ছাত্রলীগের ৭৪ বছর : ইতির চেয়ে কি নেতি বেশি?

বিভুরঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশিত: ০৯:৫৮ এএম, ০৪ জানুয়ারি ২০২২

বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবার সংগঠনের ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি কক্ষে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন তখনকার সময়ের এক উদীয়মান ও সাহসী রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমান। তখন নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগের এক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সারথি। বাঙালির অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের যে ধারাবাহিক সংগ্রাম শেখ মুজিব করেছেন, তার সঙ্গে ছাত্রলীগ সব সময়ই ছিল অবিচ্ছিন্নভাবে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভাষা আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক ও সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ছাত্রলীগ বিরাট ভূমিকা পালন করছে। ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ – এই বছরগুলো বাঙালির ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে বিভিন্ন লড়াইয়ের কারণে। আর এসব লড়াইয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছিল সম্মুখসারির সৈনিক হিসেবে। শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে ছাত্রলীগের নাম অবশ্যই আসে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িয়ে আছে অবিচ্ছেদ্যভাবেই। রাজনীতির মঞ্চ আলোকিত করা অনেক জাতীয় নেতাও উঠে এসেছেন ছাত্রলীগের পতাকা বহন করেই। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও রাজনীতিতে হাতেখড়ি ছাত্রলীগের মাধ্যমেই। বলা হয়ে থাকে নেতা তৈরির কারখানা হলো ছাত্রলীগ।

বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগকে নতুন জীবন দিয়েছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকেই আওয়ামী লীগকে ভবিষ্যতের জন্য সচল, সক্রিয়, কর্মক্ষম থাকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও করতে হবে। তিনি তার দায়িত্ব সম্পর্কে যে সচেতন আছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশের কিছু নেই।

বিজ্ঞাপন

দুই.
এবার ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হচ্ছে একটি বিশেষ সময়ে। গত দুই বছর করোনার কারণে স্বাভাবিকভাবে অনেক কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও কিছুই থেমে থাকে না। জীবনের গতিহীন নয়। মুজিববর্ষ উদযাপন চলছে। স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীও পালিত হচ্ছে। এই সময়ে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন বা পালন করতে গিয়ে অতীত ঐতিহ্য স্মরণ করার পাশাপাশি বর্তমানের দিকে একটু নজর দেওয়াও জরুরি।
সব সংগঠনই পরিচালিত হয় একজটি গঠনতন্ত্রের নিয়মনীতি দিয়ে। ছাত্রলীগেরও তাই হওয়ার কথা। ছাত্রলীগের একটি গঠনতন্ত্র থাকলেও তা মেনে চলার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সংগঠনের গঠনতন্ত্রটি কয়জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী পড়ে দেখেছেন সেটিও একটি বড় প্রশ্ন।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ১১ ধারার খ উপধারায় বলা আছে : ‘কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকাল ২ বছর। উপরোল্লিখিত সময়ের মধ্যে সম্মেলন আয়োজন করতে হবে। অন্যথায় নির্বাহী সংসদের কার্যকারিতা লোপ পাবে’। গ উপধারায় বলা হয়েছে : ‘বিশেষ বা জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় অনুমোদন সাপেক্ষে কমিটির কার্যকাল ৩ মাস বৃদ্ধি করা যাবে’। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের সম্মেলন কি নিয়মিত দুই বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়? আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্রলীগের দখল ও নিয়ন্ত্রণে। কোনোভাবেই দেশে ‘বিশেষ বা জরুরি অবস্থা’ বিরাজ করছে না। প্রশ্ন হলো, তাহলে ছাত্রলীগ কেন যথাসময়ে সম্মেলন করতে ব্যর্থ হলো? এটা সবারই জানা কথা যে ছাত্রলীগের মুরব্বি সংগঠন হলো আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ কেন ছাত্রলীগকে গঠনতন্ত্র মেনে চলতে বাধ্য করতে পারছে না?

