আসামি গ্রেফতার হয়, উদ্ধার হয় না চুরি-ডাকাতির মালামাল

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১৮ এএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

রাজধানীতে বাড়ছে চুরির ঘটনা। বাদ যাচ্ছেন না সাবেক কিংবা বর্তমান পুলিশ কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিদের বাসা-বাড়িও। নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা লাগিয়েও চোরের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না রাজধানীবাসী। রাস্তাঘাটে পথচারীদের মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনাও অহরহ। থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলা হলেও আসামি গ্রেফতার কিংবা খোয়া যাওয়া মালামাল উদ্ধারে নগর অতি নগণ্য। এতে ভুক্তভোগীদের মধ্যে বাড়ছে ক্ষোভ।

গত বছরের ২২ আগস্ট রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোডের ইস্টার্ন হাউজিংয়ে পুলিশের সাবেক আইজিপি খন্দকার মোজাম্মেলের বাসায় চুরি হয়। ষষ্ঠতলার ডুপ্লেক্স বাসার জানালার গ্রিল কেটে ৪৫ ভরি সোনা নিয়ে যায় চোরচক্র। আলমারিতে থাকা চারশ সিঙ্গাপুরের ডলার ও কিছু রিংগিতও খোয়া যায়।

আরও পড়ুন>> চলতি বছর রাজধানীতে বেড়েছে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই 

এ ঘটনায় ভুক্তভোগী বাদী হয়ে রমনা থানায় দুটি মামলা করেন। থানা পুলিশ ছাড়াও গোয়েন্দা পুলিশ, সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য সংস্থা কাজ করছে এ মামলা নিয়ে। কিন্তু পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও কাউকে গ্রেফতার কিংবা মালামাল উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

ক্ষোভ প্রকাশ করে খন্দকার মোজাম্মেলের স্ত্রী মিতালি হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত চুরির ঘটনায় গ্রেফতার অথবা আমাদের চুরি যাওয়া মালামাল উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এটি দুঃখজনক। এর চেয়ে বেশি দুঃখজনক সেগুলো ছিল আমার ছেলে-মেয়ের বিয়ের গহনা। নিরাপত্তার জন্য মায়ের বাসায় থাকায় চুরি হয়ে গেলো। এতদিন যেহেতু স্বর্ণালঙ্কারগুলো পাইনি, ভবিষ্যতে আর পাবো বলে আশা করি না।

আরও পড়ুন>> ডাকাতি করে লিখে রেখে গেলেন ‘আই লাভ ইউ’ 

ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকও গত বৃহস্পতিবার মাসিক অপরাধ-সংক্রান্ত সভায় বলেন, রাজধানীতে সিঁধেল চুরির ঘটনা ঘটলেও চোর শনাক্তে পুলিশের গুরুত্ব কম। ছিনতাই, ডাকাতি ও খুনের মামলার রহস্য উদ্ঘাটন হলেও চোর শনাক্তে পুলিশ গুরুত্ব দেয় না। ফলে চোরেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে সিঁধেল চুরি (গ্রিল কাটা চোর বোঝানো হয়েছে) করছে। এ কারণে চুরি মামলার রহস্য উদ্ঘাটনে সফলতা নেই।

গত বছরের ২০ আগস্ট রাজধানীর কলাবাগান লেক সার্কাস ডলফিন গলির একটি বাসায় রাত ১টা থেকে ভোর সাড়ে ৫টা পর্যন্ত দ্বিতীয় তলার গ্রিল কেটে ৭২ ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ নগদ এক লাখ টাকা নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী কলাবাগান থানায় মামলা করেন। চুরির প্রায় ২২ দিন পর মাত্র তিন ভরি সোনা ও নগদ ৮৫ হাজার টাকা উদ্ধার করে কলাবাগান থানা পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় চোরচক্রের চারজনকে।

jagonews24

পুলিশ জানায়, কলাবাগান থানা ও রাজধানীর আশপাশের পাঁচশর বেশি সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে এ ঘটনায় সরাসরি জড়িত চোরদের শনাক্ত করা হয়।

