ত্ব। এটি মূলত একটি প্রাচীন পাথরের দূর্গ।

jagonews24

কেন্দ্রীয় প্রদেশের ডাম্বুলা শহরের কাছেই উত্তর মাতালে জেলায় অবস্থিত এই দূর্গ দেখতে প্রতিদিন ভীড় করেন অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক। সংখ্যাটা দিনে ১৫০০ থেকে ২০০০ বলে জানা যায়। ইউনেস্কো স্থানটিকে কেবল স্বীকৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তকমা দিয়েছে বিশ্বের ৮ম আশ্চর্যের। প্রায় ৫৯০ ফুট উঁচু শিলার একটি বিশাল স্তম্ভ এটির মূল আকর্ষণ।

শ্রীলঙ্কার প্রাচীন উপখ্যান কুলাভামসা অনুসারে, এলাকাটি ছিল একটি বিশাল বন। এক সময় ঝড় আর ভূমিধসের পরে এটি একটি পাহাড়ে পরিণত হয়। এসময় রাজা কশ্যপ (৪৭৭-৪৯৫ খ্রিস্টাব্দ) তার নতুন রাজধানীর জন্য নির্বাচিত করেন এই সিগিরিয়াকে। তিনি এই পাথরের উপরে তার প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন ও এর আশপাশে রঙিন ফ্রেস্কো (এক ধরনের দেয়ালচিত্র) দিয়ে সাজিয়েছিলেন।

বিশাল শিলাটির প্রায় অর্ধেক উপরে ছোট একটি মালভূমিতে তিনি নির্মাণ করেন প্রকাণ্ড একটি সিংহের আকারে প্রবেশদ্বার। সিংহের এই কাঠামো থেকেই নাম হয় সিগিরিয়া। শব্দের ব্যুৎপত্তি খুঁজতে গেলে বলতে হয় প্রথমে সিনহাপুড়া থেকে সিনহাগিড়ি। এরপর সিগিরিয়া।

jagonews24

রাজার মৃত্যুর পর রাজধানী ও রাজপ্রাসাদ পরিত্যক্ত হয়। এটি ১৪ শতক পর্যন্ত বৌদ্ধ মঠ হিসেবে ব্যবহৃত হত। এটি প্রাচীন নগর পরিকল্পনার সেরা সংরক্ষিত উদাহরণগুলির মধ্যে একটি। প্রবেশের আগেই দেখা বাংলাদেশের মেয়ে ওয়ার্দা সাইয়েদার সঙ্গে। তিনিও শ্রীলঙ্কা ঘুরছেন। এই পর্যটক এরই মধ্যে নানা দেশ ঘুরেছেন।

সফরের শেষের আগের দিনে আমাদের দলে অনানুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হন ওয়ার্দা। দেশের একটি মেয়ের দেখা শ্রীলঙ্কায় এমনভাবে হয়ে যাবে তা কিঞ্চিৎ বিস্ময়কর তো বটেই তবে আনন্দেরও। সিঁড়ি বেয়ে ওঠা থেকে শুরু করে একদম চূড়ায় পৌঁছে আবার নামা এই দুই দিকের যাত্রাই সমান রোমাঞ্চকর। সরু সিঁড়ি কোথাও কোথাও অনেকখানি খাড়া।

অথচ কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, হৈচৈ নেই, নেই কোনো ময়লা আবর্জনাও। শ্রীলঙ্কান চেহারাগুলোর ভীড়ে প্রচুর শেতাঙ্গ পর্যটক চোখে পরলো। প্রত্যেকেরই চোখে একটি অভিন্ন অভিব্যক্তি শ্রদ্ধা। বিষয়টি ভালো লাগলো। একেক পর্যটন কেন্দ্রের একেকরকম বৈশিষ্ট থাকে। পর্যটকরাও সেসব জেনেই স্থানগুলো পরিদর্শন করেন। কোনোটার ভাব গাম্ভীর্য এক রকম তো আরেক স্থান যেন হৈহুল্লোর করে বেড়ানোর জন্যই তৈরি।

jagonews24

সিগিরিয়ার অপার্থিব মৌন সৌন্দর্য যেন কেবলই নিরবে উপভোগের জন্য তৈরি। প্রকৃতি আর অসীম কোনো শক্তির কাছে নিজেকে সমপর্নের জন্য এ যেন এক প্রস্তুতকেন্দ্র। উপরে উঠতে উঠতে দেখা মিলল এক দম্পতির শিশু ফোপাঁচ্ছে। বেচারা উপরে উঠে এখন নামতে গিয়ে ক্লান্ত। তবু কোনো চিৎকার নেই। যারা উপরে উঠছেন তাদের চেহারায় কিছু একটা পাওয়ার আকাঙ্খা আর যারা নামছেন তাদের মুখশ্রীতে প্রাপ্তির সন্তোষচিহ্ন।

