বিজ্ঞান আলীর অবাক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব

: নাম?
: বিজ্ঞান আলী।
: দেশ?
: বাংলাদেশ।
তেরছা হাসি ঠোঁটের গণ্ডি পার হয়ে বিজ্ঞান আলীর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। বুঝলাম, ত্যাঁদড় আছে। অপমান হজম করে বললাম-
: সাকিন?
: সাকিন না, বিজ্ঞান; বিজ্ঞান আলী।
চ্যানেল পাল্টিয়ে হাসি এবার চলে এলো আমার মুখে। নামে ‘বি-জ্ঞান’ হলেও কাজেকামে যে তাইনে ‘অ-জ্ঞান’, বুঝতে পারলাম। মনে মনে বললাম-
: বাপধন! এই তোমার এলেমের দৌড়?
বিজ্ঞান আলীর জং ধরা এলেমে তালিমের শান্ দেওয়ার অভিপ্রায়ে বললাম-
: সাকিন মানে গেরাম।
: গেরাম! অঃ, গেরাম অইল শ্রীফলতলী।
গাজীপুর জেলার শ্রীফলতলী গ্রামের এই কিশোর, বাপ-মা যার নাম রেখেছে বিজ্ঞান আলী; গত সাড়ে চার বছর ধরে নারী জ্যোতিষী জর্জিনা চৌধুরীর দ্বাররক্ষী। মাস কাবারে বেতন ছয় হাজার টাকা; থাকা-খাওয়া ফ্রি। জ্যোতিষ শাস্ত্রে আমার বিশ্বাস আছে কী নেই- সেই বিতর্কে না গিয়ে জর্জিনা চৌধুরীর দরবারে তশরিফ রাখার প্রেক্ষাপট আপনাদের জানাতে চাই। স্বহস্তে নির্মিত দুধবিহীন বৈকালিক চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতেই দরজায় ধুমদাম শব্দ। সচকিত হয়ে জানতে চাইলাম-
: কে?
কণ্ঠ-নিঃসৃত কোনো বাণী ভেসে আসার পরিবর্তে দরজাপ্রহারের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। বিরক্ত হলাম-ভারি অসভ্য তো! চকিতে মনে হলো, ফকির-টকির নয় তো? ঢাকা শহরের ফকিররা ইদানীং নতুন স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছে। দরজার কড়া নেড়ে, খালাম্মা খয়রাত দ্যান বলে না চেঁচিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, যাতে বন্ধ দরজার ওপাশ থেকেই গৃহপ্রভু ‘মাফ করো’ বলার চান্স না পায়। আগে দেখনদারি, তারপর গুণবিচারী। হেঃ হেঃ হেঃ, কুনু কতা কইবাম না! দুয়ার খুইল্যা আগে দেইখ্যা লন-আমার চেহারা-মুবারক খয়রাত পাওয়ার যোগ্য কি না?’
নাছোরবান্দা কোনো ভিখারির মুখোমুখি হওয়ার জন্য মানসিক যে প্রস্তুতি দরকার, তার সবটুকু সম্পন্ন করে দরজা খুললাম। খুলে অবাক হলাম। আমার প্রতিবেশী-কাম-বন্ধু হুরমুজ আলী দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। ঝড়ো কাকের মতো বিধ্বস্ত চেহারা, কৃষ্ণপক্ষের পূর্ণশশী। পরিবেশ হালকা করার মানসে দরবারি স্টাইলে অভ্যর্থনা জানালাম-
: আসুন। আসুন। আসতে আজ্ঞা হোক।
: ঠাট্টা করছো? কান্নাভেজা কণ্ঠ হুরমুজ আলীর।
নাউজুবিল্লাহ! জিভে কামড় বসালাম।
: তাহলে চলো।
: কোথায়?
: উকিলের কাছে।
হাসতে গিয়েও সামলে নিলাম। মুখে গাম্ভীর্যের কলুপ এঁটে জিজ্ঞেস করলাম-
: আবার ঝগড়া করেছো?
: করেছি মানে?
: সকাল থেকে এ পর্যন্ত এগারোবার। এইমাত্র একাদশ রাউন্ড শেষ করে এলাম।
: বলো কী! ব্যাপার তো তাহলে সত্যিই জটিল!
: জটিলের দেখেছ কী? নেহায়েত আমি ভদ্রলোক বলে। তা না হলে আজ একটা খুনোখুনি হয়ে যেত!
: সত্যি বলছো?
: ইয়েস। আ’অ্যাম অ্যা জেন্টেলম্যান! ভদ্রলোকেরা কখনো জবান রিমেক করে না।
: তাহলে...
সিদ্ধান্তহীনতায় আমার চোয়াল ঝুলে পড়ল। হুরমুজ আলী তাড়া দিয়ে বলল-
: চলো। আমি ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো। উফ! লাইফটা নরকের কয়লা হয়ে গেছে আমার।
হুরমুজ আলীকে নিরস্ত করার অভিপ্রায়ে উচ্চারণ করলাম-
: আচ্ছা, একেবারে কাটাকাটির মধ্যে না গিয়ে এর বিকল্প কিছু চিন্তা করা যায় না?
