ভেলোর টু বেনাপোল : সড়কপথের যাত্রীদের অভিজ্ঞতার বয়ান
ভারতের তামিলনাড়ুর ভেলোর থেকে বাসযোগে দেশে ফিরছেন চিকিৎসার জন্য সেখানে গিয়ে আটকে পড়া ৪৭ বাংলাদেশি। প্রায় ২২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কপথে তারা আসছেন যশোরের বেনাপোল অভিমুখে। এই দীর্ঘ যাত্রায় নানা অভিজ্ঞতা হচ্ছে তাদের। এই অভিজ্ঞতা কখনো তিক্ত, আবার কখনো বেশ স্বস্তির। লকডাউনের কারণে প্রায় সব বন্ধ থাকায় একদিকে প্রয়োজনীয় রিফ্রেশ রুমের অভাব যেমন ভোগান্তিতে ফেলেছে, তেমনি হজম করে ফেলতে হচ্ছে ক্ষুধার জ্বালা। অন্যদিকে রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকায় দীর্ঘপথের এ বিরতিহীন ও মসৃণ যাত্রা মনে দিচ্ছে স্বস্তি।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৭ মে) সন্ধ্যায় ওই ৪৭ যাত্রী বাসযোগে বেনাপোলের উদ্দেশে রওনা হন। এর আগে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে অনেকে দেশে ফিরলেও এভাবে বাস আসার নজির নেই। এই যাত্রায় তিন শিশুও রয়েছে। রয়েছেন অনেক নারী রোগী। তাদের বেনাপোল পৌঁছাতে দুদিন লাগবে।
জানা গেছে, ভেলোরে চিকিৎসা নিতে অথবা রোগীর সহযোগী হিসেবে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে ভারতজুড়ে লকডাউন ঘোষিত হলে আটকা পড়েন এরা। এই অবস্থায়ই প্রায় দেড় মাস কাটান সেখানে। এর মধ্যে ভেলোরের কাছের শহর চেন্নাই থেকে আকাশপথে অনেক যাত্রী দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু প্লেনের টিকিটের বেশি দাম হওয়ায় এরা আসতে পারছিলেন না, আবার কেউ কেউ টিকিটও পাননি। শেষে ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে এই নাগরিকদের দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন। এই বাংলাদেশিরা জনপ্রতি ১৬-১৭ হাজার রুপিতে বেনাপোল পর্যন্ত আসছেন বলেও জানা গেছে।
বাসের যাত্রী সাব্বির চৌধুরী হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় জাগো নিউজকে বলেন, অনেক যাত্রী ক্ষুধার্ত। কিন্তু সব রেস্তোরাঁ বন্ধ। অনেক কষ্টে একটা হাইওয়ে রেস্তোরাঁ খুঁজে পেয়েছিলাম। সেখানে উচ্চমূল্য দিয়ে খাবার পার্সেল করতে হয়েছে। এক পিস ডিম ৯০ রুপি রেখেছে। তবে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে সব সময় বাসের লোকেশন সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে। আমরা তাদের যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছি।
ওয়াশরুম সংক্রান্ত ভোগান্তির কথা তুলে ধরে আরেক যাত্রী মো. খলিল বলেন, আমরা ওয়াশরুম পাচ্ছি না। সব বন্ধ। তাই সবার খুব সমস্যা হচ্ছে। তবে দেশের পথে থাকায় কিছুটা স্বস্তিও পাচ্ছি।
অবশ্য পথে পথে ভারতের অনেক পরিযায়ী শ্রমিককে হেঁটে গন্তব্যে ফিরতে দেখে স্বস্তি হচ্ছে তাদের। মো. আবদুল কাদের নামে এক যাত্রী বলেন, আমাদের বাস ভালোই চলছে। কিন্তু আসার সময় অনেক পরিযায়ী (এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে গিয়ে কাজ করা) শ্রমিককে রাস্তায় হেঁটে বা বাইসাইকেলে শত শত কিলোমিটার পাড়ি দেয়ার দৃশ্য দেখলাম।
বরকত উল্লাহ নামে আরেক যাত্রী বলেন, আমাদের অধিকাংশেরই মোবাইলে চার্জ নেই। বেনাপোল গিয়ে কীভাবে যোগাযোগ করবো জানি না।
যাত্রী মমিনুল হক বলেন, এই পথে নিয়মিত বাস চলাচল করলে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য ভালো হবে। কম খরচে সেখানে যাওয়া যাবে। পথে যদিও এখন অনেক সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু এসব লকডাউনের কারণে। নইলে রাস্তা অনেক সুন্দর, যানজটও নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই ভোগান্তি হবে না।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাড়িতে দুজন ড্রাইভার আছেন, চলছে বিরতিহীন। শুধু রিফ্রেশ হওয়ার জন্য বিভিন্ন জেলার তেলের পাম্পে দাঁড়াচ্ছে গাড়ি। এ বিশেষ বাস চলার জন্য সে দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনকে ভারত সরকারের কাছ থেকে রুট পারমিট নিতে হয়েছে।
ভেলোরে ছয় মাস ধরে আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন এক নারী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর আমরা প্রায় দেড় মাস আটকা ছিলাম। বাচ্চা নিয়ে ছোট্ট রুমে তিনজন বন্দি ছিলাম। কিন্তু সব টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় বিমানে ফেরা সম্ভব হয়নি। এখন বাসে যাত্রা করেছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর দেশের প্রায় ১২ লাখেরও বেশি মানুষ ভারতে চিকিৎসার জন্য যান। এর বেশির ভাগই যান ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে (সিএমসি)। ১১৮ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী এই হাসপাতালের চিকিৎসার মান অত্যন্ত ভালো এবং খরচও তুলনামূলক কম বলে থাকেন সেবাপ্রাপ্তরা। সিএমসি বাদে নারায়ানা হুদ্রালয়া হাসপাতালেও যান অনেকে।
সূত্র জানায়, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আটকা পড়া বাকি বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চারটি ও ইউএস-বাংলার পাঁচটি ফ্লাইট পরিচালিত হবে। এগুলো কলকাতা, নয়াদিল্লি, ব্যাঙ্গালুরু ও চেন্নাই থেকে আসবে।
বিমানের ফ্লাইটগুলো কলকাতা থেকে ১০ মে (রোববার), মুম্বাই থেকে ১২ মে (মঙ্গলবার), ব্যাঙ্গালুরু থেকে ১৩ মে (বুধবার) অথবা ১৫ মে (শুক্রবার) এবং দিল্লি থেকে ১৪ মে (বৃহস্পতিবার) আসবে।
এছাড়া পর্যাপ্ত যাত্রী ও অনুমোদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ৮-১০ মে এবং ১৩-১৪ মে চেন্নাই থেকে মোট পাঁচটি বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করবে। এর প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে।
এইচএস/এইচএ/জেআইএম