ঈদের আনন্দ, ঈদের খুশির মর্মার্থ সুগভীর এবং বিস্তৃত

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৩৪ পিএম, ১১ এপ্রিল ২০২৪

মো. আকতারুল ইসলাম

ছোট বেলায় আমরা পাঠ্য বইয়ে পড়েছিলাম, আজ ঈদ। মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দ। পথে পথে ছেলেমেয়েদের কলরব। ঈদের নামাজ শেষে সবাই নিজ নিজ বাড়ি চলে যাচ্ছেন, তখন নবী করিম (সাঃ) দেখলেন ঈদগাহের এক কোনে বসে একটি শিশু কাঁদছে। কাছে গিয়ে নবীজী শিশুটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কাঁদছো কেন? শিশুটি বললো আমার বাবা-মা নেই, আজ ঈদ আমি কোথায় যাবো? আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর মন ডুকরে কেঁদে উঠলো।

তিনি এতিম ছেলেটিকে সঙ্গে করে বাড়ি গিয়ে মা আয়েশা (রা.) কে বললেন, তোমার জন্য ঈদ উপহার নিয়ে এসেছি। বাড়িতে নিয়ে ছেলেটিকে গোসল করিয়ে ভালো পোশাক পরিয়ে দিয়ে খেতে দিয়ে নবীজি বললেন, আজ থেকে আমরাই তোমার বাবা-মা। বিষয়টি মানবজাতির মুক্তির দিশারী আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর মহানুভবতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হিসেবে ছোট বেলায় সবারই মনে দাগ কেটে যায়।

সবারই আজীবন মনে থাকে। আমরা প্রিয় রসুলের উম্মত হিসেবে তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে যায়। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট অসংখ্য লোককে শেয়ার করতে দেখলাম। মাদরাসার এতিম শিশুদের নিয়ে একটি পোস্ট। পোস্টটি ছিল এমন।

রোজার শেষ দিকে বাংলাদেশের কওমি/হাফিজি মাদরাসাগুলোতে এক করুণ দৃশ্য দেখা যায়। সাধারণত ২৫ রোজা থেকে মাদরাসাগুলো ছুটি হতে থাকে। বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রীর অভিভাবক এসে বাচ্চাদের বাসায় নিয়ে যায়। কিন্তু একদল বাচ্চাকে নেওয়ার মতো কেউ থাকে না। এদের কারো বাবা-মা নেই, কারো বাবা নেই মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। অনেকের মা নেই, বাবা বাচ্চার খোঁজ রাখে না। খুব বেশি ভাগ্যবান হলে কারো কারো মামা খালা চাচা এসে কাউকে কাউকে নিয়ে যায়।

বাকিরা সারাদিন কান্না করে। তারা জানে তাদের কেউ নিতে আসবে না। তারা সারা বছর কাঁদে না। কিন্তু যখন সহপাঠীদের সবাই বাসায় নিয়ে যায় অথচ তাদের কেউ নিতে আসে না তখন তাদের দুঃখ শুরু হয়ে যায়। মৃত মা বাবার ওপর তাদের অভিমান সৃষ্টি হয়- কেন তারা তাদের দুনিয়ায় রেখে এই বয়সে মারা গেলো? তারা কি আর কিছুটা দিন বেঁচে থাকতে পারত না? মা বাবা বেঁচে নাই তো কী হইছে? মামা চাচারা কেউ তাদের নিতে আসতে পারতো? মা বেঁচে থাকতে মামারা কত আদর করত! বাবা বেঁচে থাকতে চাচারা কত আদর করতো! এই বয়সেই তারা দুনিয়ার একটা নিষ্ঠুর চেহারা দেখেছে।

আমরা রাজধানী শহরে বসবাস করি। আমাদের মধ্যে যারা প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রজন্মের শহুরে, আমাদের সবারই শেকড় গ্রামে। ঈদ আসলে আমাদের সবারই স্বপ্ন বাড়ি যায়। সবাই মনে মনে গেয়ে উঠি ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার’। এজন্যই গণমাধ্যমগুলো ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই ধারণাগত সংবাদ প্রকাশ করে এবারের ঈদে এতো লোক ঢাকা ছাড়বে। ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই সংবাদ হতে থাকে রেলওয়ে স্টেশন, বাসস্ট্যান্ডে নাড়ির টানে ঘরমুখো মানুষের ভিড় বাড়ছে।

