‘রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হলে রাষ্ট্রও দুর্বল হয়ে যায়’

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০১:৪০ পিএম, ১৬ নভেম্বর ২০২২

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। সাবেক চেয়ারম্যান, জনতা ব্যাংক।

১৯৭৮ সালে তিনি মস্কোর মস্কো ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইকোনমি থেকে অর্থনীতি বিষয়ে এমএসসি ও ১৯৮২ সালে উন্নয়নের রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতায় যোগ দেন ১৯৮২ সালে।

দুর্ভিক্ষ সম্পর্কিত সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, দেশের অর্থনীতির সংকট ও ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। চলমান সংকটের জন্য অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর দুর্নীতিকে দায়ী করেন তিনি।

তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

প্রথম পর্ব: ‘ক্ল্যাসিক্যাল দুর্ভিক্ষ বলতে যা বোঝায় তা হবে না’ 

জাগো নিউজ: চলমান পরিস্থিতি আর দুর্ভিক্ষের আলোচনা করেছিলেন আগের পর্বে, যেখানে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের দেওয়া দুর্ভিক্ষের তত্ত্বের মিল পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘দুর্ভিক্ষ মানবসৃষ্ট কারণেও হয়’।

আবুল বারকাত: অমর্ত্য সেন এমন তত্ত্ব দিয়েই নোবেল জয় করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি খাদ্য কীভাবে পেতে পারেন? প্রথমত, আপনি টাকা নিয়ে বাজারে গিয়ে খাদ্য কিনে আনলেন। কিন্তু আপনার টাকা নেই। তখন খাদ্যকে আপনার কাছে আসতে হবে। যাদের সীমিত আয় তাদের প্রথম ব্যয়ের খাতটাই হচ্ছে খাদ্য। তার মানে অর্থের অভাবে এখানে ঘাটতি দেখা দেবে।

এরপর অন্যান্য ব্যয়ও বন্ধ হয়ে যাবে। যেমন- পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা বা শিক্ষাব্যয়ও আর থাকবে না। আপনি দেখান যে, কোন পরিবারে একজন সদস্যেরও রোগ নেই। ক্যানসার, কিডনি, কার্ডিয়াক আর ডায়াবেটিস- এই চারটি রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এই চারটি রোগে প্রচুর মানুষ আক্রান্ত বাংলাদেশে। গরিব মানুষের এসব রোগ হলে চিকিৎসা করাতে পারবে না। কারণ খাদ্য হলো তার প্রথম অগ্রাধিকার। খাদ্যের পর মানুষের ব্যয় হয় তার বাসস্থানে। বাড়িভাড়া তো বেড়েই চলছে। কিডনি রোগীকে তার ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দিয়ে বাড়িভাড়া দিতে হবে। দিতেই হবে। নইলে আরও বিপদ।

সরকার ওএমএস, টিসিবি বা স্বল্পমূল্যে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করছে। কিন্তু আমি তো দেখছি টিসিবির লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। টিসিবির লাইন দীর্ঘ হওয়ার অর্থ হচ্ছে মানুষ আসলে ভালো নেই। টিসিবির লাইন ছোট হলে বুঝবেন মানুষ ভালো আছে। এগুলো তো সমাজকে পর্যবেক্ষণ করার অন্যতম সূচক।

মহামারির কারণে এক ধরনের অভাবি মানুষের উপকার হয়েছে। মুখে মাস্ক পরে একজন ভদ্রলোক ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পেছনের মানুষটিও চিনতে পারছেন না। নিজেকে আড়াল করতে আমরাও এভাবে মাস্ক পরে যাই এখন। দুই কারণে এমন করি। প্রথমত, ‘আমি বারকাতকে’ দেখাতে চাই না। দ্বিতীয়ত, মাস্ক পরলে অসুবিধা কম হবে। কিন্তু আমার কাছে দ্বিতীয় কারণটি প্রধান নয়। আড়াল করাই প্রধান কারণ। মানুষ বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই আড়াল করে রাখে।

মানুষ টিসিবির লাইনে না দাঁড়িয়ে বিকল্প পাচ্ছে না। তার সামনে আর উপায় নেই। আমি মোহাম্মদপুর এলাকায় এমনটি রোজ দেখতে পাচ্ছি। অনেক বাড়িওয়ালা তার বাড়ির কাজের মেয়ে বা দারোয়ানকে ব্যাগ হাতে লাইনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। মধ্যবিত্তদের বেশির ভাগই এমনটি করতে চায়। যদিও এমন লাইন থেকে পণ্য ঘরে আনা কারও জন্য সুখকর নয়।

