বিনিয়োগ আকর্ষণে সংস্কারের মানসিকতা তৈরির আহ্বান

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:৪১ এএম, ২৩ আগস্ট ২০২০

৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও সে লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি বাংলাদেশ। গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খাতে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে, যেখানে মার্কিন বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ওয়ার্ল্ড ইনেভেস্টমেন্ট প্রতিবেদন ২০২০-এর তথ্য মতে, করোনার কারণে ২০২০ সালে বৈশ্বিক বিনিয়োগ ৪০% কমে, ১.৫৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের এসে দাঁড়াতে পারে। যার ফলে আমাদের মতো উন্নয়নীল দেশে করোনা পরবর্তী সময়ে বৈদেশিক বিনিয়োগ উল্লেখ্যযোগ্য হারে কমে যেতে পারে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি সময়োপযোগী সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন ও সংস্কার, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের আরও শক্তিশালীকরণের ওপর জোরারোপ করেন।

শনিবার (২২ আগস্ট) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগের গতিপ্রবাহে কোভিড-১৯ এর প্রভাব : সমস্যা ও উত্তরণ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সংস্কারের পরামর্শ দেন ওয়েবিনারে অংশ নেয়া অন্যান্য আলোচকরাও।

ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী। বাংলাদেশস্থ জাপান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ইতো নায়োকিসহ এ ওয়েবিনারে আরও অনেকে অংশ নেন।

সূচনা বক্তব্যে শামস মাহমুদ বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন, সরকারি-বেসরকারি যোগাযোগ বাড়ানো, স্থানান্তরিত বিনিয়োগ আকর্ষণে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ, রফতানির পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং বাজার সম্প্রসারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মত প্রকাশ করেন। বিশেষ করে মার্কিন ও জাপানের উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে ম্যানুফেকচারিং, সেবাখাত ও অবকাঠামোখাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।

ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, আঙ্কাটার্ডের তথ্য মতে, ২০২০ সালে বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রায় ৪০% হ্রাস এবং ২০২১ সালে হ্রাস পাওয়ার হার আরও ৫ থেকে ১০% বাড়ার পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেখানে এশিয়া অঞ্চলের উন্নয়নশীল দেশসমূহে বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রায় ৪৫% কমে যেতে পারে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে নতুন পণ্য উৎপাদন, উদ্ভাবন, অবকাঠামো, বাজার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষমতা বাড়ানো ওপর আরও বেশি হারে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। প্রত্যাশিত বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে কমপ্লায়েন্স, দক্ষ মানবসম্পদ, পণ্য পরিবহনে সহজতর প্রক্রিয়া, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতিমালাসমূহের মধ্যে সমন্বয় এবং দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যকার সমন্বয় বাড়ানো প্রভৃতি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, হ্রাসকৃত করের হার বিনিয়োগকারীদের নতুন বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করবে। তবে আমাদের দেশে কর-জিডিপির আনুপাতিক হার এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। এক্ষেত্রে আমাদের বিদ্যমান করদাতাদের উপর করের বোঝা না বাড়িয়ে নতুন করদাতা খোঁজার ওপর জোর দেয়া প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, সরকার নীতি সংস্কারের ওপর নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং নীতি সংস্কারের এ উদ্যোগ দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ইতোমধ্যে বিনিয়োগ আকর্ষণে সংস্কারের মানসিকতা প্রয়োজনীয়তা সকলের মাঝে চলে এসেছে। তবে এ বোধদয় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ তাদের মাধ্যমেই নীতিগুলোর বস্তবায়ন হয়ে থাকে।

আশাবাদ ব্যক্ত করে সালমান এফ রহমান বলেন, আগামী বছরের মধ্যে বৈশ্বিক ব্যবসা পরিচালনার সূচকে বাংলাদেশ দ্বি-অংকে (ডাবল ডিজিট) উন্নীত হবে। খুব শিগগিরই খেলাপি আইন ও কোম্পানি আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা হবে। অন্যান্য দেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কর কাঠামাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাত বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত। আর গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ সম্পন্ন করা গেলে প্রতিযোগী দেশসমূহের সাথে আমাদের সক্ষমতা বাড়বে।

বেজা চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী জানান, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এসইজেড) খাদ্য ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাতে বিনিয়োগ করলে উদ্যোক্তারা ২০% ক্যাশ ইনশিয়েটিভ পাবে। মোটরসাইকেল নিবন্ধন ফি কমে শতাংশের নিচে আনা হবে। বিডা ও হাইটেক পার্ক প্রভৃতি কর্তৃপক্ষের আরও ক্ষমতায়নের আহ্বান জানান তিনি। এছাড়া তিনি নীতিমালার সংষ্কার এবং বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো একান্ত আবশ্যক বলে মত প্রকাশ করেন।

জাপান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ইতো নায়োকি বলেন, জাপানের বিনিয়োগকারীর বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। ২০১৯ সালে এশিয়াতে জাপানি বিনিয়োগ ছিল ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে বাংলাদেশে ০.০৯% জাপানিজ বিনিয়োগ এসেছে।

তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগর ভিত্তিক অর্থনীতি এবং এশিয় অঞ্চলে আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপনে জাপানের পক্ষ হতে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে ট্যাক্সেশন, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ রিফর্ম গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

ওয়েবিনারের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন জোঅ্যান ওয়াগনার, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম, বিল্ড-এর চেয়ারম্যান আবুল কাসেম খান, জেট্রোর বাংলাদেশ আবাসিক প্রতিনিধি ইউজি এন্ডো, আব্দুল মোনেম লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম, অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ, স্যামসং-ফেয়ার ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আলম আল মাহবুব অংশগ্রহণ করেন।

বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন জোঅ্যান ওয়াগনার বলেন, বাংলাদেশের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমেরিকান কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ রয়েছে এবং কোভিড-১৯ এর কারণে ডিজিটাল অর্থনীতি নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

জেট্রোর বাংলাদেশ আবাসিক প্রতিনিধি ইউজি এন্ডো বলেন, বর্তমানে ৩১০টি জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে, যা গত ১০ বছরে চারগুণ রেড়েছে।

তিনি বলেন, করোনার কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে সারা পৃথিবীতে ৩৩% জাপানিতে বিনিয়োগ কমেছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশকে কর নীতিমালার সংস্কার ও আধুনিকায়, নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজতরকরণসহ সার্বিকভাবে বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ উন্নয়নে আরও বেশি গুরুত্বারোপের আহ্বান জানান।

রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, বিনিয়োগকারীদের জন্য দ্রুততম সময়ে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সুবিধা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি অত্যন্ত জরুরী। তিনি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে অবকাঠামোখাতের উন্নয়ন, স্থানীয় উদ্যোক্তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, দীর্ঘমেয়াদী নীতি সহায়তা প্রদান, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রভৃতি বিষয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে মত প্রকাশ করেন।

আব্দুল মোনেম লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম বলেন, আমাদের দেশে ভূমি রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা অত্যন্ত প্রকট এবং এ সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন। তিনি বিডা, বেজার এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার সমন্বয় আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করেন।

মুক্ত আলোচনায় ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি ও পরিচালক ওয়াকার আহমদ চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি এন কে এ মবিন, এফসিএ, এফসিএস ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

পিডি/এমএসএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।