ভূমিকম্প নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই মতানৈক্য

মাসুদ রানা
মাসুদ রানা মাসুদ রানা , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:২৯ এএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩

ঘন ঘন ভূমিকম্পে কাঁপছে বাংলাদেশ। চলতি বছর এই প্রবণতা ছিল বেশি। কোনো কোনো ভূমিকম্পের উৎস দেশের ভেতরে ও ঢাকার আশপাশে। সাত-আট মাত্রার ভূমিকম্পে কয়েক লাখ মানুষ হতাহতের পূর্বাভাস আছে দীর্ঘদিন ধরে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকা। ঝুঁকিতে থাকলেও ভূমিকম্প মোকাবিলায় দেশে দৃশ্যমান বড় কোনো প্রস্তুতি নেই। ছোট ছোট ভূমিকম্পকে বড় কোনো ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বলছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। তবে যুক্তি দিয়ে এর বিরুদ্ধমতও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। আমরা কত মাত্রার ভূমিকম্প ঝুঁকিতে সেটা নিয়েও তাদের মধ্যে আছে মতভেদ।

ভূমিকম্প সৃষ্টির উৎস টেকটনিক প্লেট বাউন্ডারি (দুটি প্লেটের সংযোগস্থল) বা সাবডাকশন জোন (একটি প্লেট আরেকটির নিচে তলিয়ে যাওয়া) কোন এলাকায় রয়েছে সেটি নিয়েও একেকজন বিশেষজ্ঞ একেক ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। ভূমিকম্পের মাত্রা কিংবা সাবডাকশন জোন নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও বাংলাদেশ যে ঝুঁকিতে রয়েছে সেটি নিয়ে কোনো বিশেষজ্ঞের দ্বিমত নেই। তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, কেউ কেউ আতঙ্ক ছড়িয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দিচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে ‘না জেনে ভূমিকম্প নিয়ে বক্তব্য’ দেওয়া অভিযোগ তোলেন অন্যরা।

ভূমিকম্প কোথায় বেশি হয়, বাংলাদেশ কত মাত্রার ঝুঁকিতে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) উপাচার্য সৈয়দ হুমায়ুন আখতার জাগো নিউজকে বলেন, ‘পৃথিবীর যেখানে দুটি প্লেটের সংযোগস্থল সেখানে বেশি ভূমিকম্প হয়। কী পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে, সেটি আপনাকে বুঝতে হবে। কোনো একটি অঞ্চলে ভূমিকম্প কত মাত্রায় হবে সেটার জন্য সেখানে কী পরিমাণ শক্তি কতদিনে জমা হয়ে আছে, সেটা বুঝতে হবে। সেই গবেষণা আমরা করেছি।’

আরও পড়ুন>> বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ৫ ভূমিকম্প

jagonews24

বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান/সংগৃহীত

তিনি বলেন, ‘আমাদের সিলেট থেকে কক্সবাজারের পাহাড়ি অঞ্চল পর্যন্ত সাবডাকশন জোন। ইন্ডিয়ান প্লেট বার্মার প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে তা ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। এটা একবারেও বের হতে পারে, ধীরে ধীরেও বের হতে পারে।’

আমাদেরটা আরও ভয়ংকর, যখন হবে কেয়ামত হয়ে যাবে। তাই ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের পূর্ব লক্ষণ। একটা বাঁশ বা কাঠ বেশি বাঁকালে ভাঙার আগে মড়মড় শব্দ হয়, পরে পুরোটা ভেঙে যায়। সেই মড়মড় শব্দ হচ্ছে ছোট ছোট ভূমিকম্প।- সৈয়দ হুমায়ুন আখতার

ছোট ছোট ভূমিকম্প মানে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি?