উপরে ওঠার দীর্ঘ যাত্রার প্রতিপদে নানা অভিজ্ঞতা। এক পর্যায়ে হাতের বামে হালকা লালচে দেওয়াল দেখিয়ে গাইড সুধেশ জানালেন এটি মিরর ওয়াল বা আয়না দেওয়াল। রীতিমতো মোম ঘষে চকচকে করে চেহারা দেখার উপযোগী করে আয়নার মতো রূপ দিয়েছিলেন রাজা কশ্যপ এই দেওয়ালকে। এখন সেই জেল্লা আর অবশিষ্ট না থাকলেও তথ্যটুকু চমকে দেওয়ার মতো ছিল। রোদে চোখেমুখে শর্ষে ফুল দেখছিলাম বলেই হয়তো সত্যি সত্যি আয়না দেওয়ালে নিজের প্রতিবিম্ভ দেখতে পেলাম!

একদম চূড়ায় পৌঁছে মনে হলো এক পার্থিবতার বাইরের জগত। কেউ যেমন ছবি তুলছেন, কেউ বা আবার একলাই নিরবে ভেজা চোখে বসে আছেন কোনো এক কোনে। কোথাও যুগলদের গা ঘেঁষে বসে জীবনের অন্যতম মুহূর্তের সময় উপভোগ করা তো আরেক কোনায় ধ্যানমগ্নতার দৃষ্টি নিয়ে বসে আছেন কেউ।

 

উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম সব দিকেই উপর থেকে কেবল সবুজ চোখে পরলো। এ জায়গার বর্ণনা বুঝি কেবল রবী ঠাকুরই দিতে পারতেন- দূর বৎসর পানে- ধ্যানে চাই যদদুর/ দেখি লুকোচুরি খেলে মেঘ আর রোদদুর।

সিগিরিয়ায় ১২৫০ ধাপের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা হলেও শেষ অবধি ফ্রেসকো দেখা হলো না। তবে তথ্য সংগ্রহ করলাম। খানিকটা ভারতের অজন্তা ইলোরা ধরনের বিষয়। জন স্টিল ছিলেন এক ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ। তার লেখা থেকে জানা যায়, ফ্রেসকোর পুরো স্থানটিকে একটি বৃহৎ ছবির গ্যালারি বলা চলে।

আবার বিশ্বের সবচেয়ে বড় অঙ্কিত শিল্পও বলা যেতে পারে। শিলার পশ্চিম দিককার বেশ বড় অংশ জুড়ে এই আঁকার খেলা। আকারে ১৪০ মিটার দীর্ঘ আর ৪০ মিটার উঁচু। এই দেওয়াল চিত্রে ৫০০ নারীর প্রতিকৃতি রয়েছে। এসব নারীদের প্রকৃত পরিচয় জানা না গেলেও ধারনা করা হয় তারাই ছিলেন রাজার রক্ষিতা। আবার কারও কারও ধারণা তারা কোনো ধরনের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার অংশ ছিলেন।

নেমে আসার সময় মনে হয়েছে কোনো এক অজ্ঞাত সুখানুভূতি নিয়ে ফিরে আসছি। অপার্থিব সিগিরিয়ায় স্বাগত সবাইকে। এর নিচের বাগান বিলাস, সুনিপুন নগর পরিকল্পনা আর উন্নত রুচির ছাপ মনে দাগ ফেলবে তা নিশ্চিতভাবেই বলে দিতে পারি। আরেকটি বিষয়, এখানকার কাঠবেড়ালিরা বেশ বন্ধুভাবাপন্ন। প্রকৃতির মাঝে ওরাই আপনাকে বুঝিয়ে দেবে আসলে এই প্রাণীরা নয়, আপনি কিংবা আমিই এখানকার বহিরাগত।

পরিশেষে আগ্রহীদের জানিয়ে রাখি, এই স্থান ভ্রমণে টিকিট কাটা বাধ্যতামূলক। বিদেশি ও দেশিদের জন্য টিকিটের মূল্যে আকাশপাতাল ফারাক। আর যেহেতু টিকিটের মূল্য অপরিবর্তনশীল সেহেতু নেট ঘেঁটে আগেই মূল্য জেনে যাবেন। আর অবশ্যই ময়লা নির্দিষ্ট ঝুড়িতে ফেলবেন।

আলোকচিত্র: আজিম খান রনি

জেএমএস/জিকেএস