রাশিয়ার তেল আমদানি করলেও থাকবে যেসব চ্যালেঞ্জ

মাহবুবুল ইসলাম মাহবুবুল ইসলাম , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৪৮ পিএম, ৩১ আগস্ট ২০২২

মহামারি করোনার প্রকোপ কমতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে ধেয়ে আসে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট। এ সংকটে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে জ্বালানি ও খাদ্য খাতে। সারাবিশ্বে হু হু করে বেড়েছে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের দাম। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। এ অবস্থায় রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ জ্বালানি তেল আমদানি করবে কি না তা নিয়ে চলছে আলোচনা। যদি বাংলাদেশের জন্য রাশিয়ার তেল উপযুক্ত হয়, তবে কম দামে ওই তেল কেনার প্রস্তাবে সাড়া দিতে পারে সরকার।

এ বিষয়ে কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) দায়িত্ব দিয়েছে জ্বালানি ও খণিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এরইমধ্যে রাশিয়া থেকে আসা ৫০ লিটার তেলের নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। তবে জানা গেছে, রাশিয়ার তেল বাংলাদেশে ব্যবহারের উপযোগী করতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটু ভুল হলেই বড় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। একদিকে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। অন্যদিকে জ্বালানি তেল ব্যবহারকারী সব যানবাহনের ইঞ্জিন ও মেশিনারিজ পড়তে পারে ক্ষতির মুখে। নষ্ট হতে পারে পরিবেশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম জাগো নিউজকে বলেন, রাশিয়ার তেল হচ্ছে ‘হেভি অয়েল’। আমাদের ইস্টার্ন রিফাইনারি যে মেকানিজমে অ্যারাবিয়ান লাইট অয়েল পরিশোধন করে, সেখানে রাশিয়ার তেল রিফাইন (পরিশোধন) সম্ভব নয়। অন্যদিকে আমেরিকা-ইউরোপের যে নীতি আছে, তার বাইরে গিয়ে রাশিয়া নিজেদের মতো করে তেল বিক্রি করে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকা-ইউরোপের সঙ্গে আমাদের যে বড় বাজার রয়েছে, তার ওপরও প্রভাব পড়তে পারে।

বিকল্প পন্থা বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ভারত যেহেতেু রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনে পরিশোধন করছে, আমরা চাইলে ভারতের কাছ থেকে পরিশোধন করা তেল নিয়ে আসতে পারি। এতে আমরা বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ছাড়াই তেল ব্যবহার করতে পারবো।

বিষয়টি নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) সহযোগী অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম। বাংলাদেশের তেল-গ্যাস নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে গবেষণা করছেন তিনি। জাগো নিউজকে ড. আমিরুল ইসলাম বলেন, রাশিয়ান ক্রুড অয়েল রয়েছে আট ধরনের। সেগুলো হলো- ইএসপিও, সকোল, শাখালিক ব্লেন্ড, নোভি পোর্ট, সাইবেরিয়ান লাইট, ইউর‌্যালস ব্লেন্ড, অ্যারকো এবং ভ্যারানডে। এই আট ধরনের তেলকে আবার সোর, লাইট, হেভি এবং সুইট- এই চারভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্য থেকে লাইট ও সুইট- এই ধরনের তেল বাংলাদেশের কিনতে হবে। যদি সোর ও হেভি অয়েল কেনা হয় তবে আমাদের দেশের সব গাড়ির ইঞ্জিন এবং যন্ত্রপাতি করোশন হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। এখন এই দুই ধরনের তেল নির্বাচনে কতটা দক্ষতা দেখাতে পারবো সেটাই প্রশ্ন।

