সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত রিকশাচালকরা
রাজধানীর শতাধিক রিকশাগ্যারেজ, বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করে রিকশাচালক ও তাদের পরিবার। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাঝে সড়কে পুলিশ, মাস্তানের হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের। রেজিস্ট্রেশন বা পরিচয় না থাকায় সরকারের কোনো নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না বৃহৎ এই শ্রমিক গোষ্ঠী। বঞ্চিত হচ্ছে করোনা টিকা ও প্রণোদনা থেকেও।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে অতিমারিসহ দুর্যোগকালীন সময়ে রিকশাচালকদের সুরক্ষা দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন চালক, মালিক ও বিশেষজ্ঞরা।
মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ অডিটোরিয়ামে ‘অতিমারী লকডাউনে ঢাকা শহরে রিক্সা চালকদের জীবন ও জীবিকা: কার্যকর সুরক্ষায় ভবিষ্যৎ করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এই অভিমত জানান তারা।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এই সভার আয়োজন করে।
এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম। তিনি বলেন, রাজধানীতে ২২ লাখ রিকশা শ্রমিকের বসবাস। চালক, গ্যারেজ মালিক, বডি প্রস্তুকারীসহ ২৫ থেকে ২৬ লাখ মানুষ রিকশা খাতের উপর নির্ভরশীল। তবে রিকশা চালকদের কোনো ডাটাবেজ বা রেজিস্ট্রেশন না থাকায় তারা নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, রাজধানীর ১৪ জন রিকশাচালকের উপর গবেষণা চালিয়ে জানা গেছে, করোনার মধ্যে ঢাকায় রিকশাচালকের সংখ্যা বেড়েছে। এসময় তাদের আয় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। করোনায় কোনো রকম সরকারি সাহায্য তাদের কাছে পৌঁছায়নি।
তিনি আরও বলেন, প্রথম লকডাউনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি থাকায় চালকদের অনেক সমস্যা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, করোনার মধ্যে রিকশাচালকরা তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলা খাবার খেয়েছেন। একবেলা খাবার কমিয়েছেন। যে পরিমান চাল লাগতো তার অর্ধেক সংস্থান করতে পেরেছেন। ১৪ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৩ জন স্থানীয় কাউন্সিলর, সামাজিক সংগঠন থেকে থেকে ত্রাণ পেয়েছেন। তবে কোনো সরকারি অনুদান পাননি।
রিকশাচালক ও শ্রমিক সংগঠকরা বলছেন, তাদের পরিবারের কোনো সদস্য করোনায় আক্রান্ত হননি। চালকরা মাস্কের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেও, অস্বস্তি বোধ করায় তারা তা ব্যবহার করতে চান না। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ১৪ জনের মধ্যে ৪ জন টিকা নিয়েছেন। এর মধ্যে দুই জন দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন।
তারা বলছেন, আগামীতে লকডাউন হলে তারা কী করবেন এমন কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। ভবিষ্যতে একেবারেই লকডাউন চান না তারা।
এসময় রিকশাচালকদের ডাটাবেজ তৈরি করা, ত্রাণ বিতরণে রিকশা শ্রমিক সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করা, চালকদের লাইসেন্স প্রদানসহ স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন, শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেওয়া হয় প্রবন্ধটিতে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাসদের সাধারণ সম্পাদক ড. শিরিন আখতার বলেন, উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আমাদের জাতীয় কাজ। এ কাজে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করেই আমাদের উন্নয়নকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর মানুষের জীবনমান নিচে থাকবার কথা নয়। গড় আয়ু বাড়ছে, অবকাঠামো বাড়ছে সেখানে কোনো মানুষের ছাদবিহীন থাকার কথা নয়।
রিকশাচালকদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, চালকরা একটা বড় মানব শক্তি। তারা চাইলে অনেক কিছু করতে পারেন। চালকদের ঐক্যবদ্ধ করতে সংগঠনের আওতায় আনতে হবে। রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে চালকরা সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হবেন।
সভায় রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইনসুর আলী বলেন, সরকার গার্মেন্ট শ্রমিক মালিকদের অনুদান দিয়েছে৷ তবে রিকশাচালক ও মালিকদের কোনো রকম সাহায্য করেনি। চালকদের লাইসেন্স বা তথ্যভাণ্ডার না থাকায় তারা প্রণোদনার আওতায় আসতে পারেন নি।
তিনি বলেন, আমরা বেওয়ারিশ লাশ হতে চাই না, পরিচয় চাই।
বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধসহ যে কোনো আন্দলোন এই শ্রমজীবী মানুষরা নেতৃত্ব দিয়েছেন। অথচ আজ তারা মূল স্রোতধারার বাইরে। পুলিশ ও প্রশাসনের সদস্যরা চালকদের হয়রানি করেন।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তারা বলেন, যারা প্যাডেল রিকশা চালায় তাদেরই একটা অংশই ব্যাটারিচালিত রিকশা চালায়। বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে ইঞ্জিন রিকশা বন্ধ করা হলে চালকরা বিপদে পড়বেন।
বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ বলেন, রিকশা চলে না এমন কোনো সড়ক নাই। তবে তাদের কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়না।
তিনি বলেন, চালকদের সংখ্যা নির্ধারণ না করা গেলে তাদের মৌলিক চাহিদা ও সামাজিক সুরক্ষার বিষয়গুলো অবহেলিত থেকে যাবে। চালকদের কাছে প্রণোদনার সাহায্য পৌঁছে দিতে পুলিশের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর সামাজিক-মৌলিক চাহিদার দাবি তোলা লজ্জাজনক। ঢাকায় যারা রিকশা চালাতে আসেন তারা দুর্যোগ কিংবা ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার। কর্মসংস্থান যদি থাকতো তাহলে ঢাকামুখী স্রোত কমানো যেতো।
রিকশাচালকদের মূল স্রোতধারার বাইরে এনে উন্নয়ন করা সম্ভব না জানিয়ে তিনি বলেন, নতুন ড্যাপে জোনভিত্তিক রিকশা ও চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ ৯৪ শতাংশ মানুষ রিকশায় চলাচল করেন।
এসএম/এসএইচএস/এএসএম