জাবিতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

বহিরাগত মামুনের মাদকের হটজোন জাবি, হলেই বসতো আসর

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:৫৬ পিএম, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বহিরাগত হয়েও নিয়মিত যাতায়াত ছিল সম্প্রতি এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মূল পরিকল্পনাকারী মো. মামুনুর রশিদ ওরফে মামুনের (৪৪)। মাদক কারবারি মামুন নিয়মিত কক্সবাজার থেকে ইয়াবা এনে বিক্রি করতেন। মামুনের ইয়াবা বিক্রির হটজোন ছিল জাবি ক্যাম্পাস, বিশেষ করে ক্যাম্পাসের বটতলায়।

আলোচিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলরুমের একটি কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মূল পরিকল্পনাকারী মামুনুর রশিদ ওরফে মামুনকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে এবং ধর্ষণের অন্যতম সহায়তাকারী মো. মুরাদকে নওগাঁ থেকে গ্রেফতারের পর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য জানায় র্যাব।

মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র্যাব বলছে, মাদক কারবারি মামুন ২০১৭ সাল থেকে জাবি ক্যাম্পাসের সিনিয়র প্রভাবশালী শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় ক্যাম্পাসে মাদক কারবার করতেন। হর-হামেশাই ক্যাম্পাসে নারী নিপীড়ন ধর্ষণসহ শ্লীলতাহানির ঘটনায় জড়িত তিনি।

বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব কথা জানান।

তিনি বলেন, গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

পরবর্তীতে ঘটনার দিন রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৪ জনকে আটক করে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বামী বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। চাঞ্চল্যকর এ ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় নিয়ে এসে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানবন্ধব, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে র্যাব।

এরই ধারাবাহিকতায়, বুধবার রাতে র্যাব-২, র্যাব-৪ এবং র্যাব-৫ এর অভিযানিক দল রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে চাঞ্চল্যকর গণধর্ষণের মূলপরিকল্পনাকারী মো. মামুনুর রশিদ ওরফে মামুন (৪৪) এবং অন্য একটি আভিযানিক দল নওগাঁ সদর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে অন্যতম আসামি মো. মুরাদকে (২২) গ্রেফতার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা ধর্ষণের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য দেন।

গ্রেফতাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, গ্রেফতার মামুন প্রায় ৬/৭ বছর ধরে মাদক কারবারির সঙ্গে জড়িত। মামুন কক্সাবাজারের টেকনাফ থেকে প্রতি মাসে কয়েক দফায় প্রায় ৭/৮ হাজার ইয়াবা সংগ্রহ করে তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশকিছু মাদকসেবী শিক্ষার্থীকে সরবরাহ করতেন।

এছাড়াও মামুন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মাদক বিক্রির সুবাদে মামলার ১ নম্বর আসামি মোস্তাফিজুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র ছাত্রদের সঙ্গে তার সখ্যতা তৈরি হয়। মামুন মাঝে-মধ্যে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে মাদকসহ রাত্রিযাপন করতেন এবং অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে মাদক সেবন করতেন।

jagonews24

গ্রেফতার মামুনের সঙ্গে ভুক্তভোগীর স্বামীর একই এলাকায় বসবাসের কারণে ৩/৪ বছর আগে তাদের মধ্যে পরিচয় হয়। পরিচয়ের সুবাদে মামুন মাঝে মধ্যে ভুক্তভোগীর স্বামী জাহিদ মিয়া ওরফে রবিনের মাধ্যমেও বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশেপাশের এলাকায় মাদক সরবরাহ করাতেন।

কমান্ডার মঈন বলেন, কিছুদিন আগে গ্রেফতার মামুনের থাকার জায়গার সমস্যা সৃষ্টি হলে ভুক্তভোগীর স্বামীকে ফোন দিয়ে কিছুদিনের জন্য তাদের বাসায় অবস্থান করবে বলে জানায়। পরবর্তীতে গ্রেফতার মামুন ভুক্তভোগীর ভাড়া করা বাসায় সাবলেট হিসেবে প্রায় ৩-৪ মাস অবস্থান করায় ভুক্তভোগী নারীর পরিবারে সঙ্গে তার সখ্যতা তৈরি হয়। ঘটনার আগে মোস্তাফিজুর মামুনের কাছে অনৈতিক কাজের ইচ্ছা পোষণ করলে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক মামুন গত ৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ভুক্তভোগীর স্বামীকে ফোন দিয়ে জানায় মোস্তাফিজুর রহমান নামের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে তার থাকার ব্যবস্থা করেছে বিধায় সে এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হলে থাকবে।

