ভূ-পৃষ্ঠের এত কাছে কম্পন মানে দেশে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ছে
![ভূ-পৃষ্ঠের এত কাছে কম্পন মানে দেশে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ছে](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2023March/cover-20230511090444.jpg)
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান। ভূ-তত্ত্ব ও পরিবেশবিদ। অধ্যাপনা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেছেন। ভূমিকম্পে বাংলাদেশের অবস্থান ও রাজধানী ঢাকার ঝুঁকি প্রসঙ্গে নিয়ে কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকা ও এর অদূরে দু’বার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হলো। যদিও মৃদুমানের এমন কম্পনে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু আতঙ্কের বার্তা দিচ্ছে অনেকেই। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান: বার্মা প্লেটের সঙ্গে বেঙ্গল বেসিনের সংঘর্ষের ফলে দীর্ঘদিন থেকেই চট্টগ্রাম, সিলেট ও ভারত-মিয়ানমারের কিছু অঞ্চলে অহরহই কম্পন হচ্ছে। আবার একেবারে ঢাকার আশপাশেও এ কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে। দোহার, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। দু’শ বছর ধরে এসব অঞ্চলে ছোট-খাটো ভূমিকম্প হচ্ছেই।
এসব কম্পন থেকে শক্তি সঞ্চয় হচ্ছে, যেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এই ঝুঁকি আরেকটি বার্তা দিচ্ছে, তা হলো ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৮ বা ১০ কিলোমিটার গভীরে কম্পনের উৎপত্তি। ভূ-পৃষ্ঠের এত কাছে কম্পন সৃষ্টি হলে ঝুঁকি বাড়তে থাকে।
জাগো নিউজ: ভূমিকম্পে ঢাকার বিপদ নিয়ে কী বলা যায়?
আরও পড়ুন>> ‘একটি অরাজক চক্র গোটা রাজধানীকে অগ্নিগর্ভে পরিণত করছে’
ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান: রিখটার স্কেলে যদি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটবে। কারণ ঢাকায় প্রচুর ভবন নির্মাণ করা হয়েছে নিচু এলাকায় তথা খাল, বিল, পুকুর, নদী ভরাট করে। ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্পে এই ভবনগুলো ধসে পড়বে। এ কারণেই ঢাকার ঝুঁকি মূলত বেশি।
ঢাকার ঝুঁকি আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এখনকার অব্যবস্থাপনা। কোনো নিয়ম মেনে এখানে ভবন তৈরি করা হয়নি। ভূমিকম্পের সময় বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের লাইন বিস্ফোরণ ঘটে অগ্নিগর্ভে রূপ নেবে। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ তৈরি হবে।
ভূমিকম্পের ঝুঁকি যেমন বেড়েছে তেমনি চরম অব্যবস্থাপনা এই ঝুঁকিকে আরও ভয়াবহ রূপ দেবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ভূমিকম্পে যে কোনো শহর থেকে ঢাকার ক্ষতি হবে বেশি।
সামান্য আগুন লাগলেই আমরা নেভাতে পারছি না। ফায়ার সার্ভিস যেতে পারে না, গাড়ি যেতে পারে না, পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না। বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়ার সময় আমরা দেখতে পেলাম ঢাকা শহর আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। পুরান ঢাকার বহুতল ভবনে আগুন লাগলে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। আর ভূমিকম্পে বিপর্যয় ঘটলে পরিস্থিতি কী ঘটবে বোঝাই যাচ্ছে!