ঈদের দু’একদিন আগে দেখা যায় ট্রেন, বাস, রাস্তায় দেখা যায় ঘরমুখো মানুষের উপচেপড়া ভীড়। গণমাধ্যমের বদৌলতে সারাদেশের মানুষের সবারই দৃষ্টি চলে যায় ট্রেনের ছাদ, বাসস্ট্যান্ড এবং সড়ক-মহাসড়কে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সংবাদে দেখি ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে দীর্ঘ ২৫ কিলোমিটার যানজট, ট্রেনের ভিতরে এবং ছাদে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। এই দৃশ্য কারো মনেই কষ্টের রেখা টানে না। কারণ এই কষ্টের কয়েকঘণ্টা পরেই ঐ লোকটি পাবে তার আসল ঠিকানা।

পাবে তার নাড়ি পোতা মাটি। যাত্রাপথের এই কষ্টটাও ঈদ আনন্দেরই অংশ। গ্রামে আপনজনের সানিধ্যে পথের যত কষ্ট তুচ্ছ হয়ে যায়। আপনজনের কাছে পৌঁছালে ঈদ আনন্দ সার্থক হয়ে উঠে। আমাদের মতো গ্রাম থেকে শহরে যাওয়া প্রথম প্রজন্মের গ্রামের প্রতি, গ্রামের মানুষের প্রতি, এলাকার প্রাণ প্রকৃতির প্রতি আবেগটা অনেক বেশি ক্রিয়াশীল। কারণ আমাদের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে ছোট বেলার ঈদ স্মৃতি। ছোট বেলার ঈদের সুখানুভূতি।

এই আমার নিজের কথা বলি- ৮০ এর দশকে গ্রামে বেড়ে উঠা সবার ছোট বেলা ঈদ আনন্দের সাদৃশ্য পাওয়া যাবে। ৮০ দশকের প্রথমার্ধে আমরা যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে আসিনি তখন গ্রামের অধিকাংশ ছেলেদের পড়ালেখার পাশাপাশি পুরোদমে সংসারের কাজে সহযোগিতা। কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে গরুর ঘাস কাটা, গরুকে খাওয়ানো, আইল চরানো অবধারিত ছিলো।

রোজার ঈদে আমাদের এলাকার প্রধান উৎসব বলি আর বিনোদন বলি প্রায় ৫’শ বছর থেকে চলে আসা রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় হযরত শাহ্দৌলা (র:) এর মাজার শরীফ এবং ১৫২৩ সালে হযরত নসরত শাহ এর আমলে আমলে নির্মিত বাঘা মসজিদকে ঘিরে সপ্তাহব্যাপী ঐতিহাসিক বাঘার মেলা ছিলো একমাত্র অনুসঙ্গ। মেলাকে কেন্দ্র করে আমরা প্রস্তুতি নিতাম, দিনে এক টাকা দুই টাকা করে টাকা ৪০/৫০ কেউ বা শত টাকা গোছাতাম। তারপর প্রতীক্ষার পালা শেষ ঈদের দিন নামাজ পড়ে সিন্নি খেয়েই গ্রামের পর গ্রাম থেকে সবাই মেলামুখী।

রাজশাহী, নাটোর, পাবনা বগুড়া, নওগার লক্ষ লোক চলে আসে বাঘার মেলায়। এখনও আসে। এবারও আসবে। তবে তখন আমরা যেতাম পায়ে হেঁটে। আমাদের ছোট বেলায় মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে লাখ লাখ মানুষ জমায়েত হতো বাঘার মেলায়। কারণ তখন কোন রাস্তাই পাকা ছিলো না থানা পর্যায়ে থানা এলাকায় সামান্য জায়গা পাকা ছিলো। সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচির বদৌলতে আজ বানেশ্বর থেকে চারঘাট, বাঘা, লালপুর, ঈশ্বরদী যে আঞ্চলিক মহাসড়ক হয়েছে এ রাস্তাই পাকা ছিলো না ছিল ইট বিছানো হেয়ারিংবোম।

আর আজ এমন কোনো গ্রাম যে গ্রামের রাস্তা পাকা হয়নি। এমন কোনো গ্রাম পাওয়া যাবে না যে গ্রামে ১০টি ব্যাটারি চালিত অটো নেই, নেই দু’ চারটে সিএনজি। আজ ৩০/৪০ বছর পর ছোট বেলার ঈদের সমস্ত স্মৃতিই ভীড় করছে। গ্রামের ছোট বেলার ঈদ স্মৃতি কিন্তু সবারই একই রকম। সে সময়ের নির্মল ঈদ আনন্দের স্মৃতি বর্তমান প্রজন্ম ভাবতেই পারবে না। স্মৃতি মোড়ানো নাড়ি পোতা গ্রাম ছাড়া ঈদ সত্যিই ভাবা যায় না। আমরা যারা রাজধানী শহরে থাকি ঈদের ছুটির সবাই সবাইকে জিজ্ঞেস করি বাড়ি কবে যাবেন।

