রাষ্ট্রপতি পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়?

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:৪৮ পিএম, ১৭ নভেম্বর ২০২০

ফারাবী বিন জহির

যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র। সেই মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন জো বাইডেন। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী রাষ্ট্র খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই রাষ্ট্রের মসনদে কে বসতে যাচ্ছে টা নিয়ে বিশ্ববাসীর কৌতূহলে সীমা ছিল না। বাংলাদেশ ও সেই কৌতূহলের ব্যতিক্রম ছিল না। তবে বাংলাদেশের কৌতূহল কিছু ক্ষেত্রে অতি কৌতূহল বা আদিখ্যেতার পর্যায়ে চলে গেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে গত ৬ নভেম্বর শুক্রবার একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম"ট্রাম্পের ভরাডুবির খবরে গৌরনদীতে ভূরিভোজ"। ওই খবরে বলা হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন এগিয়ে থাকায় ও বিজয় প্রায় নিশ্চিত হওয়ায় বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় ভূরিভোজ অনুষ্ঠান করেন তার এক সমর্থক। বৃহস্পতিবার রাতে স্থানীয় সুধীজন ও ব্যবসায়ীসহ ২০০ জনকে ভূরিভোজ করিয়েছেন তিনি।

এখন প্রশ্ন হল যে, বাইডেন বা ট্রাম্প কে নিয়ে এত মাতামাতি করলেন একজন ব্যক্তি তিনি আসলে এই ট্রাম্প বা বাইডেন সম্পর্কে কত টুকু জেনে বুঝে করলেন? তিনি দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি সম্পর্কে কতটুকুই জানেন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পরিবর্তন বাংলাদেশে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারে এই বিষয়ে তিনি কতটুকু জানেন? এই প্রশ্নের উত্তর তিনিই দিতে পারবেন যিনি ২০০ লোকের ভূরিভোজের খরচের বোঝা মাথায় নিয়েছেন। তবে আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য সেই সব বিষয়ে খানিকটা আলোকপাত করা।

আসুন ট্রাম্প এবং বাইডেন সম্পর্কে মোটাদাগে আলোকপাত করার চেষ্টা করি। পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী ট্রাম্প যখন আমেরকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন সেই নির্বাচিত হওয়া ছিল চমকের। সমালোচকদের মতে আমেরিকার নাগরিকদের নারী বিদ্বেষ ফুটে উঠেছিল হিলারি কে প্রত্যাখান করে ট্রাম্প কে নির্বাচিত করার মাধ্যমে। নির্বাচিত হয়ে ট্রাম্প আমেরিকার গণতন্ত্রের ১২ টা বাজাতে শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কতটুকু ‘গণতন্ত্রমনা’ (!) সে কথা বিশ্ববাসীর অজানা নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবার পর খোদ আমেরিকাতে যে বিক্ষোভ হয়েছে মিডিয়ার কল্যাণে তা সবাই দেখেছে। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ যেসব প্রতিষ্ঠান বৈশ্বিক গণতন্ত্রের র‌্যাংকিং প্রকাশ করে তাদের মতে ২০১৬ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আর পূর্ণ-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নেই। এটি ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ থেকে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ শ্রেণিতে নেমে গেছে। মানবাধিকার,বর্ণবাদবাদ বৈষম্য, ইসলাম বিদ্বেষ তৈরির চেষ্টা, অভিবাসী ইস্যুতে অতি কঠোরতা সব মিলিয়ে আমেরিকাকে অস্থিতিশীল করে তোলেন ট্রাম্প। স্বাস্থ্য সেবা সংকোচন, করোনা মোকাবেলায় ভয়াবহ ব্যর্থতা এবং সর্বোপরি তার অসংলগ্ন কথাবার্তা মার্কিনিদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। তবে এই কথাও ঠিক যে ট্রাম্প হচ্ছে গত ৪৫ বছরের মার্কিন ইতিহাসে একমাত্র প্রেসিডেন্ট যে কিনা নতুন করে কোন যুদ্ধে জড়ায়নি বা কোন দেশ আক্রমণ করেন নি। যদিও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ইয়েমেনে যুদ্ধ লাগিয়ে সৌদি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে বিশাল অঙ্কের অস্ত্র বাণিজ্যের।