জাগো নিউজ: ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ধরে কোন কোন পয়েন্টকে অধিকতর…
ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সিলেট ও চট্টগ্রাম হচ্ছে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। তবে গ্রামাঞ্চলে ভূমিকম্পে খুব বেশি বিপর্যয় ঘটবে বলে মনে করি না। কারণ গ্রামে বহুতল ভবন কম। বিপর্যয় ঘটলে সহজে উদ্ধার করাও সম্ভব হবে। কিন্তু ঢাকা আসলে কোনো হিসাব বা অনুমান করা সম্ভব হবে না।
আরও পড়ুন>> ভূমিকম্পে তুরস্ক-সিরিয়ার চেয়ে ঢাকা অতিবিপজ্জনক অবস্থায়
সম্প্রতি সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তে যে বিপর্যয় দেখলাম, তার চেয়ে রাজধানী ঢাকার অবস্থা কয়েকগুণ খারাপ হবে। সেখানে নিয়ম মেনে ভবন করা হয়েছে। বহুতল ভবন ছিল না। জনবহুল ছিল না। তবুও সেখানকার চিত্র ছিল ভয়াবহ। সে তুলনায় ঢাকার কথা চিন্তাই করা যায় না।
জাগো নিউজ: ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার কোনো উপায় আছে?
ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান: অনিয়ম তো আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বহুকাল ধরেই আমরা অনিয়ম করে আসছি। কোনো দায়বদ্ধতা নেই। রাষ্ট্র, সমাজ বা ব্যক্তিপর্যায়েও আমরা নিয়ম মানি না। যারা দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার কথা, তারাই আইনের শাসন মানছেন না।
আবার নিয়ম মানানোর কথা বললেও সম্ভব হচ্ছে না। ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি মার্কেট ভেঙে ফেলার কথা বলা হলেও সরকার ভাঙতে পারছে না। তার মানে সরকারের যদি পিছুটান থাকে সাধারণ মানুষের উপায় কী! আমরা রাজধানীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধস দেখতে পেলাম। যখন ঘটনা ঘটে, তখন সরব হয়। পরে আর খবর থাকে না। সব ভুলে যায়। এই ভুলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আরকটি ঘটনা আমাদের সামনে আসে। এভাবেই তো চলছে।
আরও পড়ুন>> ভূমিকম্প কেন হয়? এ সময় দ্রুত যা করবেন
ক্ষতি কমাতে হলে সবার আগে নিয়মে ফিরতে হবে। এখনো কিছুটা ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। বিশেষ করে নতুন করে যেসব অবকাঠামো হচ্ছে, সেখানে নিয়ম মানানো যায়। এজন্য মানুষকে সচেতন করাও জরুরি।
সরকারকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। নিয়ম না মানলে ব্যবস্থা নিতে হবে। যত বড় শক্তিই হোক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে। বিকেন্দ্রীকরণটাও জরুরি। উন্নয়নের সমবণ্টন জরুরি। দেশের সব মানুষ ঢাকামুখী। এই মানুষের স্রোত ঠেকাতে হবে। অন্য শহরগুলো নজরে আনতে হবে। গ্রামের উন্নয়ন না হলে টেকসই উন্নয়ন হবে না। টেকসই উন্নয়ন না হলে এমন বিপর্যয় দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। সরকার ও ব্যক্তিপর্যায় থেকে দায় নিতে হবে।
জাগো নিউজ: ঝুঁকি প্রশ্নে দেশের অন্য শহরগুলো নিয়ে কী বলবেন?
ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান: চট্টগ্রাম ও সিলেট হলো উচ্চঝুঁকিতে। ঢাকা থেকে রংপুর বেল্ট হচ্ছে মধ্যম ঝুঁকিতে। এরপর ফরিদপুর হয়ে রাজশাহী অঞ্চল হচ্ছে কম ঝুঁকিতে।
ভূমিকম্পের ঝুঁকির চেয়ে ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করবে মানুষ সৃষ্ট অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে অবকাঠামো তৈরি করা। এমন হতে পারে যে অল্প কম্পনে কোনো কোনো অঞ্চলে বেশি ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, আবার বেশি কম্পনে কম ক্ষতি হয়েছে। কোন অঞ্চলে নিয়ম অনুসরণ করে ভবন বা অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে, তার ওপরই ক্ষতি নির্ধারণ হয়।
সচেতনতার মাধ্যমে ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতি রাখলেই ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে।
এএসএস/এএসএ/জেআইএম