এই শহরের বড় একটা অংশ বুকের ভেতর জমাট বাধা জগদ্দল পাথরের মতো দুঃখের পাথরকে আড়াল করে বলেন, কোথায় যাবো ভাই? বাবা-মা বেঁচে থাকতে নিয়োমিত যেতাম, বাবা-মা নেই গ্রামে গিয়ে সেই আনন্দটা পায় না। নিজে গ্রামে উঠার মতো ঘরও নেই। কই যাবো? এমন কথা শুনলে হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে যায়। আবেগে সবারই গলা ধরে উঠে। বুকের ভিতর হুহু করে উঠে। একটা সময় গ্রামই ছিল যাদের প্রাণ ঈদে সেই মানুষটি যদি বলেন কোথায় যাবো? সে মানুষটির কাছে সত্যিই ঈদ আর থাকে না, থাকে শুধু পারিবারিক দায়বদ্ধতা আর আনুষ্ঠানিকতা।

এমন লোকটির জন্য বিনীত অনুরোধ- যে গ্রামের আপনার ছোট বেলার ঈদের সুখ স্মৃতিতে ধুলার আস্তরণ পড়েছে। যে গ্রামে আপনার বাবা-মা চির নিদ্রায় শুয়ে আছেন। সে গ্রাম আপনার। সে গ্রামের প্রতিটি ধুলি কণা ঈদে আপনার আগমন প্রত্যাশা করে। বাবা-মা কবরে শুয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন। আপনি অন্তত ঈদের দিন তাদের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের জন্য দোয়া করেন। আর যাদের বাবা-মা বেঁচে আছেন তাদের বাবা-মার সাথে ঈদের বিকল্প থাকতে পারে না।

মহান আল্লাহ আপনার বাবা-মার জন্য আপনার দোয়া না শুনে পারবেন না। আপনি আজ শহুরে, গ্রামে নিজের একটা ঠিকানা থাকলে ভালো। না থাকলে আপনার আপন ভাই বোনদের সাথে সুসম্পর্ক রাখুন। আপন ভাই বোন না থাক, চাচাতো-মামাতো, ফুফাতো ভাই বোন কাউকে না কাউকে পাবেন। তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব। রাসুল (সা:) বলেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।

আমার গ্রামে সবাই আমার আত্মীয়। গ্রামের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে শহরে থেকে ঈদের নামাজ আর ঘরবন্দি আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে হয়তো দিনটি পার হবে ঈদ মানে যে আনন্দ, ঈদ মানে যে খুশি সেটি আমাদের কাছে ধরা দেবে না। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, আপনাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনটি ফরজ করা হয়েছিলো পূর্ববর্তীদের ওপর। আল্লাহ নিজেই রোজার পুরস্কার দেবেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.)–র কাছ থেকে হাদিসটিতে জানা যায়। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্যই—রোজা ছাড়া। এটা আমার জন্য, আমি নিজেই এর পুরস্কার দেব।

আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞান থেকে যেটুকু বুঝি একমাস সিয়াম সাধনার পর মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের যে খুশি, যে আনন্দ, তাই ঈদ। ঈদ-উল ফিতর। তাই ঈদের আনন্দ সাধারণ কোন আনন্দ নয়, এ আনন্দ, এ খুশির মর্মার্থ সুগভীর এবং সুবিস্তৃত। গ্রামের সকল আত্মীয় স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক রেখে ঈদ উদযাপন করি। আমরা সকলে মিলে উদযাপন করি সবার সাথে শেয়ার করি। উপভোগ করি।

ইসলামের সুমহান আদর্শ, আমাদের প্রিয় নবী করিমের নির্দেশনা আর দেখানো পথে প্রতিষ্ঠিত থেকে সেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টের সূত্র ধরে বলি, এই ঈদেই চেষ্টা করি কাছাকাছি এতিমখানায় যাওয়ার, কয়জন বাচ্চা ঈদে বাড়ি যায়নি তাদের খোঁজ নিই, চেষ্টা করি আমার পাশের গরীব লোকটির খোঁজ খবর নেওয়ার।

সামর্থ্য অনুযায়ী যা পারি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের সকলকে কল্যাণমূলক কাজে অগ্রসর হওয়ার মধ্য দিয়ে তার (আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার) সান্নিধ্য লাভের তৌফিক দান করুন। এটিই হবে প্রকৃত ঈদ। এ আনন্দ নির্মল সমাজের সকলের সমন্বিত। ধনী-গরীব, এতিম-মিসকিন, বড়-ছোট সবার। আমরা ঈদে সকলে মিলিত হই প্রাণের পবিত্র বন্ধনে। ঈদ আনন্দ হোক প্রাণবন্ত, অকৃত্রিম। সবাই একসাথে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি, ‘ঈদ মোবারক’।

লেখক: উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) দুর্নীতি দমন কমিশন

এমআরএম/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।