জাগো নিউজ: সরকার তো উন্নয়ন নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে জনগণও তৃপ্ত।

আবুল বারকাত: প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তো বলেই ফেললেন, দিনের বেলায় বিদ্যুৎ নাও পেতে পারেন। আবার সরকারিদলের লোকেরা বলছেন, এটি তাদের দলীয় বক্তব্য নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যকেও ক’দিন আগে এভাবে খারিজ করে দেওয়া হলো।

প্রধানমন্ত্রী কিন্তু গত ক’দিনে বলছেন গ্রাম, সাধারণ মানুষের উন্নয়নে প্রকল্পগুলোর অগ্রাধিকার থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে কিন্তু স্পষ্ট হচ্ছে আগামীতে কোন কোন প্রকল্পে অগ্রাধিকার থাকবে না। তার বক্তব্য থেকে আমি ধারণা করেছি, অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্পে গুরুত্ব দিতে চাইছেন না।

জাগো নিউজ: বিদ্যুতের কথা বলছেন। বিদ্যুৎ তো সরকারের উন্নয়নের দৃশ্যমান খাত।

আবুল বারকাত: রেন্টাল-কুইক রেন্টালের বিপক্ষে সম্ভবত আমিই প্রথম বলেছি। ২০১১-২০১২ সালের কথা বলছি। সরকারের কুইক রেন্টাল প্রকল্প যে বুমেরাং হবে তা আগেই বলে এসেছি। সাধারণত, যুদ্ধ-পরবর্তী কোনো দেশে এমন প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০০৯ সালের আগে আগে তো বাংলাদেশে যুদ্ধ হয়নি। তাহলে এমন প্রকল্প কেন নেওয়া হলো?

বিদ্যুতের কাঁচামাল তথা সব ধরনের জ্বালানি কেনা হচ্ছে স্পট মার্কেট থেকে। অথচ সরকার চাইলে দীর্ঘমেয়াদেও জ্বালানি কিনতে পারতো। তা করেনি। বিশেষ সিন্ডিকেটের কারণে স্পট মার্কেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার জ্বালানি কিনতে হচ্ছে।

এখন আবার সরকার বলছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যত ইচ্ছা ঋণ নিতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এমন ধারণা দিয়েছে।

আমরা শুধু সরকারের উন্নয়ন-নীতি সমালোচনা করার স্বার্থেই সমালোচনা করিনি। আমরা শুরুতেই বলেছিলাম, কয়লাভিত্তিক বড় প্রকল্প করা হোক, যার জ্বালানি নেওয়া হবে কোনো স্পট মার্কেট থেকে নয়, দীর্ঘমেয়াদে চুক্তির মাধ্যমে। আমাদের কথা শোনা হয়নি। আসলে আমাদের তো করার কিছুই নেই অসঙ্গতিগুলো ধরিয়ে দেওয়া ছাড়া।

জাগো নিউজ: সরকার গ্রাম উন্নয়ন বা ছোট প্রকল্পে গুরুত্ব দিতে চাইছে বলছেন। তাহলে কি মেগা প্রকল্পগুলো আপাতত…

আবুল বারকাত: তাতেও বিপদ আছে। এতে আরও ব্যয় বাড়বে। এমনিতেই এসব প্রকল্পে সময় আর ব্যয় বাড়ে। অনেক প্রকল্প আছে ৬০ বা ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন বন্ধ করে দিলে ব্যয় বাড়বে। আবার সম্পন্ন না করা পর্যন্ত এসব প্রকল্প থেকে কোনো সেবাও মিলবে না।

