৩ ঘণ্টার ভিডিও কনফারেন্সে যা বললেন প্রধানমন্ত্রী
করোনাভাইরাস প্রতিরোধকল্পে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ১৩টি জেলার প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেছেন।
মঙ্গলবার সকাল ১০টায় গণভবন থেকে এই ভিডিও কনফারেন্স শুরু হয়। চলে দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস।
সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যন্ত দরিদ্র ও বেকার পরিবারগুলোর তালিকা করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্যসামগ্রী বিতরণের নির্দেশ নেন। চলতি মাসে করোনাভাইরাসের প্রভাব আরও বাড়তে পারে আশঙ্কা করে তিনি সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
একখণ্ড জমিও যেন অনাবাদি না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে কেউ দুর্নীতিতে জড়ালে তাদের কঠোর সাজা দেয়া, কেউ আক্রান্ত হলে অচ্ছুত হয়ে গেছে এমন মানসিকতা পরিহার করা, তাকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখা, অনেক ক্ষেত্রে মানুষ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসক পাচ্ছেন না, সেবা পাচ্ছেন না কেন তা দেখা, করোনা সংকটে কাজ করা চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সবার বিমার ব্যবস্থা করা, করোনায় চিকিৎসাসেবা দানকারীদের ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা স্বাস্থ্য বীমা দেয়ার প্রতিশ্রুতি, চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট কেউ আক্রান্ত হলে দ্বিগুণ এবং কেউ মারা গেলে তার পরিবার ৫ গুণ অর্থ সহায়তা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি, চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট যারা জীবন বাজি রেখে করোনার চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন তাদের পুরস্কৃত করা, পালিয়ে থাকা ডাক্তারদের তালিকা করে ব্যবস্থা নেয়াসহ বিভিন্ন নির্দেশনা ও প্রতিশ্রতি দেন প্রধানমন্ত্রী।
ভিডিও কনফারেন্সের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন হবিগঞ্জ জেলার প্রতিনিধিদের সঙ্গে। এতে জেলা প্রশাসক, সংসদ সদস্য, সিভিল সার্জন, পুলিশ কর্মকর্তা, সেনা সদস্যসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন। হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক এই জেলার বর্তমান পরিস্থিতি ও ত্রাণ কার্যক্রমসহ বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। জনপ্রতিনিধিরাও কে কী করছেন, কোন কোন সংগঠন কাজ করছে তার বিস্তারিত বিবরণ দেন।
এরপর ভিডিও সংযোগ দেয়া হয় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক বেগম রাজিয়া সুলতানার কাছে। তিনি জেলার করোনাভাইরাস পরিস্থিতিসহ বিস্তারিত বিবরণ দেন। এ জেলার সংসদ সদস্য নেছার আহমেদ বক্তব্য দেন।
এরপর সংযোগ দেয়া হয় নোয়াখালী জেলার জেলা প্রশাসক তন্ময় দাসকে। তিনিও করোনা পরিস্থিতি ও ত্রাণসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের বিস্তারিত বিবরণ দেন। সেখানকার সিভিল সার্জন ডাক্তার মো. মমিনুর রহমান বক্তব্য দেন। প্রধানমন্ত্রী তার কাছ থেকে সেখানকার পরিস্থিতি ও চিকিৎসা ব্যবস্থার বিস্তারিত শোনেন।
এরপর সংযোগ দেয়া হয় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেনকে। সূচনা বক্তব্যে জেলার পরিস্থিতি বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি। এ অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির তার বক্তব্য তুলে ধরেন। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, চট্টগ্রাম যেহেতু লকডাউন করা হয়েছে, সেহেতু এই জেলায় কেউ যেন প্রবেশ করতে না পারে, আবার অন্য জেলায় যেন কেউ না যেতে পারে। আত্মীয়-স্বজনদেরও টেলিফোনে না আসা ও চট্টগ্রাম থেকে না যাওয়ার জন্য তিনি নির্দেশনা দেন।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, মসজিদে ভিড় না করে শবে বরাতের নামাজ যেন ঘরে আদায় করা হয়। আল্লাহকে ডাকলে যে কোনো স্থান থেকে ডাকা যায়। শবে বরাতের রাতে সবাই দোয়া করবেন, যেন আমরা করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাই।
এ ছাড়া মেয়র নাসিরের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, সামনে ডেঙ্গুর প্রকোপ আসছে. মশার উপদ্রব ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব যেন না হয়, সেজন্য আগে থেকেই সতর্ক থাকার জন্য তিনি মেয়রকে নির্দেশ দেন।
এ অনুষ্ঠানে শিক্ষাউপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান নওফেল উপস্থিত ছিলেন। খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসককে মাইক দেয়া হলে তিনি তার বক্তব্যে খাগড়াছড়ির পরিস্থিতি বিস্তারিত বর্ণনা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অঞ্চলে শিশুদের হামের প্রাদুর্ভাব কী জন্য ঘটেছে, তাদের হামের টিকা দেয়া হয় কি না, না দেয়া হলে কেন দেয়া হয় না, এগুলো বিস্তারিত জানতে চান। পরবর্তীতে সেখানে যেন হামের প্রাদুর্ভাব না ঘটে সেজন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তিনি নির্দেশ দেন ।
এরপর সংযোগ দেয়া হয় রাঙামাটি জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদের কাছে। সেখানে কোনো রোগী শনাক্ত না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী খুশি হন। সেখানকার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বক্তব্য দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেয়ারম্যানকে বলেন, আপনার এলাকায় কেউ যেন না খেয়ে জীবন যাপন না করে, সেগুলো লক্ষ্য রাখবেন। কেউ যেন গৃহহীন না থাকে, গৃহহীন থাকলে তাকে ঘর করে দেবেন।
