জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি : জনস্বার্থ দেখবে কে?

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:১১ এএম, ১৬ নভেম্বর ২০২১

রিশান নাসরুল্লাহ
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে এই যুক্তিতে সরকার একলাফে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করেছে ৷ আর সেটির প্রভাব এরইমধ্যে পড়তে শুরু করেছে সবখাতে। কারণ তেলের দাম অনেকটা কান টানলে মাথা আসার মতো।

গত কয়েক মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েলের যে দাম চলছে তাতে বিভিন্ন পর্যায়ের শুল্ক ও কর কমালে বিপিসির লোকসান হওয়ার কথা নয় ৷ বরং ৬৫ টাকাতেই বিক্রি করে লাভ করতে পারত সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি। তাহলে করোনার এই সময়টাতে দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়তো না।

আশার খবর হলো বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম পড়তে শুরু করেছে। অন্যদিকে জ্বালানি সচিব গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কমে আসলেই সমন্বয় করবেন তারা। এখন কি হবে- সেটি দেখার অপেক্ষায় থাকা ছাড়া কিইবা করার আছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ দুই ভাবে জ্বালানি তেল আমদানি করে একটা হলো পরিশোধিত আরেকটা ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত)৷ ক্রুড অয়েল দেশে এনে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করা হয় ৷ আমদানির অর্ধেক আনা হয় জিটুজি পদ্ধতিতে বিভিন্ন দেশের সাথে চুক্তির মাধ্যমে ৷ আর বাকিটা আনা হয় টেন্ডার করে আন্তর্জাতিক কোম্পানির মাধ্যমে ৷

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন সাধারণত সিঙ্গাপুর মার্কেট থেকে জ্বালানি তেল ক্রয় করে। ৬ মাসের (জানুয়ারি থেকে জুন ও জুলাই থেকে ডিসেম্বর) জন্য কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তি হয় ৷ জাহাজ ভাড়া ও অন্যান্য কমিশনসহ একটা মূল্য তাদের পরিশোধ করা হয় ৷ সরকারের হিসাবে এটাকে প্রিমিয়াম বলে ৷ জিটুজি পদ্ধতিতে প্রিমিয়াম এখন প্রতি ব্যারেল ২.৮২ ডলার আর কোম্পানি পর্যায়ে ২.১৫ ও ২.২২ ডলার ৷ জ্বালানি তেল যেদিন জাহাজে লোড করা হয় সেদিনেরসহ আগের ও পরের দুই দিন করে মোট ৫ দিনের আন্তর্জাতিক দরের গড় দাম হিসাবে বিপিসি তেলের মূল্য পরিশোধ করে ৷

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

গত কয়েকমাসের আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুসারে প্রতি ব্যারেল ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ৮০ থেকে ৯৫ মার্কিন ডলারের মধ্যে ৷ টানা কয়েকদিন ৮৪ ডলারে বিক্রি হয়েছে ক্রুড অয়েল। এটাকে গড় ধরে এবং প্রিমিয়াম গড়ে আড়াই ডলার ধরলে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত বিপিসিকে প্রতি লিটার ডিজেল আনতে খরচ হয় কমবেশি ৪৮ টাকা ৷ এরপর মাদার ভেসেল থেকে ছোট জাহাজে করে ইআরএলে নেয়ার পর বিতরণ কোম্পানিগুলোকে দেয়া পর্যন্ত লিটার প্রতি মূল্য দাঁড়ায় ৬৪ টাকা ৭৩ পয়সা ৷

এরমধ্যে ১৬ টাকা ৭৩ পয়সার মধ্যে বন্দর চার্জ , ডিউটি, হ্যান্ডেলিং কমিশন, শুল্কসহ নানা চার্জ রয়েছে ৷ এছাড়া রয়েছে ১০ শতাংশ ডিউটি আর ২ শতাংশ শুল্ক। সে হিসাবে লিটারে আসে কমবেশি ৫ টাকা ৭৬ পয়সা ৷ ইআরএল থেকে বিতরণ কোম্পানিতে সরবরাহের সময় ৯ টাকা ৭১ পয়সা ভ্যাট দেয়া হয় প্রতি লিটার ডিজেলে ৷ ব্যবসায়ী পর্যায়ে ১ টাকা ৫৭ পয়সা ভ্যাট দেয়া হয় ৷