আরও বিপদ আছে। ২০১৪ সালের কথা। আমি তখন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান। বলা হলো, বিদেশ থেকে ঋণ বেসরকারি খাতও নিতে পারবে। যুক্তি দেওয়া হলো বিদেশ থেকে টাকা আনলে সুদ কম দিতে হবে। আমার কাছে এই যুক্তি খারাপ লাগছিল। আমি প্রশ্ন তুললাম, ২ শতাংশ সুদের ঋণ তো বৈদেশিক মুদ্রায় শোধ করতে হবে। টাকার মূল্য কমে গেলে তো ২ শতাংশ দেশের ৯ শতাংশকে ছাড়িয়ে যাবে। ডলারের মূল্য বেড়ে কিন্তু এখন তাই হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, আমি বলেছিলাম, কারা বিদেশ থেকে কোন টাকা আনছেন? আমি কিন্তু জানি কারা বিদেশ থেকে টাকা এনেছেন। যারা দেশের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন, তারাই বাইরের ব্যাংক থেকে কম সুদে দেশে টাকা আনছেন। এগুলো মানি লন্ডারিংয়ের টাকা।

বিদেশ থেকে আনা ঋণ আবার পরিশোধ করতে হবে ডলারে। বেসরকারি সেক্টরের কেউ যদি এই ঋণ শোধ করতে না পারে, তাহলে রাষ্ট্রকে সেই ঋণ শোধ করতে হবে। কারণ এই ঋণের গ্যারান্টি দিয়েছে রাষ্ট্র। ব্যক্তি টাকা দিতে না পারলে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা দিতে বাধ্য থাকবে।

আমি তখন বলেছিলাম, যারা বাইরে রপ্তানি করেন না, তাদের বিদেশি ঋণ আনতে দেওয়া ঠিক হবে না। রপ্তানি করলে তারা ফরেন কারেন্সি পায়। ঋণ শোধ করতে হবে ফরেন কারেন্সিতেই। তার মানে এক্সপোর্ট লাইন যাদের ভালো আছে, তাদের কথা বিবেচনায় এনে বিদেশ থেকে ঋণ আনার সুযোগ দেওয়া যেত। অনেকেই গম আমদানি করছে। তাদের হয়তো রপ্তানি নেই। আমাকে তখন পাগল বলা হলো। আমি রক্ষণশীল। কমিউনিস্ট বলা হলো। ইত্যাদি ইত্যাদি।

জাগো নিউজ: তাদের উদ্দেশ্যে এখন কী বলবেন?

আবুল বারকাত: মৌলবাদের অর্থনীতি নিয়ে আমাকে এখনো পাগল বলা হয়। কিন্তু দিন শেষে আমারটাই ঠিক থাকছে। আমি কাউকে কিছু মনে করি না।

সরকার একটি উন্নয়ন দর্শনে আটকে গেছে। সরকারের উন্নয়ন দর্শনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি বঙ্গবন্ধুর যে দর্শন ছিল, তার সঙ্গেও এর সম্পর্ক নেই। সব ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দাও। এতই যদি ব্যক্তি মালিকানা ভালো হয়, তাহলে ঢাকা মেডিকেলের মতো প্রতিষ্ঠানও ব্যক্তি খাতে দিয়ে দেন।
রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হলে রাষ্ট্রও দুর্বল হয়ে যায়। তখন জনগণের অবস্থা দেখার কেউ থাকে না।

এএসএস/এএসএ/জিকেএস

সরকার ওএমএস, টিসিবি বা স্বল্পমূল্যে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করছে। কিন্তু আমি তো দেখছি টিসিবির লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। টিসিবির লাইন দীর্ঘ হওয়ার অর্থ হচ্ছে মানুষ আসলে ভালো নেই। টিসিবির লাইন ছোট হলে বুঝবেন মানুষ ভালো আছে। এগুলো তো সমাজকে পর্যবেক্ষণ করার অন্যতম সূচক।

আমরা শুধু সরকারের উন্নয়ন-নীতি সমালোচনা করার স্বার্থেই সমালোচনা করিনি। আমরা শুরুতেই বলেছিলাম, কয়লাভিত্তিক বড় প্রকল্প করা হোক, যার জ্বালানি নেওয়া হবে কোনো স্পট মার্কেট থেকে নয়, দীর্ঘমেয়াদে চুক্তির মাধ্যমে। আমাদের কথা শোনা হয়নি।

সরকার একটি উন্নয়ন দর্শনে আটকে গেছে। সরকারের উন্নয়ন দর্শনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকী বঙ্গবন্ধুর যে দর্শন ছিল, তার সঙ্গেও এর সম্পর্ক নেই। সব ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দাও। এতই যদি ব্যক্তি মালিকানা ভালো হয়, তাহলে ঢাকা মেডিকেলের মতো প্রতিষ্ঠানও ব্যক্তি খাতে দিয়ে দেন।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।