ঢাবির ভূমিহীন শিক্ষার্থীর সবজি চাষে সাফল্য!
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি গারো পাহাড়ের পাদদেশ শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলায় এক মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্ম। চার ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। সদা হাস্যোজ্জ্বল ছেলেটি ছোটবেলা থেকেই মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। শিক্ষাজীবনে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ডপস’র সহায়তায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ- ৫ পেয়ে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। মেধার স্বাক্ষর রাখেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হয়ে।
ডপস’র মাধ্যমে নতুন জীবন পেয়ে রাসেল মিয়া এখন দরিদ্র ও অসহায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন নিয়মিত। করোনার ছুটিতে ক্যাম্পাস থেকে বাড়িতে এসে কয়েকদিন ঘোরাফেরা করার পর চলে যান শেরপুর শহরে অবস্থিত ডপস’র অফিসে। শুরু করেন কলেজপড়ুয়া ডপস সদস্যদের ক্লাস নেয়া। এভাবেই কাটতে থাকে তার দিনগুলো। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতায় লকডাউন ঘোষণা হলে পুনরায় তাকে ফিরে আসতে হয় বাড়িতে।
একদিকে ঘরে অসুস্থ বাবার ঔষধ কেনা ও পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকতে অর্থের চাহিদা, অন্যদিকে এলাকার শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধকরণের চিন্তা। এসব চিন্তায় বসে থাকতে ভালো লাগে না তার। কী করা যায় পরিবারের জন্য, মানুষের জন্য এবং কীভাবে অবসর সময়কে কাজে লাগানো যায় সেটাই ভাবতে থাকেন। করোনা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে স্বাভাবিক মেলামেশা সংকোচিত করে ফেলেন তিনি।
সময়কে কাজে লাগানোর চিন্তা করতেই মাথায় দারুণ এক বুদ্ধি আসে। মনস্থির করেন, পাহাড়ের ঢালে সবজি চাষ করবেন। ফোন দেন দরিদ্র ও অসহায় শিক্ষার্থী উন্নয়ন সংস্থা- ডপস’র প্রতিষ্ঠাতা সৈনিক শাহীন মিয়াকে। বলেন, ‘ভাই সবজি চাষ করতে চাই’। শাহীন মিয়া বললেন, ‘তোমাদের তো নিজস্ব কোনো জমি নাই। কোথায় চাষ করবা?’ রাসেল বললেন, ‘ভাই, পাহাড়ের ঢালে ফাঁকা জায়গা আছে অনেক। সেখানে চাষ করব।’ শাহীন মিয়া সায় দিলেন। শুরু হলো তার সবজি চাষের কাজ।
যে ছেলেটি সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয় হলের রিডিংরুমে বই নিয়ে পড়াশোনা করতেন, সেই ছেলেটি এখন সাত সকালে উঠে কোমরে গামছা বেঁধে কাঁধে কোদাল নিয়ে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে ছুটে চলেন উঁচু-নিচু পাহাড়ের ঢালে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি চলে তার জমি প্রস্তুতকরণের কাজ। দিনশেষে ক্লান্তমনে বাড়ি ফিরে প্রায়ই ফোন করে কাজের অগ্রগতি জানান শাহীন মিয়াকে। চলতে থাকে তার নিরলস পরিশ্রম। বপন করেন বরবটি, কাকরোল, কুমড়া আর ঝিঙার বীজ। পাহাড়ের লাল মাটি ভেদ করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে কঁচি সবুজ সতেজ অঙ্কুর। তা দেখে উল্লাসে মাতেন রাসেল মিয়া।
কৃষি প্রধান দেশে কৃষিকাজে নেমে প্রকৃতির সাথে মিশে অনেকটা ভুলেই গিয়েছিলেন, তিনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের একজন শিক্ষার্থী। মা-মাটির টানে তিনি এখন ব্যস্ত সবজি বাগানের কাজে। গত কয়েকদিন আগে সবজি গাছে সবজি ধরেছে।
ঢাবিতে মেধাতালিকায় চান্স পাওয়ায় জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো-তে ‘রাসেলের স্বপ্ন পূরণ হবে তো!’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর তার পরিবার ভূমিহীন কি-না যাচাই করতে তৎকালীন নালিতাবাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধি মান্নান সোহেল সরেজমিন পরিস্থিতি দেখতে রওনা হন তার বাড়ির দিকে। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ে ভূমিহীন রাসেলের ছাপড়াঘর দেখতে যেতে হলে পায়ে হাঁটার বিকল্প নেই। তাই রাস্তায় গাড়ি রেখে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে পায়ে হেঁটে ছুটে যান তাদের বাড়িতে।
অন্যের জমিতে একচালা ছাপড়া ঘরে মা-বাবা, ভাই-বোন নিয়ে বসবাস করা মেধাবী রাসেলের পরিবারের অবস্থা নিজের চোখে দেখে ইউএনও নিজেই কেঁদে বার বার রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো হয়ে জন্ম নেয়া রাসেলকে সাথে নিয়ে যান জেলা প্রশাসকের কাছে। সব শুনে জেলা প্রশাসক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ভর্তির ব্যাপারে পাঁচ হাজার টাকার সহযোগিতা করেন। পরিবারের করুণ অবস্থার কথা শুনে ভূমিহীন পরিবারটিকে পুনর্বাসনেরও আশ্বাস দেন। কিন্তু ওই আশ্বাস শুধু আশ্বাস-ই রয়ে গেল!
থেমে থাকার পাত্র তো নয় রাসেল। বর্তমানে টিউশনি, উপবৃত্তির টাকা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ডপস’র সামান্য সহযোগিতায় চলে তার পড়ালেখা। সরকারিভাবে ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের বিভিন্ন রকমের সুযোগ-সুবিধা থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রাসেল ও তার পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি এখনও। এখনও তারা সেই ছাপড়া ঘরে বসবাস করছে অন্যের জমিতে।
করোনার এই অবসরকালে পাহাড়ের ঢালে ফাঁকা জায়গায় সবজির বাম্পার ফলন ফলিয়েছেন রাসেল। গাছে ধরেছে বরবটি, কাকরোল, কুমড়া আর ঝিঙা। এঁকেবেঁকে বেড়ে উঠেছে পুঁইশাকের গাছ। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাজারজাত করা হবে রাসেলের নিজ হাতে লাগানো সবজিগুলো।
কথায় বলে ‘যে রাঁধতে জানে সে চুলও বাঁধতে জানে’। যার বাস্তব উদাহরণ রাসেল। শিক্ষাজীবনে মেধার স্বাক্ষর রেখে পড়াশোনা করছেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবজি বাগান করে আরও একবার প্রমাণ করলেন তিনি অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন এক মেধাবী।
এমএআর/এমএস