এরপর সংযোগ দেয়া হয় বান্দরবান জেলার প্রশাসক তাজুল ইসলামকে। এই জেলার সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং, মেয়র ও একজন ডাক্তার বক্তব্য দেন। বীর বাহাদুর বলেন, আমাদের এলাকা বিশাল এলাকা । দূরে দূরে গ্রাম, দূরে দূরে পাড়া এটা সৃষ্টিকর্তার একটা কৃপা। এ কারণে এখানে করোনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। ছাত্র ও ছাত্রলীগের ছেলেমেয়েরা তাদের টিফিন থেকে পয়সা বাঁচিয়ে দরিদ্রদের সহযোগিতা করছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী তাদের ধন্যবাদ জানান এবং এই এপ্রিল মাসকে দেখেশুনে চলার জন্য তাদের নির্দেশ দেন ।
এরপর সংযোগ দেয়া হয় সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক আব্দুল আহাদকে। সেখানকার সাবেক সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আগামী সপ্তাহ থেকে এই অঞ্চলে ধান কাটা শুরু হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি ধান কাটার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিতে অনুরোধ করেন ।
এরপর সংযোগ দেয়া হয় ফেনী জেলা প্রশাসক অহেদুজ্জামানকে । সেখানকার সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী ছাড়াও একজন ডাক্তার ও পুলিশ সুপার বক্তব্য দেন।
সেখানকার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর সংযোগ দেয়া হয় কুমিল্লা জেলা প্রশাসককে। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কুমিল্লার করোনামুক্ত এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রণ বরাদ্দ আছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রীকে । প্রধানমন্ত্রী বলেন, কুমিল্লায় তো বড়লোক এবং শক্তিশালী লোক আছে, তারা যেন গরিব মানুষকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। আর দুধের উৎপাদন যেহেতু এলাকায় হয়, বাচ্চাদের এবং গরিব মানুষদের দুধ সরবরাহ করে তাদের পুষ্টি জোগাতে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এপ্রিল মাস কাটাতে পারলে আর কোনো সমস্যা হবে না বলে তিনি কুমিল্লাবাসীসহ দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন।
এরপর সংযোগ দেয়া হয় চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মাজেদুর রহমানকে। তিনি চাঁদপুরের করোনা পরিস্থিতি ও ত্রাণ তৎপরতার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দশজনকে করোনার পরীক্ষা করা হয়েছে, কারোরই করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়নি। সুতরাং এই জেলা করোনা মুক্ত। এ জেলায় ৬৪ হাজার লোককে ত্রাণ দেয়া হয়েছে। যারা নাম প্রকাশ করতে চান না এমন ৬০০ পরিবারকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সেখানকার সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্নভাবে যুক্ত হয়ে কাজ করছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতিও বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ’৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় আমরা যেভাবে মোকাবিলা করেছিলাম, করোনাকেউ আমরা সেভাবে মোকাবিলা করব। তিনি পৌরসভার মেয়র হিসেবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পৌরসভায় কর্মচারীদের জন্য প্রণোদনা দেয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বলেন, শরীয়তপুর থেকে কোনো লোক যেন চাঁদপুরে প্রবেশ না করে। কারণ, শরীয়তপুরের লোকেরাই প্রথমে ঝামেলাটা বাধিয়েছে। এরপর চাঁদপুরের নার্স আনোয়ারা বেগম বক্তব্য দেন।
এরপরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত উদ্দৌলা জেলার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। সেখানে মাওলানা মুফতি আব্দুল হক বক্তব্য দেন । ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোনো করোনা রোগীর সন্ধান মেলেনি এটা জেনে খুব খুশি হন প্রধানমন্ত্রী। সেখানকার জেলার সাধারণ সম্পাদক বক্তব্য দেন । তিনি বলেন, ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, সেনাবাহিনীর সদস্যসহ করোনা নিয়ে যারা কাজ করছে, তাদের জন্য প্রণোদনা দিচ্ছেন। কিন্তু রাজনীতিবিদরা যে কাজ করছে তাদের জন্য কী দেবেন বলে তিনি প্রশ্ন রাখেন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি।
এরপর সর্বশেষ সংযোগ দেয়া হয় লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পালকে। সেখানকার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জেলার পরিস্থিতি তুলে ধরে বক্তব্য দেন।
তখন শেখ হাসিনা বলেন, আমি খুশি হলাম, এখানে কোনো করোনায় আক্রান্ত পাওয়া যায়নি। সব তো ঢাকায় এসে বসে আছে বোধহয়। তবে সাবধানে থাকতে হবে। সারাবিশ্বে যেভাবে করোনা রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে, বৃদ্ধি পাবার একটা ট্রেন্ড (প্রবণতা) আছে। তাতে আমাদের সময়টা এসে গেছে, এপ্রিল মাসটা। এই সময়টা আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।
সবশেষে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর সব বিভাগের প্রতিটি জেলার প্রতিনিধিদের সাথে আমি কথা বলব। মতবিনিময় করব। লক্ষ্মীপুরের মানুষ লক্ষ্মী হয়ে ভালো থাকুক। সেই দোয়া করি। সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
এফএইএস/জেডএ/এমকেএইচ