বাঙালির মুখ চাবুক!

নাজনীন মুন্নী
নাজনীন মুন্নী নাজনীন মুন্নী , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৫:১৭ পিএম, ১১ ডিসেম্বর ২০১৮

বাঙালির একটা অসাধারণ জিনিস আছে। সেটা হলো মুখ। মুখের কথায় নাকি চিড়ে ভিজে না। কিন্ত অন্তত আমাদের জন্য এই প্রবাদ এখন আর কার্যকর না। আমাদের মুখের কথায় আমরা বিশ্ব জয় করি। মুখের কথায় একজনকে বিচার করি,মুখের কথায় অনেক অসাধ্য সাধন করি।

সবচে’ বেশি যেটা করি তা হলো মানুষকে নৃশংস অত্যাচার। আমাদের জিহ্বা ভয়াবহ শক্তি শালী। চাবুকের চেয়ে বেশি। এই চাবুক এমন যে তার দাগ কেবল শরীর না মনে পড়ে সবচে বেশি। শরীরের যন্ত্রণা তবু মলম সারে। কিন্তু মনের দাগ গুলো সারে না কিছুতেই।

এই যে অরিত্রী। মরে গেছে। কারণ সে জানতো বেঁচে থাকলেও তাকে মরেই যেতে হবে প্রতিদিন। সব কিছুত শুনতে হবে বাবা মার খোটা, তার সাথে আছে স্বজন নামের সবচে’ ভয়াবহ দুর্জন ,যারা উঠতে বসতে কথার চাবুক চালাতো- কি খারাপ মেয়েরে বাবা! আছে পাড়া প্রতিবেশি তাকে দেখে ফিসফাস গুজ গুজ। আছে বন্ধু নামের টিপ্পন কাটা সহপাঠি। এত মুখ পাশ কাটিয়ে বা অবজ্ঞা করে আসলেই কি বেঁচে থাকতো অরিত্রী?

অরিত্রী মরেছে। আমরা অনেকে মরি। প্রতিদিন। প্রতিমুহূর্ত ভয়াবহ সব কথার চাবুক খেতে খেতে। তিলে তিলে মরি। আমাদের সাহস হয় না একবারে মরে যেতে। আমরা প্রতিদিন বাঁচি পরের দিন অন্যের মুখের চাবুক খাওয়ার জন্য। আমরা বাঙালিরা এমন এক জাতি। যাদের প্রধান কাজ অন্যে কি করে, অন্যে কি পড়ে, অন্যে কেমন কর চলে অন্যের কয়টা প্রেম। অন্যের পরকিয়া কার সাথে। সারাক্ষণ সারা দিনমান তা নিয়ে থাকি। এবং কথার চাবুক বানাতে থাকি শক্ত করে। যে যত জোরে চাবুক ছোড়ে সে মনে কর তিনিই সমাজের সবচে’ বড় সেবক। তিনিই এমন মোড়ল যে সমাজকে তার মুখের চাবুকে সোজা করে ফেলবে। যতনা অন্যায়, যতনা পাপ তার চেয়ে বেশ শাস্তি আমরা সবাই ভোগ করি এই মুখের যন্ত্রণায়। এত বিষ বাঙালির মুখে , সাপের বিষের চেয়েও ভয়াবহ।

অরিত্রীকে বেত মারা হয়নি। গায়ে হাত তোলা হয়নি। কেবল কথা শুনানো হয়েছ। আমি অবাক হয়ে ভাবি সে কথার তীব্র্রতা কত ভয়াবহ না জানি। আমরা না হয় সাধারণ মানুষ, হিন্দি সিরিয়াল দেখে কূট চাল আর কটুকথা শিখে মানুষের উপরের ছাল তুলে নেই। কিন্তু যারা শিক্ষক তারা? তাদের সংস্কৃতি বোধ শিক্ষার গুণ কোথায় যে তাদের মুখ সংবরণ হয় না?

যারা মুখের লাগাম টানতে জানেন না তারা কিভাবে আমাদের শিশুদের লাগাম ধরবে আমি ভেবে পাইনা। এমন অপমান আমাদের বাচ্চারা সয়। বেত এর দাগ নিয়ে বাড়ি ফেরে না এখন কোনো শিশু। কিন্তু কথার চাবুকে মনে যে ভয়াবহ দাগ পড়ে সেই খবর আমরা রাখি ক’জনা?

প্রতিদিনই এমন কম বেশি মুখের অত্যাচার সইতে হয় সবাইকে। কিন্তু সেই অত্যাচার মিসাইল হয়ে পড়ে যখন কোনো ভুল হয় বা কেউ বিপদে পড়ে। মুখের কথা অবজ্ঞা করে যারা চলে তাদের বিপদ আরো এক দফা বেশি । যে মানুষটির নাম নেয়ারও সাহস হওয়ার কথা নয় তার নামে বদনামের ডিব্বা খুলে বসে সমাজ রক্ষাকারীরা।

মুখের কথায় সপাং কর বেত মারতে থাকে তারা প্রকাশ্যে। মুখ দিয়ে জামা কাপড় সব আব্রু, যুগ ধরে গড়া সম্মান সব টেনে হিঁচড়ে তারা ছিড়তে থাকে ধর্ষণ কারীর মতো। বিপদে পড়া মানুষ তখন হয় আরো অসহায়। দিগ্বিদিক শূন্য। সেই চাপ সেই মুখের অত্যাচার সইতে পারে না অনেকেই। সে ভাঙে, ভাঙে তার মন আর আত্মবিশ্বাস।

আমাদের মুখ হচ্ছে সবচে বড় ভয়াবহ অস্ত্র। অন্যকে অবদমিত, অপমানিত, আত্মবিশ্বাস কেড়ে নিয়ে শূন্য মানুষে পরিণত করার অস্ত্র। আমাদের সুখ, আনন্দ আর বেঁচে থাকা কেড়ে নিতে এই এক অস্ত্রই যথেষ্ট। মানুষের এইমুখের ভয়ে আমরা বেঁচে থাকা ভুলে যাচ্ছি। আমরা ফুল হয়ে ফোটা ভুলে যাচ্ছি, নিজের পছন্দের খাবার, পছন্দের পোশাক, ভালোলাগার জীবন ভুলে যাচ্ছি।

আমরা আমাদের ভুলে যাচ্ছি। আমরা জন্মাই তারপর জীবন ভর ভাবি মানুষ কি বলবে। তারপর মরে যাই। আমরা প্রাণ খুলে আনন্দ নিয়ে বাঁচতে চাই। মাননীয়রা আপনার কেবল আপনার সাপের জিভওয়ালা ধারালো মুখটা বন্ধ রাখুন। নিজে বাঁচুন, সবাইকে তার জীবন নিযে বাঁচতে দিন। যাতে অরিত্রীর মতো মেয়েরা মানুষ কি বলবে এই ভয়ে জীবনটাই না ভুলে যায়।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

‘অরিত্রীকে বেত মারা হয়নি। গায়ে হাত তোলা হয়নি। কেবল কথা শুনানো হয়েছ। আমি অবাক হয়ে ভাবি সে কথার তীব্র্রতা কত ভয়াবহ না জানি। আমরা না হয় সাধারণ মানুষ, হিন্দি সিরিয়াল দেখে কূট চাল আর কটুকথা শিখে মানুষের উপরের ছাল তুলে নেই। কিন্তু যারা শিক্ষক তারা? তাদের সংস্কৃতি বোধ শিক্ষার গুণ কোথায় যে তাদের মুখ সংবরণ হয় না? ’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।