বিপিসির তথ্য বলছে, প্রতি লিটার ডিজেলে সরকার ভ্যাট-ডিউটি আর ট্যাক্স ১৭ টাকার ওপরে নিয়ে যায় ৷ অর্থাৎ শুল্ক-কর বাদ দিলে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম থাকবে ৬৫ টাকার মধ্যে। তবে, এটা পূর্ণাঙ্গ হিসাব নয় ৷ সঠিক হিসাবে প্রকৃত ট্যাক্স-ভ্যাট ও অন্যান্য খরচ আরো বেশি হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বিপিসির তথ্যমতে বিতরণ পর্যায়ে প্রায় ৪ টাকা খরচ রয়েছে ৷ এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিপণন কোম্পানির (পদ্মা, মেঘনা, যমুনা) মার্জিন ৫০ পয়সা ৷ বিপণন কোম্পানির পরিবহন ভাড়া তহবিল ৯০ পয়সা ৷ বিপিসির তেলখাতের উন্নয়ন তহবিল ১০ পয়সা ৷ ডিলারদের প্রতি লিটারে পরিবহন খরচ ৫০ পয়সা ৷ ডিলারদের অবচয় ৪ পয়সা ৷ ইভাপোরেশন অপারেশন হ্যান্ডেলিং ও অন্যান্য লস এবং ডিলার/এজেন্ট কমিশন ১ টাকা ৯৫ পয়সা প্রতি লিটারে। কেরোসিনের খরচও অনেকটা একইরকম ৷

সুতরাং ভ্যাট-ট্যাক্স কমালেই এই মুহূর্তে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়তো না। যদিও সরকার বলছে, ভ্যাট-ট্যাক্সের সুফল কোনো না কোনো ভাবে সাধারণ মানুষকেই দেয়া হয়। সরকারের এই যুক্তি মেনে এবার দেখা যাক-দাম না বাড়িয়ে কি উপায় ছিল সরকারের?

২০১৪ সাল থেকে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম ৷ ২০১৬ সালে যখন বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল ক্রুডঅয়েলের দাম ছিল ৪৪ ডলার, তখন বিপিসি প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ঠিক করে ৬৫ টাকা ৷ ২০১৪ সালের পর থেকে বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি করে প্রতি লিটারে ২০ থেকে ৪০ টাকা লাভ করেছে। চলতি বছরের জুন-জুলাই পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। এ সময়ে সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটি বছরে মুনাফা করেছে ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা ৷ প্রতি বছর ট্যাক্স-ভ্যাট দিয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ৷ এছাড়া গত দুই অর্থবছরে সরকারি তহবিলে দিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা ৷ যেহেতু গত পাঁচ বছরের লাভের টাকা পুরোটাই সরকারের পকেটে গেছে, তাই আমদানি ব্যয়ের চাপ জনগণের ওপর না চাপিয়ে সরকারই সামাল দিতে পারতো। কিন্তু সে পথে হাঁটার কোনো চিন্তা করেনি সরকার।

বিজ্ঞাপন

বরং সরকার বলছে, সংস্থাটি ২০১৪ এর আগের বছরগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান গুণেছে। তখন সরকার ভর্তুকি দিয়ে দাম সহনীয় রেখেছে। তবে, সেই ভর্তুকির টাকার যোগানদার যে সাধারণ মানুষ সেটি হয়তো ভুলে যায় সরকার। এবার আসা যাক দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তেল পাচারের যুক্তিতে। ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদেশগুলোতে ডিজেলের দাম বাংলাদেশের চেয়ে অনেকটাই কম। ভারতের সাথে দীর্ঘ সীমান্ত থাকায় তেল পাচারের সম্ভাবনা রয়েছে সরকারের এ দাবিটি ঠিক। তবে এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেনি সরকার। উপরন্ত বিপিসির ও বিতরণ কোম্পানির যোগ-সাজসে তেল চুরির যথেষ্ট ঘটনার প্রমাণ রয়েছে। সেটা যাই হোক- তেল পাচার হয়ে যাওয়া নিয়ন্ত্রন করতে না পারার ব্যর্থতার দায় কেনো সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে খরচ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হলো সেটির পক্ষে সরকারের কোনো বক্তব্য নেই। বরং সরকারের উৎসাহ পরিবহনসহ অন্যান্য খাতের খরচ কিভাবে বাড়ানো যায় সেদিকে। এরইমধ্যে ২৩ শতাংশ ডিজেলের দাম বৃদ্ধির বিপরীতে পরিবহন ভাড়া বেড়েছে পঞ্চাশ ভাগ।

পরিবহনের বাহিরে ডিজেল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় কৃষিতে ৷ এছাড়া দেশে এখনও চালু রয়েছে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন। এছাড়া বিশ্ব বাজারে কয়লা ও এলএনজির দামও ঊর্ধ্বমুখী। সুতরাং খুব শিগগরিই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব আসবে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষি পণ্যের দাম যে আরেকদফা বাড়বে সেটি বলার অপেক্ষা রাখেনা। পাশাপাশি জ্বালানিতে আমদানি নির্ভরতা থাকায় অশনি সংকেত তো রয়েছেই।

তবে আশার খবর হলো বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম পড়তে শুরু করেছে। অন্যদিকে জ্বালানি সচিব গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কমে আসলেই সমন্বয় করবেন তারা। এখন কি হবে- সেটি দেখার অপেক্ষায় থাকা ছাড়া কিইবা করার আছে।

বিজ্ঞাপন

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলাভিশন।
rishan.journalist@gmail.com

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।