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘যারা বলছে, ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমিয়ে দিচ্ছে তাদের ভূমিকম্প সম্পর্কে ধারণাই নেই। জাপান, প্যাসিফিক রিং অব ফায়ার- যেখানে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি ছোট ছোট ভূমিকম্প হচ্ছে প্রতিদিন, তাহলে তো সেখানে বড় ভূমিকম্প হতো না। একই ভূ-তাত্ত্বিক কাঠামো আমাদের এখানেও রয়েছে।’

‘আমাদেরটা আরও ভয়ংকর, যখন হবে কেয়ামত হয়ে যাবে। তাই ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের পূর্ব লক্ষণ। একটা বাঁশ বা কাঠ বেশি বাঁকালে ভাঙার আগে মড়মড় শব্দ হয়, পরে পুরোটা ভেঙে যায়। সেই মড়মড় শব্দ হচ্ছে ছোট ছোট ভূমিকম্প।’

তিনি বলেন, ‘শক্তিটা বের হওয়ার জন্য দুর্বল জায়গাটা সৃষ্টি হতে হবে। এটাই ছোটখাটো ভূমিকম্প। দেখতে হবে এ ছোটখাটো ভূমিকম্প কোথায় হচ্ছে। এগুলো যদি পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ যশোর, রাজশাহীতে হতো- তাহলে আমরা বলতাম না এটার সঙ্গে বড় ভূমিকম্পের সম্পর্ক আছে। এটা হচ্ছে সাবডাকশন জোনে। এজন্যই এটা উদ্বেগজনক। সাবডাকশন জোনটা বাংলাদেশের মধ্যে পড়েছে- সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের হাওর, মেঘনা হয়ে যে পূর্বের অংশটা রয়েছে, সেটাই সাবডাকশন জোন। এই জোনের মধ্যেই ছোটখাটো ভূমিকম্পগুলো হচ্ছে। যদি অনেক পশ্চিমে এ ভূমিকম্পগুলো হতো তাহলে বড় ভূমিকম্পের যোগসূত্র থাকতো না।’

jagonews24

ভূমিকম্পের প্লেট ও বাংলাদেশের অবস্থান/সংগৃহীত

‘যারা ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা করেন না, তাদের কথা আমলে নেওয়ার কিছু নেই’ বলেন এ ভূ-তত্ত্ববিদ।

যে কারণে সাম্প্রতিক ভূমিকম্প

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন ও ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেন্ট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ড. মো. জিল্লুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সম্প্রতি যে ভূমিকম্পগুলো হচ্ছে তা ক্রাস্টাল ফল্ট বা ভূ-ত্বক বিচ্যুতি থেকে হচ্ছে। এটি হচ্ছে পাললিক শিলা বিধৌত অঞ্চলে। পাললিক শিলার বিস্তৃতি ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার। এর নিচে যে শক্ত আগ্নেয় শিলা রয়েছে সেটাকে বলি আমরা ক্রাস্ট। সেটার বিস্তৃতি আবার ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। পুরোটা মিলে এখানে ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটারের মতো বিস্তৃত শক্ত শিলা অঞ্চল রয়েছে। এই শক্ত শিলার মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে ফাটল। ছোট ফাটল আছে মাঝারি ধরনের ফাটলও আছে। এই ফাটলে যখন মুভমেন্ট হয় তখনই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।’

বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস নিয়ে দ্বিমত

এ ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এটা বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্পের পূর্বাভাস নয়। বড় ধরনের ভূমিকম্পের আগে কী হয়, প্লেট বাউন্ডারি লাইন মেনটেইন করে আগে-পিছনে অনেক ভূমিকম্প হবে। ছোট ছোট ভূমিকম্প যখন প্লেট বাউন্ডারিতে হয় তখন আমরা ধরতে পারি বড় একটা ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

ঢাকার আশপাশে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে আসলে কিছু করার নেই। সব ধসে যাবে, সেখানে সচেতন হয়ে কী হবে? ভবনই থাকবে না, মানুষ পিলারের নিচে কীভাবে আশ্রয় নেবে। ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের জন্য তো বাংলাদেশের প্রস্তুতি নেওয়ার কিছু নেই।- ড. মো. জিল্লুর রহমান

আরও পড়ুন>> ভূমিকম্প মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেবেন যেভাবে

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার কোনো ইতিহাস নেই। এখানের কয়েক হাজার বছরের মানুষের সভ্যতায় ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ইতিহাস নেই। যেখানে এমন ইতিহাস নেই, সেখানে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের কথা বলে মানুষকে অহেতুক আতঙ্কিত করার কোনো অর্থ নেই।’

‘ঢাকার আশপাশে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে আসলে কিছু করার নেই। সব ধসে যাবে, সেখানে সচেতন হয়ে কী হবে? ভবনই থাকবে না, মানুষ পিলারের নিচে কীভাবে আশ্রয় নেবে। ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের জন্য তো বাংলাদেশের প্রস্তুতি নেওয়ার কিছু নেই।’

কত মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আমরা?

জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা শহরের ভবনগুলো যদি ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় করতে চাই, এত টাকা কোথায় পাবে দেশ। বাংলাদেশের সেই সক্ষমতা নেই। প্রমাণিত নয়, এমন কোনো বিষয় বলে মানুষকে আতঙ্কিত করে মরার আগেই মেরে ফেলার তো কোনো মানে নেই।’

jagonews24

বড় ভূমিকম্পে তুরস্কের মতো এভাবে গুঁড়িয়ে যেতে পারে ঢাকা শহর

তিনি বলেন, ‘আগে আমরা ৭ মাত্রার একটা ভূমিকম্পের আশঙ্কার কথা বলেছি। এখন যেহেতু ফ্রিকোয়েন্সি বেড়েছে, ৭ বা ৭-এর থেকে কিছু বেশি মাত্রার একটি ভূমিকম্প হতে পারে। ক্রাস্টাল ফল্টে সাড়ে ৭ মাত্রার বেশি বড় ভূমিকম্প হয় না। আমরা যদি সাড়ে ৭ মাত্রা ধরে আমাদের ভবনগুলো তৈরি করি, তাহলে ৭ হলেও তো আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বা ঝুঁকি অনেক কমে যাবে।’

‘আমাদের যদি ৯ মাত্রার কথা বলতে হয় তবে আরও স্টাডি, গবেষণা করে বলতে হবে। এটা খুবই অনিশ্চিত একটা বিষয়। আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারবে না যে, এখানে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হবে।’

এ অধ্যাপক আরও বলেন, ‘সাবডাকশন জোনে একটি প্লেটের নিচে আরেকটি প্লেট চলে যায়। নিচে চলে গেলে একটা চাপ সৃষ্টি হয়, এই চাপে শিলা ভেঙে ভূমিকম্প হয়। ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে হলে কমপক্ষে ৫০০ কিলোমিটার শিলা একসঙ্গে ভেঙে যেতে হবে। একসঙ্গে ৫০০ কিলোমিটার ভেঙে যাবে এটা কী বলা সম্ভব? সেই জ্ঞান এখনো মানুষের নেই।’

আরও পড়ুন>> ভূমিকম্পে তুরস্ক-সিরিয়ার চেয়ে ঢাকা অতিবিপজ্জনক অবস্থায়

এই পূর্ব অংশে ৭ ও সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প অনেক হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে হয়েছে। মণিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমারের অংশে ৭ ও ৮ মাত্রার কাছাকাছি অনেক ভূমিকম্প হয়েছে। তাতে এখানে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। বেশির ভাগ ভূমিকম্পও ওইদিকে (মণিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমার) হচ্ছে। ভূমিকম্পের ম্যাপ দেখলে দেখবেন ওখানে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বেশি। আমাদের এদিকে কমে যাচ্ছে।’

‘সাবডাকশন জোন যেখানে থাকে, সেখানে ভূমিকম্পও বেশি হয়। প্লেট বাউন্ডারি সেটা। এ জোন থেকে যত দূরে যাবো ভূমিকম্পের ইনটেনসিটি ও ডেনসিটি কমবে। ঘন ঘন হওয়া কমবে। আমরা মোটামুটি দূরবর্তী স্থানে আছি।’

ভূমিকম্প মোকাবিলায় আসলে আমাদের খুব বেশি সক্ষমতা নেই। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় আমাদের অর্জন আছে। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় দেড় লাখ মানুষ নিহত হবে, ৫ লাখ মানুষ আহত হবে। ১ লাখ ৭২ হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হবে। জাপানের মতো দেশের ভূমিকম্প সহনীয় দেশে পরিণত করতে ৩০ বছর লেগেছে। সেখানে আমরা চেষ্টা করছি অন্তত ৫০ বছরে হলেও যেন বাংলাদেশ ভূমিকম্প সহনীয় দেশে পরিণত করা যায়।- ত্রাণমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান

অধ্যাপক জিল্লুর বলেন, ‘আমরা মনে করি বাংলাদেশ থেকে উত্তর-পূর্বে ভারত, মিয়ানমারের সীমানায় প্লেট বাউন্ডারি। আমাদের এখানেও ভূমিকম্প হয়। সেটা প্রতিদিন নয়। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যত পূর্ব দিকে যাবো, দেখবো প্রতিদিনই ভূমিকম্প হয়।’

যা বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রুবাঈয়্যাৎ কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এখানে আগে বড় ভূমিকম্প হয়েছে। ভবিষ্যতেও হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দুটি টেকটনিক প্লেটের মধ্যেই আমরা আছি। ভূমিকম্পের জন্য অনেকগুলো ফল্ট (ভূ-ত্বক চ্যুতি) লাগে, বাংলাদেশের মধ্যে ও বাইরে এ ফল্ট আছে।’

তিনি বলেন, ‘বড় ভূমিকম্পগুলো সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময় পরে আবার হয়। সেটা ৫০ বছর, ১০০ বছর হতে পারে। এ প্রেক্ষাপট যদি ধরি তবে, আমাদের এখানে বড় ভূমিকম্প বেশ অনেক আগে হয়েছে- কোনোটা ৭০ বছর, কোনোটা ১০০ বছর, কোনোটা দেড়শ বছর আগে হয়েছে। সেই হিসেবে আমাদের এখানে বড় একটা ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে। বিষয়গুলো বিবেচনা করেই বিশেষজ্ঞরা মূলত পূর্বাভাসগুলো দিচ্ছেন।’

jagonews24

ঢাকা শহর

আবহাওয়াবিদ রুবাঈয়্যাৎ কবির আরও বলেন, ‘ইদানীংকালে ৭/৮টির মতো ভূমিকম্প হয়েছে, যেগুলোর কেন্দ্র বাংলাদেশের মধ্যে। ছোট ছোট ভূমিকম্প বাংলাদেশে যে নতুন হচ্ছে তা নয়, আগেও হয়েছে। তবে সেভাবে হয়তো প্রচার পেতো না। আমরা এখন যে কোনো মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করতে পারি।’

সরকারের করণীয়

সৈয়দ হুমায়ুন আকতার বলেন, ‘ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য সরকার ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছে। কোটি কোটি টাকা ভূমিকম্প উদ্ধার কাজের প্রস্তুতিতে ব্যয় করছে। কিন্তু ভূমিকম্পের সময় মানুষকে কীভাবে নিরাপদ রাখতে হবে, সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে কোনো রকম পদক্ষেপ নেই সরকারের।’

তিনি বলেন, ‘স্মার্টফোনের মাধ্যমে আমরা একটা গেম ডেভেলপ করতে পারি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় সেগুলো ধাপে ধাপে সেখানে শিখবো। ভূমিকম্প হলে আমি যাতে দু-এক কদমের মধ্যে নিরাপদ জায়গার মধ্যে আশ্রয় নিতে পারি। আমি সেই গেমের মধ্যেই শিখবো নিরাপদ জায়গা কোনগুলো।’

আরও পড়ুন>> জীব-জন্তু কি ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারে?

অধ্যাপক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘গ্রাউন্ড মোশন নির্ধারণ করে আমাদের বিল্ডিং কোড আপডেট করতে হবে। আগামী দিনগুলোতে স্থাপনা করতে হবে এ বিল্ডিং কোড অনুযায়ী। এগুলো হলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এটা হলো মূল কাজ।’

তিনি বলেন, ‘এরপর হলো সচেতনতা। মানুষকে সচেতন করতে হবে। ভূমিকম্প হলে মানুষ দৌড়াদৌড়ি করে, লাফ দিয়ে আহত হয়, মারা যায়। এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। ছোট ভূমিকম্প হলে কোথায় আশ্রয় নিতে হবে, সেটা সাইকে জানাতে হবে। অবশ্য বড় ভূমিকম্প হলে করার কিছু থাকে না।’