তাই গ্রেফতার মামুন ভুক্তভোগীর স্বামী জাহিদকে মোস্তাফিজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে বলে। ভুক্তভোগীর স্বামী গ্রেফতার মামুনের কথামতো ওইদিন সন্ধ্যার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষে দেখা করে। পরবর্তীতে মামুন ভুক্তভোগীর স্বামীকে তার অন্যতম সহযোগী মোস্তাফিজ, মুরাদ, সাব্বির, সাগর সিদ্দিক ও হাসানুজ্জামানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা আরও জানায়, মামুন কৌশলে ভুক্তভোগীর স্বামীকে তাদের বাসায় থাকাকালীন তার ব্যবহৃত কাপড় আনতে তার স্ত্রীকে (ভুক্তভোগী) ফোন দিতে বলে। পরবর্তীতে ভুক্তভোগীর স্বামী ভুক্তভোগীকে ফোন করে মামুনের ব্যবহৃত কাপড় একটি ব্যাগে করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে আসতে বলে। রাত ৯টার দিকে ভুক্তভোগী তার স্বামীর কথামতো মামুনের ব্যবহৃত কাপড় একটি ব্যাগে করে মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে আসেন। ওই সময় পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক মামুন ও মামলার ১ নম্বর আসামি মোস্তাফিজ কৌশলে মুরাদকে ভুক্তভোগীর স্বামী ও মামুনের ব্যবহৃত কাপড়ের ব্যাগসহ হলের ৩১৭ নম্বর রুমে নিয়ে যেতে বলে।

তিনি বলেন, পরবর্তীতে গ্রেফতার মুরাদ ভুক্তভোগীর স্বামীকে নিয়ে হলের রুমে অবস্থান করে। এসময় মামুন ও মামলার ১ নম্বর আসামি মোস্তাফিজ ভুক্তভোগীকে কৌশলে হলের পাশে নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে জোর করে পর্যায়ক্রমে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। এরপর ভুক্তভোগীকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে বাসায় চলে যেতে বলে। গ্রেফতার মামুন ও মোস্তাফিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের রুমে গিয়ে ভুক্তভোগীর স্বামীকেও বাসায় চলে যেতে বলে। পরবর্তীতে ভুক্তভোগীর স্বামী ভুক্তভোগীর কাছ থেকে গণধর্ষণের ঘটনা জানতে পেরে থানায় গিয়ে মামলা করেন।

এ ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে গ্রেফতার মামুন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার এড়াতে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় আত্মগোপন করে। মুরাদ ধর্ষণের বিষয়টি ঘটনার সময় না জানলেও থানায় মামলা রুজু হওয়ার পর সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর থেকে গ্রেফতার এড়াতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালিয়ে নওগাঁ এলাকায় আত্মগোপনে থাকে।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, গ্রেফতার মামুন প্রায় ২০ বছর আগে ঢাকার জুরাইন এলাকায় এসে গার্মেন্টসকর্মী হিসেবে চাকরি নেয়। পরে সে আশুলিয়া এলাকায় গার্মেন্টসের চাকরির পাশাপাশি মাদক কারবারির সঙ্গে জড়িত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মাদকসেবী শিক্ষার্থীকে মাদক সরবরাহ করার ফলে তাদের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি হয়। পরবর্তীতে তিনি গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে ২০১৭ সাল থেকে পুরোপুরি মাদক কারবারিতে জড়িত হয়। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় মাদক সংক্রান্তে ৮টি মামলা রয়েছে এবং এর আগে এসব মামলায় একাধিকবার কারাভোগও করেছে।

গ্রেফতার মুরাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকতেস। তার বিরুদ্ধে নওগাঁ থানায় মারামারি সংক্রান্তে একটি জিডি রয়েছে বলে জানা যায়।

এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, মামুন নিয়মিত কক্সবাজার থেকে মাদক আনতেন। তার মাদক কারবারের হটজোন ছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে বটতলা এলাকা। ক্যাম্পাসে তিনি মাদক বিক্রি ছাড়াও প্রায়শই ক্যাম্পাসে নারীদের হেনস্তা, নিপীড়ন ও শ্লীলতাহানিসহ ধর্ষণে ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তবে ভুক্তভোগী অনেক নারীকে ভয়-ভীতির কারণে বিষয়টি প্রকাশ করেননি।

টিটি/এমআইএইচএস/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।