jagonews24

তিনি বলেন, রাশিয়ার তেল প্রসেসিং করাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ইস্টার্ন রিফাইনারি খুবই পুরোনো। এটার যে ডিস্ট্রিবিউশন কলাম রয়েছে, সেখানে রাশিয়ান ক্রুড প্রসেস করার মতো ফ্লেক্সিবিলিটি নেই। তাদের পুরো প্রসেসিংটাই পরিবর্তন করতে হবে। ট্রেগুলোর তাপমাত্রা পরিবর্তন করতে হবে। যেহেতু আমাদের রিফাইনারির প্রসেসিং মধ্যপ্রাচ্যের তেলের জন্য তৈরি করা। তাই যদি রাশিয়ার তেল আনা হয় তবে নতুন একটা রিফাইনারি তৈরি করতে হবে। যদি একটা রিফাইনারির মধ্যেই পরিশোধন করা হয়, তবে তাকে মোডিফিকেশন করতে হবে। এতে সমস্যা হবে মধ্যপ্রাচ্যের তেল যখন আসবে, তখন এক মোডিফিকেশন, যখন রাশিয়ার তেল আসবে তখন আবার আরেক মোডিফিকেশন। একটিমাত্র রিফাইনারিকে এরকম বারবার মোডিফিকেশন করতে হবে।

রিফাইনারি প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের যে রিফাইনারি আছে সেটি ম্যানুয়াল। এই ম্যানুয়াল রিফাইনারিতে রাশিয়ার তেল মোডিফিকেশন সম্ভব নয়। ফলে পুরোটা সেটআপ করতে হলে নতুন রিফাইনারি তৈরির মতোই খরচ পড়বে। যদি মোডিফিকেশন করতে হয় তবে আমাদের ভাবতে হবে, রাশিয়া আমাদের যে তেল দেবে, সেটি দীর্ঘমেয়াদি কি না। তাদের প্রতিকূলতা কেটে গেলে বা যুদ্ধ বন্ধ হলে তেল দেবে কি না। যদি সেটা দীর্ঘমেয়াদি হয় কিংবা যে দামে তেল দেওয়ার প্রস্তাব তারা দিয়েছে সে দামটাই ঠিক রাখে, তবেই আমাদের বাজেট করা অর্থ কাজে লাগবে। যদি রাশিয়া চুক্তি থেকে সরে আসে, তবে আমাদের বড় অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে পড়তে হবে।

তিনি আরও বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের তেল পরিশোধন করতে করতে আমাদের রিফাইনারির কর্মীরা দক্ষ হয়েছেন। তাদের রাশিয়ার তেল নতুন করে পরিশোধন করতে হলে সেটি শিখতেও বছর দুয়েক সময় লাগবে।

ঠিক মতো পরিশোধন না হলে কী ক্ষতি হতে পারে- এ প্রসঙ্গে ড. আমিরুল ইসলাম বলেন, পরিশোধন ঠিক মতো না হলে রাশিয়ার তেল পুড়ে যে ধোঁয়া তৈরি হবে, সেটি আমাদের পরিবেশের জন্য আরও ক্ষতিকর হবে। জেট ফুয়েলের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেবে। প্লেনে আমরা যে তেল ব্যবহার করি, সেখানে অনেক সূক্ষ্ম ব্যাপার রয়েছে। যদি সঠিক পরিশোধন না হয়, তবে প্লেনগুলো যখন উপরে উড়বে, তখন তেল ওই আবহাওয়ায় জমে যাবে। প্লেনগুলো বন্ধ রাখতে হবে।

‘আমাদের দেশের যানবাহন কিংবা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অকটেন, পেট্রল ও ডিজেলচালিত যেসব ইঞ্জিন ব্যবহার হয়, সেসব ইঞ্জিনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের তেল সেভাবে পরিশোধন করে সামঞ্জস্য করা হয়। কিন্তু রাশিয়ার তেল ঠিকঠাক পরিশোধন না হলে এসব ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাবে।’

এমআইএসটির এই সহযোগী অধ্যাপক আরও বলেন, রাশিয়া যদি আমাদের উপযুক্ত করে তেল তৈরি করে দেয়, তবেই সে তেল ব্যবহার করা সম্ভব। অনেকেই রাশিয়ার ফিনিশড প্রোডাক্ট আনার কথা বলেন। কিন্তু রাশিয়া তো তার দেশের আবহাওয়ার উপযুক্ত করে রিফাইন করছে, সেটিও আমরা ব্যবহার করতে পারবো না। যদি আমেরিকান সোসাইটি অব টেস্টিং মেথড অনুযায়ী পরীক্ষা করে রাশিয়া তেল তৈরি করে দেয়, তবেই আমরা ব্যবহার করতে পারবো।

