ইউনিসেফ-ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদন

পানি ও স্যানিটেশন সংকটে বেশি দুর্ভোগে নারীরা

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৪৩ পিএম, ০৬ জুলাই ২০২৩

বাসগৃহে পানির সংস্থান না থাকা প্রতি ১০টি পরিবারের সাতটিতে পানি সংগ্রহে নারী ও মেয়েদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এতে করে তাদের নানা ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। পাশাপাশি নিরাপদ স্যাানিটেশন না থাকায় কেউ কেউ যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এসব কারণে তাদের নিয়মিত স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। খাবার পানি এবং স্যানিটেশনও হাইজিন (ওয়াশ) পরিষেবায় লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়ে বিশ্লেষণমূলক এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) ইউনিসেফ ও ডব্লিউএইচও প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, বিশ্বব্যাপী নিজের পরিবারের জন্য পানি সংগ্রহের কাজটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরাই করে থাকেন, যেখানে এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ এবং প্রতিদিন এ কাজের পেছনে তাদের অনেক সময় ব্যয় হয়।

‘পরিবারের খাবার পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন (ওয়াশ) বিষয়ে ২০০০-২২ পর্যন্ত অগ্রগতি: লিঙ্গভিত্তিক বিশেষ দৃষ্টি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ‘ওয়াশ’ পরিষেবায় লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়, নারী ও মেয়েরা বাড়ির বাইরে টয়লেট ব্যবহার করার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনিরাপদবোধ করেন ও স্বাস্থ্যবিধির ঘাটতির প্রভাব ও বৈষম্য অনুধাবন করেন।

এ বিষয়ে ইউনিসেফের ‘ওয়াশ’ ও ‘সিড’ বিষয়ক পরিচালক সিসিলিয়া শার্প বলেন, পানি সংগ্রহের জন্য একটি মেয়ের একটি করে ধাপ এগিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো পড়াশোনা, খেলাধুলা ও নিরাপত্তা থেকে তার একটি করে ধাপ দূরে সরে যাওয়া। অনিরাপদ পানি, অনিরাপদ টয়লেট ও বাড়িতে হাতধোয়ার অনিরাপদ ব্যবস্থা মেয়েদের কাছ থেকে তাদের সম্ভাবনা কেড়ে নেয়, তাদের সার্বিক কল্যাণকে ঝুঁকিতে ফেলে এবং দারিদ্র্যের চক্রকে স্থায়ী করে। ‘ওয়াশ’ কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মেয়েদের চাহিদার প্রতি সাড়া প্রদানের বিষয়টি সর্বজনীন পানি ও স্যানিটেশন পরিষেবা নিশ্চিত করা এবং লিঙ্গসমতা ও ক্ষমতায়ন অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ১৮০ কোটি মানুষ এমন ঘরবাড়িতে বসবাস করে যেখানে বাসগৃহে পানির সংস্থান নেই। এ ধরনের প্রতি ১০টি পরিবারের মধ্যে সাতটিতে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী নারী ও মেয়েরা প্রাথমিকভাবে পানি সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করে। আর এ ধরনের প্রতি ১০টি পরিবারের মধ্যে তিনটিতে তাদের সমবয়সী পুরুষ ও ছেলেদের এ দায়িত্ব পালন করতে হয়।

১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েরা (৭ শতাংশ) ১৫ বছরের কম বয়সী ছেলেদের (৪ শতাংশ) তুলনায় পানি সংগ্রহের দায়িত্ব বেশি পালন করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী ও মেয়েদের পানি সংগ্রহের জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়, যা তাদের পড়াশোনা, কাজ ও অবসর যাপনের সময় কমিয়ে দেয় এবং পথে তাদের শারীরিক আঘাত পাওয়া ও বিপদে পড়ার ঝুঁকিতে ফেলে। প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, ৫০ কোটির বেশি মানুষ এখনো অন্য পরিবারের সঙ্গে স্যানিটেশন সুবিধা ভাগাভাগি করে। নারী ও মেয়েদের গোপনীয়তা, মর্যাদা এবং নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে।

উদাহরণস্বরূপ, ২২টি দেশে পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপের তথ্য বলছে, যেসব পরিবার নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে টয়লেট ব্যবহার করে সেসব পরিবারের নারী ও মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাতের বেলায় একা হাঁটাচলা করতে পুরুষ ও ছেলেদের তুলনায় অনিরাপদবোধ করে এবং যৌন হয়রানি ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির সম্মুখীন হয়। এছাড়া অপর্যাপ্ত ‘ওয়াশ’ পরিষেবা নারী ও মেয়েদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায় এবং নিরাপদে ও ব্যক্তিগতভাবে তাদের মাসিক ব্যবস্থাপনার সামর্থ্যকে সীমিত করে।

উপাত্ত পাওয়া যায়, এমন ৫১টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের নারী ও কিশোরী এবং যারা শারীরিকভাবে অক্ষম তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শারীরিক পরিচ্ছন্নতা ও পোশাক বদলের জন্য ব্যক্তিগত গোপনীয় স্থান থাকে না।

ডব্লিউএইচওর পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক মারিয়া নেইরা বলেন, ডব্লিউএইচওর সাম্প্রতিক তথ্য একটি কঠোর বাস্তবতা তুলে ধরে: অপর্যাপ্ত পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধির কারণে প্রতি বছর ১৪ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। নারী ও মেয়েরা ডায়রিয়া ও তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের মতো শুধু ‘ওয়াশ’ সম্পর্কিত সংক্রামক রোগের সম্মুখীন হয় না, তারা এর বাইরেও বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হয়, কারণ যখন পানি সংগ্রহ বা শুধু টয়লেট ব্যবহার করার জন্য তাদের বাড়ির বাইরে যেতে হয় তখন তারা হয়রানি, সহিংসতা ও আঘাতের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।

প্রতিবেদনে উঠে আসা বিষয়গুলো দেখায় যে, স্বাস্থ্যবিধির অভাবও অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নারী ও মেয়েদের ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক দেশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, খাবার রান্না করা এবং অসুস্থদের দেখাশোনা করাসহ ঘরের কাজ ও অন্যদের যত্ন নেওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে নারী ও মেয়েরাই দায়বদ্ধ থাকে। এটি অনেক ক্ষেত্রে তাদের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে। হাতধোয়াজনিত সুরক্ষার অভাবও তাদের অন্যান্য স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মুখে ফেলে। গৃহস্থালি কাজে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা হলে তা মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা শেষ করার এবং কর্মসংস্থান লাভের সম্ভাবনাকেও সীমিত করতে পারে।

বর্তমানে প্রায় ২২০ কোটি মানুষ বা প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের এখনও বাড়িতে নিরাপদে সংগ্রহ করা খাবার পানির অভাব রয়েছে এবং ৩৪০ কোটি মানুষ বা প্রতি পাঁচজনের মধ্যে দুইজনের নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা নেই। প্রায় দুই কোটি মানুষ বা প্রতি চার জনের মধ্যে একজন বাড়িতে সাবান ও পানি দিয়ে তাদের হাত পরিষ্কার করতে পারে না।

প্রতিবেদনে সবার জন্য ‘ওয়াশ’ পরিষেবা নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে পরিবারগুলোর নিরাপদ খাবার পানি প্রাপ্তির হার ৬৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনার হার ৪৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং মৌলিক স্বাস্থ্যবিধিসেবা ৬৭ থেকে বেড়ে ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

এমএইচএম/এমএএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।