পতেঙ্গা সৈকতে প্রতিদিনই মানুষের ঢল, উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি
রামিমা আফরোজা বন্দর নগরীর চান্দগাঁও এলাকার বাসিন্দা। ৯ মাস ও দুই বছর বয়সী দুই সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে। সঙ্গে ছিলেন তার স্বামী বেসরকারি চাকরিজীবী মো. আতিকুল্লাহ। স্বামী-স্ত্রী দুজনের থুতনিতে মাস্ক ঝুললেও দুই সন্তানের কারও মুখে চলমান মহামারিতে। কিছুদূর এগোতেই মাস্ক ছাড়া ঘুরে বেড়ানো আরও দুই ভ্রমণকারীর সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তারা জানান, গরমে মাস্ক পরে থাকতে বেশ অস্বস্তি লাগে।
শুধু উল্লিখিত ব্যক্তিরাই নন, চট্টগ্রামের অন্যতম জনপ্রিয় এই বিনোদন কেন্দ্রে ঘুরতে আসা মানুষের ৮০ শতাংশেরও বেশির মুখে মাস্ক ছিল না। যারাও বা পরেছিলেন তাদের অনেকের মাস্ক ছিল থুতনিতে অথবা ঝুলছিল কানের সঙ্গে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভয়ে কেউ কেউ মাস্ক নিয়ে এলেও ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন পকেটে রেখে।
শুক্রবার (১৯ মার্চ) বিকেলে পতেঙ্গার চিত্র ছিল এমনই।
চকবাজার থেকে ঘুরতে এসেছেন সাফায়েত নামে এক তরুণ। তিনি বলেন, ‘আমি টিকা নিয়েছি। তাই মাস্কের প্রয়োজন নেই।’
৩৬ বছর বয়সী আরমান হোসেন বলেন, ‘আমার করোনা হয়ে গেছে। শরীরে এন্টিবডি আছে। তাই মাস্ক পরা না পরা একই বিষয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণী বলেন, ‘কই, মাস্ক ছাড়া এতদিন ঘুরেও তো করোনা হয়নি! তাছাড়া এত লোক মাস্ক ছাড়া চলাফেরা করে কারও তো করোনা হতে দেখছি না।’
আবার পতেঙ্গা সৈকতের মূল পয়েন্ট থেকে আউটার রিং রোড দিয়ে এক কিলোমিটার সামনে গিয়ে দেখা গেল আরও ভয়াবহ চিত্র। চট্টগ্রামের একটি মার্কেট থেকে সেখানে গিয়ে আয়োজন করা হয়েছে বনভোজনের। এই আয়োজনকে ঘিরে সৈকতে বিশাল মঞ্চ করে হচ্ছে নাচ-গান। সেখানে মহামারির ভয়াবহতা ভুলে আনন্দে মেতেছিলেন শত শত মানুষ।
সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ আবার বেড়ে যাওয়ায় গত ১৫ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান বলেন, ‘কোনো অনুষ্ঠান উন্মুক্ত স্থানে করা যাবে না। তবে ইনডোরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রোগ্রাম করা যাবে। নতুন করে করোনা সংক্রমণ বাড়লেও নগরবাসী স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে উদাসীন। তাই নগরবাসীকে সচেতন করতে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা নগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অভিযান পরিচালনা করবেন।’
জেলা প্রশাসকের এই ঘোষণার পরে নগরের কয়েকটি জায়গায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা অভিযান চালান। তবে পতেঙ্গায় কোনো অভিযান চালাতে দেখা যায়নি। ফলে প্রতিদিনই আগের তুলনায় সেখানে বাড়ছে জনসমাগম। একই সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব মানার পরামর্শও সেখানে উপেক্ষিত। ফলে এই সমুদ্র সৈকত থেকেই ব্যাপক সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, দেশে করোনার টিকা এলেও কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রামে বেড়ে চলছে আক্রান্তের সংখ্যা। জেলা সিভিল সার্জন অফিস জানায়, শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় (বৃহস্পতি থেকে শুক্র) ২ হাজার ৪৩৯ জনের নমুনায় পরীক্ষায় সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ২১২ জনের দেহে। যা গত ৮১ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ নিয়ে চট্টগ্রামে মোট আক্রান্ত হিসেবে শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ২৪০ জনে।
এ বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনার টিকা সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। প্রথম ডোজ নেয়ার পর এই টিকা কাজ করে না। দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার ১৫ দিন পর থেকে মানুষের শরীরে এটি কাজ করে। তাও সংক্রমণ ঠেকাতে এই টিকা কাজ করবে ৭০ ভাগ। বাকি ৩০ ভাগ ঝুঁকি থেকেই যাবে। সুতারাং করোনা থেকে বাঁচতে মাস্কের কোনো বিকল্প নেই। তাই জনসাধারণের খুব বেশি সচেতন হতে হবে। না হয় প্রশাসনের তদারকিতেও খুব বেশি কাজ হবে না।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা নিয়মিত নগরের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করছে। পতেঙ্গার সমুদ্র সৈকতে জনসমাগমের ছবি থাকলে আমাকে দিন। আমি বিষয়টি দেখছি।’
মঞ্চ করে গানের অনুষ্ঠান আয়োজনের বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, ‘লোকজনকে খোলা জায়গায় অনুষ্ঠান না করার জন্য বলা হয়েছে। এরপরও কেউ যদি আয়োজন করে থাকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে গত বছরের ১৮ মার্চ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) তৎকালীন কমিশনার মাহবুবুর রহমান তার ফেসবুক ওয়ালে পতেঙ্গা সৈকতে জনসমাগমের একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন, ‘এই হলো পতেঙ্গা সৈকতের গতকাল বিকেলের দৃশ্য। করোনাভাইরাস থেকে নগরবাসীকে বাঁচাতে আমরা দায়িত্ব নিলাম। খালি থাকবে সৈকত। দয়া করে কেউ যাবেন না।’ এর কয়েকঘণ্টা পর অফিসিয়ালি প্রজ্ঞাপন দিয়ে সৈকতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল সিএমপি।
সেই ঘোষণা প্রত্যাহার না হলেও মাঝখানে সংক্রমণ আক্রান্ত কম হওয়ায় লোকজন আবারও ভিড় করে সমুদ্র সৈকতে। তবে নতুন করে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকলেও সিএমপির পক্ষ থেকে এখনও কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। আজকে ছুটির দিন তাই হয়ত একটু বেশি ভিড় ছিল। বন্ধের দিন কী পরিমাণ লোক থাকে সেটাও আমরা দেখব। কয়েকদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব।’
আগের প্রজ্ঞাপনের বিষয়টি উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, ‘একটা প্রজ্ঞাপন তো চিরকাল থাকে না। এখন আমরা নতুন করে সিদ্ধান্ত নেব।’
এসএস