jagonews24

এদিকে গত ২৪ আগস্ট রাশিয়া থেকে ৫০ লিটার পরিশোধিত জ্বালানি তেলের নমুনা  ঢাকায় পৌঁছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুধবার (৩১ আগস্ট) বিপিসির চেয়ারম্যান এবি এম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, রাশিয়ার তেল সবেমাত্র রিফাইনারিতে ঢুকেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রাথমিক পর্যায়ে। এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না। এটা পুরোটাই টেকনিক্যাল কাজ। তবে খুব বেশিদিন লাগার কথা নয়। দুই সপ্তাহের মধ্যেই হয়তো প্রাথমিক একটা ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।

এর আগে গত ১৬ আগস্ট একনেক সভায় রাশিয়া থেকে কীভাবে তেল আমদানি করা যায় , সেদিকটা পর্যালোচনা করে দেখার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত যদি পারে, বাংলাদেশ কেন পারবে না প্রধানমন্ত্রী এমনটিও বলেছেন বলে সভা-পরবর্তী গণমাধ্যমকে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

জানা গেছে, রাশিয়ার ওপর আমেরিকাসহ ইউরোপের নানা রকম নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকায় যে কোনোভাবেই তেল কেনার গ্রাহক খুঁজছে দেশটি। এ মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশের কাছে আবারও পরিশোধিত তেল বিক্রির প্রস্তাব পাঠায় রাশিয়ার তেল উৎপাদন ও বিপণন কোম্পানি রোজনেট। আগে তেল কেনায় আগ্রহী না হলেও এখন বাংলাদেশ ভেবে দেখছে বিষয়টি। রাশিয়া থেকে তেল আমদানির বিষয়ে আলোচনা করতে কমিটি গঠন করেছে বিপিসি। যে স্যাম্পলটি রাশিয়া পাঠিয়েছে, সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপর কমিটি আলোচনা করে দেখবে যে রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ তেল কিনে পুষিয়ে উঠতে পারবে কি না। তার পরই সিদ্ধান্ত।

বিপিসির সূত্র জানায়, রাশিয়ার শীর্ষ তেল কোম্পানি রোজনেট পরিশোধিত তেল আনার যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা আসলে পুরোপুরি পরিশোধিত নয়। ব্যবহারের জন্য এটি আবার পরিশোধন করতে হবে। নমুনা পরীক্ষার পর বিষয়টি আরও নিশ্চিত হওয়া যাবে। এরপর দাম ও অন্যান্য খরচ নিয়ে আলোচনা হবে। রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। তেলের মান, ব্যবহারের উপযোগিতা, দাম, আনার খরচসহ বিভিন্ন বিষয় যাচাই-বাছাই করে দেখছে বিপিসি। দু’দেশের প্রতিনিধিদলের মধ্যে এক দফা বৈঠকে প্রাথমিক কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

এমআইএস/কেএসআর/জিকেএস

রাশিয়ার তেল হচ্ছে ‘হেভি অয়েল’। আমাদের ইস্টার্ন রিফাইনারি যে মেকানিজমে অ্যারাবিয়ান লাইট অয়েল পরিশোধন করে, সেখানে রাশিয়ার তেল রিফাইন সম্ভব নয়।

আমাদের ভাবতে হবে, রাশিয়া আমাদের যে তেল দেবে, সেটি দীর্ঘমেয়াদি কি না। তাদের প্রতিকূলতা কেটে গেলে বা যুদ্ধ বন্ধ হলে তেল দেবে কি না। যদি সেটা দীর্ঘমেয়াদি হয় কিংবা যে দামে তেল দেওয়ার প্রস্তাব তারা দিয়েছে সে দামটাই ঠিক রাখে, তবেই আমাদের বাজেট করা অর্থ কাজে লাগবে।

রাশিয়া যদি আমাদের উপযুক্ত করে তেল তৈরি করে দেয়, তবেই সে তেল ব্যবহার করা সম্ভব। অনেকেই রাশিয়ার ফিনিশড প্রোডাক্ট আনার কথা বলেন। কিন্তু রাশিয়া তো তার দেশের আবহাওয়ার উপযুক্ত করে রিফাইন করছে, সেটিও আমরা ব্যবহার করতে পারবো না।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।