সন্দেহের চোখে তাকিয়ে হুরমুজ আলী বলল-
: কী রকম!
: এই যেমন ধরো, ঝগড়া-টগড়া না হওয়ার কোনো দাওয়াই যদি পাওয়া যায়...
হুরমুজ আলীর চেহারায় আগ্রহ ও প্রত্যাশার রোদ-ছায়া খেলা করতে শুরু করল। সে জানতে চাইল-
: ঝগড়া না হওয়ার কোনো ওষুধ আছে নাকি?
দম নিয়ে বললাম-
: আছে, আছে। দরবারে মা, দরবারে বাবা, সর্পরাজ, তন্ত্র সম্রাট, মুশকিল আসান, জ্যোতিষ নক্ষত্র ইত্যাদিতে বোঝাই এ ঢাকা শহর। এরা তোমার দাম্পত্য কলহ নামের মুশকিলকে আসান অর্থাৎ লাইগেশন করে ছেড়ে দেবে।
চোখ বড় করে হুরমুজ আলী বলল-
: তাই নাকি?
: অবশ্যই।
: এমনটা হলে অবশ্য মন্দ হয় না। আফটারঅল, সাড়ে সাত বছরের প্রেমের সেভিংস নিয়ে বিয়ে করেছি আমরা। হেঃ হেঃ হেঃ, বুঝতেই পারছো...
ওই দিনের দৈনিক পত্রিকা ঘেঁটে চব্বিশজন সাধক-সাধিকার ঠিকানা পাওয়া গেল, যারা মানুষের মুশকিল নিরাময়ে মোক্ষম দাওয়াই সরবরাহ করেন। এদের মধ্যে হুরমুজ আলীর পছন্দ হলো নারী জ্যোতিষী জর্জিনা চৌধুরীকে। এক্ষেত্রে ওর যুক্তি হচ্ছে এরকম- একজন ভদ্রমহিলা কেন কারণে-অকারণে তার স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে, এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও সমাধান নারী সাধক যতটা নিপুণভাবে দিতে পারবেন, পুরুষরা তা পারবেন না। অকাট্য যুক্তি।
কালবিলম্ব না করে দুজন জর্জিনা চৌধুরীর দ্বারস্থ হলাম। হুরমুজ আলীকে জর্জিনা চৌধুরীর কক্ষে ঢুকিয়ে দিয়ে অর্ভ্যথনা কক্ষের এক পাশে বসে বিজ্ঞান আলীর সঙ্গে সংলাপ বিনিময় হচ্ছিল, যা শুরুতেই পাঠক অবগত হয়েছেন। সংলাপ বিনিময়ের একপর্যায়ে বিজ্ঞান আলী সহজ হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করল-
: আপনের লগে যে আইছে, তাইনে কেডা?
: আমার বন্ধু।
: তাইনের সমস্যা কী? কৌতূহলে টইটুম্বুর বিজ্ঞান আলীর দু’চোখ।
: তা শুনে তোমার কী লাভ?
: লাভ-লোকসানের কুনু বিষয় না। অ্যামনেই জিগাইলাম। আর কাউরে জিগাই না। খালি আফনে দেইখ্যা!
বিজ্ঞান আলীর কণ্ঠে অধিকার প্রতিষ্ঠার ধ্বনি শুনে চমকিত হলাম। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য জিজ্ঞেস করলাম-
: ব্যবসাপাতি কেমন চলছে তোমার ম্যাডামের?
: ব্যবসা তো আল্লাহর রহমতে জমজমাট। কত কিসিমের মানুষ যে আহে! আমি তাগো দেহি, আর মুনে মুনে হাইস্যা ভাইঙ্গা পড়ি।
: হাসির কী আছে এতে?
: হেঃ হেঃ হেঃ! মজাডাই তো এইহানে।
: কী রকম?
: যার কাছে মানুষ সমস্যা সমাধানের লাইগা আহে, হে নিজেই তো সমস্যার জাহাজ।
: যেমন?
: আগে আপনের দোস্তের কেইসটা কী কন।
: স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া।
: হে হে হে; হুনেন ভেদের খবর কই। ঝগড়া না হওনের উপায় জানবার লাইগা আফনেরা যার কাছে আইছুইন, আমার জানামতে, হে এই পর্যন্ত তিনবার জামাই বদলাইছে। শেষের জনের লগে সারা রাইত ঝগড়া কইরা হেই যে বাড়ি ছাড়ছে, আর সেইখানে যায় নাই।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে বিজ্ঞান আলী বলল-
: আফনেরে একখান কতা কই?
: কী কথা?
: ট্যাহা খরচ কইরা জ্যোতিষীর কাছ থেইকা পাথর না কিইন্যা আপনের দোস্তরে কন-অই ট্যাহায় বউরে শাড়ি কিইন্যা দিতে আর চাইনিজ খাওয়াইতে; দেখবাইন সব ফকফকা...
লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর।
basantabilas2021@gmail.com
এইচআর/ফারুক/জিকেএস