করোনার সামাজিক উপযোগ : আমাদের করণীয়

সাব্বির পারভেজ ও শবনম নাহার
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ও চর্চিত বিষয় হচ্ছে করোনাভাইরাস এবং এর থেকে কীভাবে আমরা মুক্তি পেতে পারি। যেকোনো রোগের বিস্তারের সাথে বৈশ্বিক প্রভাব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের চলাচল, অপ্রত্যাশিত অভিবাস যেমন আটকানো সম্ভব নয় তেমনই রোগের বিস্তারও; কারণ এটি কোনো ধর্ম-জাত-কাল মানে না। মিডিয়ার প্রভাবেও মানুষের মধ্যে নানা প্রকার বিভ্রান্তিমূলক ও ভুল তথ্য আদানপ্রদানের হার বেড়ে যায়। অপরদিকে এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণা মানুষের মাঝে অপরাপর দেশ এবং সে দেশের মানুষ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা এবং অপছন্দের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয় এবং ফলাফলস্বরূপ দেশটি নানাভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে; যাকে জেনোফোবিয়া বলা হয়।
চীনের মানুষদের খাদ্যাভ্যাস এবং তাদের জীবনাচার সম্পর্কে অপরাপর দেশ ও সমাজে গৎবাঁধা কিছু ধারণা প্রতিষ্ঠিত আছে এবং সে কারণে তাদের সংস্কৃতিকে কিছু ক্ষেত্রে আমরা ‘অদ্ভূত’ বলে বিবেচনা করি। কিন্তু কোন প্রেক্ষাপটে কিংবা কীভাবে এই করোনা রোগের বিস্তার ঘটল সে বিষয়ে রোগতাত্ত্বিক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাশাপাশি সামাজিক গবেষণারও দাবি রাখে। কারণ রোগের বিস্তরণের সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও জড়িত; সেটি কেবল রোগতাত্ত্বিক ও চিকিৎসা বৈজ্ঞানিক গবেষণা দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট ফুলিলাভের আলোচনায়ও এ বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি বলেন, মানুষ যত বেশি প্যানিক হবে, তত বেশি তারা বহিরাগতদের অভিযোগ করবে এবং তত বেশি তারা ‘অন্য’ হয়ে উঠবে। এ অবস্থায় রোগীরাও প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এতদিন চীন থেকে উদ্ভূত করোনা রোগকে কেন্দ্র করে বাদবাকি বিশ্বের মানুষের মধ্যে এই বিচ্ছিন্নতার ধারণা প্রতিষ্ঠিত ছিল; কাল যখন অপরাপর দেশেও ছড়িয়ে পড়ল, তখন এই বিচ্ছিন্নতার মাত্রাও বেড়ে যেতে থাকল। এই বিচ্ছিন্নতা শুধু সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক নয়, ব্যক্তিকও বটে।
এখন সবাই যদি আমরা অস্থির হয়ে যাই, তাহলে কি আমরা মুক্তি পাব? নিশ্চই আমরা এই সংকট থেকে এভাবে মুক্তি পাব না। আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে খুব সতর্কভাবে বিষয়টিকে মোকাবিলা করতে হবে। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী কাথেরিন ম্যাসনের মতে, পাবলিক প্যানিক নিয়ন্ত্রণ করাই এখন সবচেয়ে বড় ব্যাপার। এই সময় এটি করতে পারলে যারা এর চিকিৎসার সাথে জড়িত তারা অনেক সহজেই তাদের কাজ সম্পাদন করতে পারবেন। নৃবিজ্ঞানী ম্যাসন আরও একটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেন সেটি হচ্ছে, সরকারকে এই সময় মহামারি মোকাবিলায় তাদের কাজের ক্ষত্রে লুকোচুরি ব্যাপারটি পরিহার করতে হবে। মানুষকে সত্য জানতে দিতে হবে। তা না করা হলে আমাদের মতো দেশে মানুষ যেখানে চাঁদে সাঈদী সাহেবকে দেখা যায় বলে সংঘর্ষে মারা যায়, সেখানে এই আন্তঃদেশীয় মহামারি মোকাবিলা অনেক কঠিন একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
আমরা এখনো জাতি হিসেবে ওইভাবে সচেতন নই অথবা জানি না যে, কীভাবে এ রকম মহামারির সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করতে হয়; আমরা যে যেভাবে পারছি নিজেদের ধারণা বিতরণ করছি। যার কারণে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। ফলে যারা সেবা দেবেন তারা সংকটের মুখে পড়বেন। বলা হচ্ছে, পাবলিক প্যানিক তৈরি করা আর দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করার মধ্যে মুখ্যত কোনো তফাৎ নেই।