অপরদিকে বাইডেনের রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। জো বাইডেন প্রায় ৫০ বছর ধরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। জো বাইডেন পররাষ্ট্র বিষয়ে একজন ঝানু রাজনীতিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তিনি দীর্ঘ দিন পররাষ্ট্র বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটিতে কাজ করেছেন। বলকান গৃহযুদ্ধে আমেরিকান অবস্থান, ইরাকে বোমা হামলা এবং আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব কায়েমের প্রতি বাইডান তার সমর্থন প্রকাশ করেছেন। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ইরাকের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে এই অভিযোগে যখন ইরাকে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর প্রস্তাব করেন, তখন বাইডেন তাতে জোরালো সমর্থন দিয়েছিলেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী জোরদার করার এবং ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর বিপক্ষে পরামর্শ দেন।যদিও পরবর্তীতে তার এই কট্টর অবস্থান পরিবর্তনের কিছুটা আভাস তার কর্মকাণ্ডে পাওয়া যায়।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হওয়ার লড়াইয়ে নামার ঘোষণা দেওয়ার পর তিনি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের প্রতি আমেরিকার সমর্থন বন্ধ করার পক্ষে মত তুলে ধরেন। ইরানের সঙ্গে পরমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখা, জলবায়ু নিয়ে প্যারিস চুক্তি সমর্থন, চীনে মার্কিন স্বার্থ বজায় রাখা এবং ইউক্রেনের গণতান্ত্রিক সংস্কার উৎসাহিত করাসহ নানা বিষয়ে তিনি গত কয়েক বছর কংগ্রেসের ওপর চাপ দিয়েছেন।

এতো গেল প্রার্থীদের কথা এইবার আসুন যুক্তরাষ্ট্র দেশটির দিকে লক্ষ্য করি, কানাডাভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অন গ্লোবালাইজেশন (গ্লোবাল রিসার্চ) এর গবেষক জেমস এ লুকাস তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ৩৭টি রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২০ মিলিয়ন তথা ২ কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৯টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির মধ্যে মাত্র ৩টি চুক্তি অনুসমর্থন করেছে আর ৬টি এখনও অনুমোদন করেনি।

জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র ৬টি রাষ্ট্র নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত আন্তর্জতিক মানবাধিকার চুক্তি অনুমোদন দেয়নি এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের একটি। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের সংবিধিতে তো স্বাক্ষর করেই নি, বরং যুক্তরাষ্ট্র অনেক রাষ্ট্রকে এ মর্মে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে বাধ্য করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনও সেনা সদস্য গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করলেও তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে মামলা করা যাবে না। এছাড়া, ঐতিহাসিকভাবে এটা প্রমাণিত যে, যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের দেশে গণতন্ত্র রক্ষা এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে পরবর্তী কালে সেসব রাষ্ট্র ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যেমন- আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, মিসর ও সিরিয়া।

আর যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া বা গনতান্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিষয়ে জানতে চাইলে ২০০০ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং আল গোরের নির্বাচনের দিকে তাকালেই বিষয়গুলো পরিস্কার হয়ে যাবে। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা নেই? উত্তর হল অবশ্যই আছে। তবে আমাদের প্রতিক্রিয়াতে তে অতি উচ্ছ্বাস বা আদিখ্যেতার জায়গা নেই আমাদের প্রতিক্রিয়া হতে হবে অতি সাবধানী এবং সতর্কতামূলক। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে যেমন- ইন্দো-প্যাসিফিক জোট, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন,জঙ্গিবাদ, বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়ে অগ্রগতিসহ আরও অনেক বিষয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য অনেক বড় বাজার। তাই শুধু রাজনৈতিক নয় অর্থনৈতিক ভাবে ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

আমরা জানি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি যে কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানবাধিকার, মানবপাচার ও গণতন্ত্র। এই ইস্যুগুলোতে তাদের তথ্য সংগ্রহের নিজস্ব পদ্ধতি আছে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর তারা এই বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে প্রভাব বিস্তারের জায়গা বেশ সীমিত। তাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কিছু আদায়ের ক্ষেত্রে একই সঙ্গে কৌশলী এবং সাবধানী হতে হয়। কূটনীতির ম্যারপ্যাঁচে বিন্দু ভুলের সিন্ধু খেসারত দিতে হয়।

তাই সর্বোপরি বিশ্লেষণ করে বলা যায়, মার্কিন নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় স্বার্থে আমাদের অতি উচ্ছ্বাস বা আদিখ্যেতা দেখানোর জায়গা নেই। বরং আমাদেরকে প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রে অনেক বেশি কৌশলী এবং সাবধানী হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তির পরিবর্তনের সাথে পররাষ্ট্র নীতির বড় ধরনের পরিবর্তনের নজির খুব একটা নেই। অতএব আমাদের উচিৎ আকাশ কুসুম কোন স্বপ্নে বিভোর না থেকে বাস্তবতার নিরিখে পথ চলার পরিকল্পনা করা।

লেখক : গবেষক ও লেখক।

এইচআর/জেআইএম

মার্কিন নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় স্বার্থে আমাদের অতি উচ্ছ্বাস বা আদিখ্যেতা দেখানোর জায়গা নেই। বরং আমাদেরকে প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রে অনেক বেশি কৌশলী এবং সাবধানী হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তির পরিবর্তনের সাথে পররাষ্ট্র নীতির বড় ধরনের পরিবর্তনের নজির খুব একটা নেই। অতএব আমাদের উচিৎ আকাশ কুসুম কোন স্বপ্নে বিভোর না থেকে বাস্তবতার নিরিখে পথ চলার পরিকল্পনা করা।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।