দূষণে নাকাল ঢাকাবাসী, সতর্কতায় নেই উদ্যোগ

রায়হান আহমেদ
রায়হান আহমেদ রায়হান আহমেদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
ছবি- জাগো নিউজ

• বছরের অধিকাংশ সময় অস্বাস্থ্যকর থাকে ঢাকার বাতাস
• ২০২৩ সাল ছিল আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর বছর
• তীব্র বায়দূষণে রোগাক্রান্ত হচ্ছে শহরবাসী
• নতুন বছরের ৯ দিন সারাবিশ্বে বায়ুদূষণের শীর্ষে ছিল ঢাকা

বায়ুদূষণে নাকাল রাজধানী ঢাকার মানুষ। অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, তীব্র যানজট, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়ায় বেড়েই চলছে দূষণের মাত্রা। তীব্র বায়দূষণে রোগাক্রান্ত হচ্ছে শহরবাসী। বিশেষ করে শিশু ও প্রবীণদের ভোগান্তির শেষ নেই। বায়ুদূষণের এমন ভয়াবহ অবস্থার মধ্যেও এর ক্ষতি থেকে নগরবাসীকে সতর্ক করতে কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই।

বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০২২ এ বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় বায়ুর মানমাত্রা অস্বাস্থ্যকর, অতি অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছালে তা থেকে জনসাধারণকে রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর জনগণকে সতর্কবার্তা দেবে এবং জনগণকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেবে। এই আইন প্রণয়নের প্রায় দুই বছর পার হলেও জনগণকে সতর্কবার্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক পরামর্শের কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর।

আদালতের নির্দেশের পরও চালু হয়নি বায়ুদূষণ ‘অ্যালার্ট পদ্ধতি’

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) সূত্রে জানা গেছে, বায়ুদূষণ কমাতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেলা একটি রিট করে। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রুল দিয়ে কয়েক দফা নির্দেশনাসহ আদেশ দেন।

আরও পড়ুন
কমছে আয়ু, মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণের মাশুল দিচ্ছে ঢাকাবাসী
কর্মকর্তাদের সন্তানরা বিদেশে, তাই বায়ুদূষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই

নির্দেশনায় বায়ুদূষণের বড় উৎসের পাশাপাশি সবচেয়ে দূষিত এলাকা চিহ্নিত করে তার তালিকা এবং দূষণ কমাতে পরিকল্পনা দাখিল করতে বলা হয়। উপযুক্ত স্থানে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত ‘কন্টিনিউয়াস এয়ার মনিটরিং স্টেশন (সিএএমএস)’ বসানো এবং বিপজ্জনক অস্বাস্থ্যকর বায়ু থেকে জনগণকে রক্ষায় অ্যালার্ট পদ্ধতি চালু করতে বলা হয়।

২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দেওয়া ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন চেয়ে গত মাসে বেলা সম্পূরক আবেদন করে। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি বায়ুর মানমাত্রা অস্বাস্থ্যকর, অতি অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছালে তা থেকে জনসাধারণকে রক্ষায় নির্দেশনা-সংবলিত অ্যালার্ট পদ্ধতি চালুর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে বেলার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এস হাসানুল বান্না। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সেলিম আযাদ।

যদিও এই অ্যালার্ট সিস্টেমের বিষয়ে এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তর। অ্যালার্ট সিস্টেম চালুর পরিকল্পনা নিলেও বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট সময়সীমা দিতে পারেনি তারা।

বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (আইকিউএয়ার) সূচক অনুযায়ী বছরের অধিকাংশ সময় অস্বাস্থ্যকর থাকে ঢাকার বাতাস। এদিকে ২০২৩ সাল ছিল আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর বছর। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বায়ুমান সূচকে ঢাকার গড় নম্বর (স্কোর) ছিল ১৭১, যা আগের বছর ছিল ১৬৩। নতুন বছর ২০২৪ এর জানুয়ারির ৯ দিন সারাবিশ্বে বায়ুদূষণের শীর্ষে ছিল রাজধানী ঢাকা, যা দেশের ইতিহাসে গত সাত বছরে সর্বোচ্চ।

আরও পড়ুন
কোন এলাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা কত, জানাতে বললেন হাইকোর্ট
শব্দদূষণে নাকাল ঢাকাবাসী, আইন প্রয়োগ ঢিমেতালে