ফলে এ সময় কিছুটা হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। চীন কেন এবং কীভাবে এই সামাজিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করল সেই মডেলটি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ব্যবহার করার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। চীন যেভাবে উহান শহরকে এপিক সেন্টার ধরে কোয়ারেন্টাইন করেছে, আমাদেরও সম্মিলিতভাবে ওই উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষের মনের ভেতর যেন ভয়ের উদ্বেগ না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ডাক্তার, চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, রোগতত্ত্ববিদ, ভাইরোলজিস্ট- সবার একসাথে কাজ করতে হবে।
আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যেকোনো সামাজিক দুর্যোগের সময় আমরা ব্যবসায়িক নীতি অবলম্বনের চেষ্টা করি অথবা মজুতের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ি; এটি আমাদের সমাজের একটি মারাত্মক ব্যাধি। আমরা সবাই যদি এ ব্যাপারে নিজের অবস্থান থেকে নিজেদের ও অপরকে সচেতন করি, তাহলে আমরা অনেকখানি মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হব। আরও একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি সেটি হলো, সবসময় সরকারের সমালোচনা বা সরকারি ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর হওয়া উচিত নয়। আমাদের দায়িত্বগুলো আমাদের নিজস্ব অবস্থার আলোকে সম্পন্ন করা; সেক্ষেত্রে সরকারের কাজগুলোও সহজ হয়ে যাবে।
বৈশ্বিক এ মহামারির সময় সরকারের একার পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণ, মজুতদারি নিয়ন্ত্রণ, গুজব নিয়ন্ত্রণসহ রোগের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়া দুরূহ ব্যাপার। তার সাথে এদেশে ১০ লাখের বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকেও নিয়ন্ত্রণের দায়ভার সরকারকেই নিতে হচ্ছে। কোনোভাবে যদি তাদের মধ্যে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করাটাও কঠিন হয়ে পড়বে। দেশে ভাইরোলোজি বিশেষজ্ঞও খুব বেশি নেই; যাদের মাধ্যমে আমরা জানতে পারব যে কীভাবে রোগ দ্রুততম সময়ে বিস্তার ঘটাচ্ছে, কীভাবেই বা স্বল্পতম সময়ে প্রতিরোধমূলক বাবস্থা এবং ভ্যাকসিন প্রতিষেধক আবিষ্কার করা যায়।
এ প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য না দিয়ে বরং সঠিক তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের দিকে নজর দিতে হবে; কারণ অনেক সময় তথ্য গোপন করার প্রবণতা থাকে যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্যই হুমকিস্বরূপ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে যত ধরনের নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব হচ্ছে তার প্রায় ৮০ ভাগ রোগের মূল কারণ মানুষের সাথে কীটপতঙ্গ ও জীবজন্তুর মেলামেশা। উহানের যে বাজার থেকে করোনা সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, তা আসলে কতদিন পর্যন্তই বা থাকবে সেই ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো পরিপূর্ণ গবেষণা নেই। আবার যেহেতু মিউটেজেনিক মিউটেশনগত কারণে কোন অঞ্চলে কীভাবে রোগটি ছড়াবে তাও গবেষিত নয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত যে রকম তথ্য শেয়ার করছে তা শুধু সামাজিক অস্থিরতাকেই প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে তুলছে। আমরা যেহেতু রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে আছি, সে অবস্থান থেকে আমাদের সবাইকে এর স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া, কোয়ারেন্টাইন, ব্যক্তিক ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, মিডিয়ার যোগাযোগ বাবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থেকে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই এই বৈশ্বিক মহামারি নিয়ন্ত্রণ এবং এ প্রেক্ষিতে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
লেখকদ্বয়ের একজন নৃবিজ্ঞানী এবং অপরজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ ও ইনফরমেটিক্স বিভাগের শিক্ষক।
এইচআর/বিএ/জেআইএম