এ অধ্যাপক বলেন, ‘সচেতনতার জন্য সরকারকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, করপোরেট, কোম্পানিসহ সব পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বড় ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য আমাদের ইমার্জেন্সি রেসপন্সগুলোকে আপডেট করতে হবে। ফায়ার সার্ভিসকে আরও যন্ত্রপাতি দিতে হবে। এগুলো করলে আমরা একটা ভূমিকম্প সহনীয় দেশ হতো পারবো।’

‘আমাদের যে পরিস্থিতি, ঢাকা শহরের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। বেশির ভাগ ভবন ধসে যেতে পারে’ বলেন ঢাবির ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেন্ট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক।

সরকারে প্রস্তুতি

ভূমিকম্প মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগ খুবই অপ্রতুল। উল্লেখযোগ্য দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেই। কিছু অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা পর্যন্তই কাজ শেষ। জাপানের সহায়তায় ভবনগুলোকে ভূমিকম্প সহনীয় করার বিষয় বহু বছর ধরে আলোচিত হচ্ছে। এ বিষয়েও কোনো অগ্রগতি নেই। সচেতনতা সৃষ্টির জন্যও নেই কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ।

ঢাকা মহানগরীর বিপুলসংখ্যক স্থাপনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া বা অনুমোদন সত্ত্বেও অনুমোদনের শর্তাবলি লঙ্ঘন করে নির্মাণ করা হয়েছে। ২০২০ সালের বিল্ডি কোড বাস্তবায়নে সরকার এখনো কঠোর নয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, ‘ভূমিকম্প মোকাবিলায় আসলে আমাদের খুব বেশি সক্ষমতা নেই। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় আমাদের অর্জন আছে।’

তিনি বলেন, ‘৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় দেড় লাখ মানুষ নিহত হবে, ৫ লাখ মানুষ আহত হবে। ১ লাখ ৭২ হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হবে। জাপানের মতো দেশের ভূমিকম্প সহনীয় দেশে পরিণত করতে ৩০ বছর লেগেছে। সেখানে আমরা চেষ্টা করছি অন্তত ৫০ বছরে হলেও যেন বাংলাদেশ ভূমিকম্প সহনীয় দেশে পরিণত করা যায়। সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ‘আমরা ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি। ‘ভূমিকম্প ও অন্য দুর্যোগকালে অনুসন্ধান, উদ্ধার অভিযান পরিচালনা এবং জরুরি যোগাযোগের জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহ প্রকল্প (৩য় পর্যায়)’ একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। আগামীতে আমরা সচেতনতা বাড়ানোর দিকে জোর দেবো।’

‘ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগে অনুসন্ধান, উদ্ধার অভিযান পরিচালনা ও জরুরি যোগাযোগের জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহ’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম-সচিব) কাজী শফিকুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করছে। মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ২৭৫ কোটি ৯৯ লাখ ১০ হাজার টাকা। এটি আগামী বছরের অক্টোবরে শেষ হবে। প্রকল্পের আওতায় কেনা যন্ত্রপাতি/সরঞ্জামাদি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রাম, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, বাংলাদেশ পুলিশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র‌্যাব) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি)- মধ্যে উদ্ধার কাজে ব্যবহারের জন্য বিতরণ করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের জন্য কমপক্ষে ৬৪ মিটারের দু’টি, কমপক্ষে ৫৪ মিটারের চারটি এবং কমপক্ষে ৩৮ মিটারের পাঁচটিসহ মোট ১১টি এরিয়েল প্ল্যাটফর্ম ল্যাডার কেনা হচ্ছে। সিপিপির স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য ভেস্ট, রেইন কোট, হার্ড হ্যাট, গামবুট, লাইফ জ্যাকেট এরই মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় মোটরযান, কার্ভাডভ্যান, ইমার্জেন্সি রেসপন্স ভেহিক্যাল, আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স, ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স, স্পিডবোট, তাঁবু ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি, টেলিযোগাযোগ সরঞ্জামাদি ও অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামাদি কেনা হবে বলেও জানান প্রকল্প পরিচালক।

আরএমএম/এএসএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।