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

ছাত্রলীগ যে শুধু সংগঠনের গঠনতন্ত্র অমান্য-অগ্রাহ্য করছে তা নয়। ছাত্রলীগ বর্তমানে এক মূর্তমান আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, যৌন নিপীড়ন, খুনখারাবিসহ এমন কোনো অপরাধ-অপকর্ম নেই যা বা যেগুলোর সঙ্গে ছাত্রলীগের নাম আসছে না বা ছাত্রলীগ জড়িয়ে যাচ্ছে না। বেপরোয়া ছাত্রলীগ যে শেখ হাসিনা সরকারের সব ভালো অর্জনের মুখে চুনকালি মেখে দিচ্ছে সেটা আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে বলছেনও। তারপরও কেন বা কাদের মদদ পেয়ে ছাত্রলীগ ধরাকে সরাজ্ঞান করছে, সে প্রশ্ন অনেকেই করছেন।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বাণী উদ্ধৃত করা আছে। শেখ হাসিনা বলছেন : ‘উচ্চ আদর্শ এবং সাদামাটা জীবন- এই হোক তোমাদের জীবনাদর্শ’। খুব ভালো পরামর্শ। শেখ হাসিনা যেহেতু ছাত্রলীগের ‘আদর্শিক নেত্রী’ সেহেতু তার আদেশ-নির্দেশ-পরামর্শ অবশ্য অবশ্যই ছাত্রলীগের মেনে চলা উচিত। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টোটা। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যে ‘উচ্চ আদর্শ এবং সাদামাটা জীবনযাপন’ করছেন না সেটা অনেকেই খেয়াল করছেন। ছাত্রলীগের অনেক নেতাই বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কেউ কেউ নাকি গাড়ি-বাড়িরও মালিক। ছাত্রলীগের কমিটিতে ঢোকার জন্যও নাকি মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন হয়। এগুলো কোনো মিথ্যা অভিযোগ নয়। তাজ্জবের বিষয় হলো ছাত্রলীগকে ‘সুপথে’ আনার কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায় না ।

তিন.
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ছাত্রলীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের লেখাপড়া করতে হবে। সুন্দর আচরণের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ বুকে ধারণ করে চলতে হবে। ছাত্রলীগকে সুশিক্ষা ও মেধার আলোয় আলোকিত হতে হবে।… ছাত্রলীগ নেতাদের বঙ্গবন্ধুর লেখা দুটি বই অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’সহ জাতির পিতার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রকাশিত বই পড়তে হবে। মুজিববর্ষ উদযাপনে সক্রিয় থাকতে হবে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

নিঃসন্দেহে এগুলো ছিল সৎ উপদেশ এবং সুপরামর্শ। প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার এই সব উপদেশ বা পরামর্শ কতটুকু পালন করেছে বা করছে ? কথায় কথায় ‘নেত্রী মোদের শেখ হাসিনা’ বলে স্লোগান দিলেও ছাত্রলীগ গত কয়েক বছর ধরেই আওয়ামী লীগের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেতাকর্মী নানা ধরনের অন্যায়-অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হওয়ার খবর আওয়ামী লীগের জন্য, সরকারের জন্য একাধিকবার বিব্রতকর হয়েছে। ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনো উদ্যোগই সফল হয়নি। অথচ আগেই বলেছি, ছাত্রলীগ এদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার যে ধারাবাহিক সংগ্রাম, তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছাত্রলীগের নাম। কিন্তু এখনকার ছাত্রলীগ ঐতিহ্যের কতটুকু ধারক-বাহক সে প্রশ্ন উঠছে। একের পর এক খারাপ কাজে ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় মানুষ ছাত্রলীগকে একটি ‘অপরাধী’দের অথবা ‘অপরাধপ্রবণ’ সংগঠন হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হচ্ছে। ধমক দিয়ে, শাসিয়ে ছাত্রলীগকে নিবৃত্ত করতে পারছেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। বিষয়টি উদ্বেগের, আশঙ্কার এবং হতাশার।

ছাত্রলীগকে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য শেখ হাসিনার যে ভাবনা-চিন্তা আছে সেটা তার বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। আওয়ামী লীগ চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না। শেখ হাসিনা নিজেই একাধিকবার দলের নেতাকর্মীদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে তার বয়স হয়েছে! তাকেও একসময় অবসর নিতে হবে। আওয়ামী লীগে নতুন নেতা সরবরাহ করার কারখানা হলো ছাত্রলীগ। কিন্তু ছাত্রলীগ যদি বিপথে চলে, ছাত্রলীগ নেতৃত্ব যদি আদর্শবাদী না হয়ে সুবিধাবাদী-সুযোগসন্ধানী হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের জন্যই বড় সংকট তৈরি হবে। ছাত্রলীগকে বদলানোর কাজে শেখ হাসিনাকে তাই সফল হতেই হবে। বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগকে নতুন জীবন দিয়েছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকেই আওয়ামী লীগকে ভবিষ্যতের জন্য সচল, সক্রিয়, কর্মক্ষম থাকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও করতে হবে। তিনি তার দায়িত্ব সম্পর্কে যে সচেতন আছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশের কিছু নেই।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মী,সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী সবাইকে শুভেচ্ছা। সবার সমবেত চেষ্টায় এই সংগঠনটি ফিরে আসুক ঐতিহ্যের ধারায়।

বিজ্ঞাপন

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।