এ বিষয়ে বেলার আইনজীবী এস হাসানুল বান্না জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের রিটের পর পরিবেশ অধিদপ্তর কিছু ক্যাম্প বানিয়েছে। নিয়মিত ওয়েবসাইটে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্কের (একিআইয়ের) তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসেও আমরা দেখেছি ঢাকার বায়ু খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং কিছুদিন বিপজ্জনক পর্যায়ে ছিল। অতি অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক থাকা সত্ত্বেও জনসাধারণকে সতর্ক করার জন্য আদালতের নির্দেশ ও বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা অনুযায়ী কোনো ধরনের সতর্কবার্তা দেয়নি।’

আদালতের নির্দেশের পরও চালু হয়নি বায়ুদূষণ ‘অ্যালার্ট পদ্ধতি’

তিনি বলেন, ‘আমরা যদি দেখি আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে বায়ুদূষণে অ্যালার্ট পদ্ধতি চালু আছে। সেখানে বায়ুদূষণের মান মাত্রা অতিক্রম করলে স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে এবং জনগণকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের রিটের আবেদনে পরিবেশ অধিদপ্তর এখনো কিছু পরিকল্পনা দাখিল করেনি।’

সার্বিক বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা শাখার পরিচালক মো. জিয়াউল হক জাগো নিউজ বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের মিটিং হয়েছে। রিট অনুযায়ী যে স্বাস্থ্যবার্তার কথা তারা বলেছে, এটা আমরা শিগগির চালু করবো। আমাদের পরিকল্পনা হলো একিউআই যদি ৩০০ অতিক্রম করে তাহলে বার্তাটা অটোমেটিক চলে যাবে। আবার পরিস্থিতি ভালো হলেও চলে যাবে। প্রাথমিকভাবে অ্যালার্টটা দেবো সরকারি বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। এটা দিয়ে আমরা শুরু করবো। আমরা টিভিতে স্ক্রল করে বার্তা দিতে চাচ্ছি। এছাড়া মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে দেওয়া যাবে। তবে এই প্রক্রিয়াটা দীর্ঘসময়ের ব্যাপার। আমরা চেষ্টায় আছি।’

অ্যালার্ট পদ্ধতি চালুর জন্য বিলবোর্ড বসানো হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অ্যালার্ট পদ্ধতি চালুতে দূষিত জায়গায় আমাদের বিলবোর্ড স্থাপনের চিন্তা আছে। শহরের যে স্থানের বায়ুমান স্কোর অনুযায়ী খুবই অস্বাস্থ্যকর বা বিপজ্জনক হবে সেখানে বিলবোর্ডে সতর্কতা বার্তা থাকবে। যে এলাকায় বায়ুদূষণ বেশি সেখানে বিলবোর্ড হবে। এ বিষয়ে আমাদের ছোট একটি কমিটিও হয়েছে। সেখানে মন্ত্রীর (পরিবেশমন্ত্রী) কাছে আমরা বিষয়গুলো উল্লেখ করেছি।’

আরও পড়ুন
বায়ুদূষণ রোধে নেওয়া প্রকল্প সফল করার নির্দেশ পরিবেশমন্ত্রীর

জিয়াউল হক বলেন, ‘ফোরকাস্টিং পদ্ধতি চালুর পরিকল্পনা আছে আমাদের। আগামী দু-তিনদিনের পরিস্থিতি কেমন হবে সেটা জেনে একটা স্বাস্থ্যবার্তা দেওয়া। পূর্বাভাস জেনে জানাবো যে, কাল পরিস্থিতি কী রকম থাকবে। সেখানে সবাইকে মাস্ক পরে বের হওয়া ও বৃদ্ধ-শিশুরা ঘর থেকে যেন বের না হন সেরকম বার্তা দেবো। পূর্ভাবাসটা শিগগির চালু হবে।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট শাখার উপ-পরিচালক সৈয়দ আহমদ কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘রিটের পর থেকে এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা নিয়েছে অধিদপ্তর। গত নভেম্বর থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) রিপোর্ট নিয়মিত দেওয়া হয়। অ্যালার্ট পদ্ধতি চালু করা দীর্ঘসময়ের ব্যাপার। মহাপরিচালকসহ আবার মিটিং করে পরিকল্পনা নেওয়া হবে কীভাবে কাজটা শুরু করা যায়।’

আরএএস/ইএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।