গত বছরের ১৭ আগস্ট রাজধানীর খিলক্ষেত থানার নিকুঞ্জ-২ এর ১৫ নম্বর রোডে চিকিৎসক দম্পতির বাসার দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে ৪২ ভরি সোনা ও ইউএস ডলার চুরি করে চোরচক্র। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী খিলক্ষেত থানায় মামলা করেন। এক মাসের বেশি সময় পরে ৮ সেপ্টেম্বর চোরচক্রের ছয়জনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা গুলশান বিভাগ। ৪২ ভরি সোনা চুরি হলেও উদ্ধার হয় মাত্র ৯ ভরি।

আরও পড়ুন>> নড়াইলে ১২ দিনে তিন বাড়িতে চুরি-ডাকাতি, খোয়া গেছে ২০ ভরি স্বর্ণ 

গত বছরের ১৭ আগস্ট দুপুরের দিকে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুর এলাকার আল-আমিন জুয়েলার্সে ভয়াবহ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। দোকান থেকে এক কোটি ২৫ লাখ ২৯ হাজার টাকার স্বর্ণালঙ্কার লুট হয়। দোকানে থাকা সিসি ক্যামেরায় পুরো দৃশ্যটি ধরা পড়ে। দুটি মোটরসাইকেলে এসে মাত্র তিন মিনিটে ডাকাতি করে পালিয়ে যান ডাকাতদলের সদস্যরা।

একই বছরের ৩০ অক্টোবর ফেনীর সোনাগাজীতে অর্জন চন্দ্র ভাদুরীর সোনার দোকানে ফিল্মি কায়দায় ডাকাতি হয়। দোকান মালিককে কুপিয়ে ও হাতবোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মুখোশ পরা ডাকাতদলের সদস্যরা ২৮ লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার লুট করে।

এ দুটি দোকানে ডাকাতির ঘটনায় নেতৃত্ব দেন ল্যাংড়া হাসান ওরফে হাসান জমাদ্দার। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে বোমা ফাটিয়ে ডাকাতি করেন তিনি। পরে গত ২৮ ডিসেম্বর অভিযান চালিয়ে ল্যাংড়া হাসানসহ আন্তঃজেলা ডাকাতদলের ছয়জনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মতিঝিল বিভাগ।

তবে দুটি দোকানে প্রায় দেড় কোটি টাকার স্বর্ণালঙ্কার ডাকাতি করলেও গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে কোনো স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করতে পারেনি ডিবি। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি পিস্তল, দুই রাউন্ড গুলি, পাঁচটি চাপাতি ও ডাকাতি শেষে পালিয়ে যেতে ব্যবহার করা প্রাইভেটকার উদ্ধার করা হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মামলার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে চুরির ঘটনায় মামলার সংখ্যা বেড়েছে ২৮ শতাংশ। ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১০৩টি। দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে ১৪৫টি, আগের বছর দস্যুতার ঘটনা ছিল ১৩৪টি।

আরও পড়ুন>> ঢাকায় চুরি-ছিনতাই চলছেই 

পুলিশ বলছে, ছিনতাইকারীদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন তারা। ডিএমপির আটটি বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ও ৫০টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) চোর ধরতে এবং চুরির মামলার আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। চুরির মামলার আসামিরা জামিনে বেরিয়ে কী অবস্থায় রয়েছে, সেসব বিষয়েও প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে তাদের।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় বড় চুরির ঘটনায় চোর একাই জড়িত বিষয়টি এমন নয়। যিনি সশরীরে চুরি করেন তাকেই গণমাধ্যমের সামনে আনা হয়, কিন্তু পেছনের চোরদের দেখার সুযোগ আমাদের হয় না। আমরা শুধু শুনি গ্রেফতার চোরদের পেছনে অনেক পৃষ্ঠপোষক আছে। চুরির ঘটনা কেন্দ্র করে যারা অন্যায় ও অনৈতিকভাবে পেশাদারত্বের বাইরে গিয়ে লাভবান হতে চান তাদেরও সুযোগটি বেড়ে যায়।

গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) শাহিদুর রহমান রিপন জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা শহরে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ডিবি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে। আসামি গ্রেফতার থেকে মালামাল উদ্ধারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত কাজ চলে। চোরচক্র চুরির পর মালামাল দ্রুততার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে। এতে অভিযানে আমাদের যেমন বেগ পেতে হয়, অন্যদিকে বেগ পেতে হয় ভুক্তভোগীকেও।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, মামলা হলে আসামিদের ধরার জন্য অভিযান পরিচালনা করা হয়, গ্রেফতার করা হয়। চুরির পর চোরেরা ধরা পড়ার ভয়ে চোরাই মালামাল দ্রুত বিক্রি ও হাতবদল করে। এ কারণে চুরির পর সম্পূর্ণ মালামাল উদ্ধার করা যায় না। ঢাকায় চুরি ঠেকাতে আমাদের টহল পুলিশ বাড়ানো হয়েছে, সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে ঢাকা শহরের অধিকাংশ জায়গা। এছাড়া ডিবির প্রতিটি টিম চোর ধরার জন্য কাজ করছে।

গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম জাগো নিউজকে বলেন, সম্প্রতি কয়েকটি বড় চুরির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, চোরচক্র মালামাল বিক্রি করে সেই টাকায় জমি কিনেছে। যাতে ধরা পড়লেও তাদের কাছ থেকে মালামাল না পাওয়া যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে চুরির মামলায় গ্রেফতার হয়ে কিছুদিন কারাভোগের পর জামিনে বেরিয়ে আবারও চুরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে একশ্রেণির চোর।

এ বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানায় মামলার পর দ্রুত ডিবির সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা দ্রুততার সঙ্গে আসামি ধরে উদ্ধার অভিযান চালাই। এর মধ্যে দেখা যায় কিছু ঘটনায় আসামি গ্রেফতার হলেও মালামাল আসামিরা বিক্রি করে ফেলে।

https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2019November/2-20230224081820.jpg

চোরচক্রের সদস্যরা সহজে চোরাই মাল বিক্রি করতে পারছে বলে চুরি বাড়ছে জানিয়ে ডিবিপ্রধান বলেন, যেসব মার্কেটের ব্যবসায়ীরা চোরাই মাল কেনেন তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চুরির মামলায় গ্রেফতারের ক্ষেত্রে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহেলা থাকে উল্লেখ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এ কে এম হাফিজ আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ডিএমপির সিনিয়র কর্মকর্তারা বিভিন্ন মামলার সুপারভাইজর থাকেন। কিন্তু চুরির মামলাগুলো তারা সঠিকভাবে তদারকি করেন না। আর এই সুযোগে বেশ কয়েকটি বড় ঘটনা ঘটেছে। চোরদের একটি ডেটাবেস তৈরি করা হয়েছে। এরই মধ্যে এই ডেটাবেসে সংগ্রহ করা হয়েছে কয়েক হাজার চোরের তথ্য।

তিনি বলেন, আসামি গ্রেফতারের পাশাপাশি মালামাল উদ্ধারে পুলিশ আগের চেয়ে বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখে। তবে কিছু কিছু ঘটনায় মালামাল উদ্ধার হয় খুবই সামান্য। কারণ চুরির পর দ্রুততার সঙ্গে মালামাল এক হাত থেকে অন্য হাতে চলে যায়।

জানতে চাইলে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, কারও কোনো মূল্যবান জিনিস চুরি হলে পুলিশের অভিযানে কিছু উদ্ধার হয়। কিন্তু অর্থ, সোনা কিংবা অন্য কিছু যখন চুরি হয় তখন সেই পরিমাণ মালামাল উদ্ধার হয় না। এক্ষেত্রে তিন ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। চুরির পর চোর সরাসরি কিছু অংশ বিক্রি করে দেন, যাদের জানিয়ে চোর চুরি করেন তাদের চুরির ভাগ দেওয়া লাগে, আরেকটি হচ্ছে- চোরদের গ্রেফতার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে বণ্টনের কথা শোনা যায়। অর্থাৎ, ভুক্তভোগীর যে পরিমাণ মালামাল চুরি হয়েছে সেই পরিমাণ মালামাল তিনি ফেরত পান না।

তিনি বলেন, বড় বড় চুরির ঘটনায় চোর একাই জড়িত বিষয়টি এমন নয়। যিনি সশরীরে চুরি করে তাকেই গণমাধ্যমের সামনে আনা হয়, কিন্তু পেছনের চোরদের দেখার সুযোগ আমাদের হয় না। আমরা শুধু শুনি গ্রেফতার চোরদের পেছনে অনেক পৃষ্ঠপোষক আছে। চুরির ঘটনা কেন্দ্র করে যারা অন্যায় ও অনৈতিকভাবে পেশাদারত্বের বাইরে গিয়ে লাভবান হতে চান তাদেরও সুযোগটি বেড়ে যায়।

টিটি/এএসএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।