ইডেন কলেজ পরিস্থিতি

তারুণ্যের ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে ছাত্র রাজনীতি

লীনা পারভীন
লীনা পারভীন লীনা পারভীন , কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

রাজনীতি না থাকলেও দুদিন পরপর আলোচনায় আসে ছাত্র রাজনীতি। আবারও আলোচনায়। এবার প্রেক্ষিত ইডেন কলেজ। সেই একই চিত্র। ভোগদখল, মারামারি, হাতাহাতি, চুলাচুলি, ক্ষমতার দাপট, রাজনৈতিক স্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থে পরিণত করা, লোভ লালসা চরিতার্থ করার জন্য ক্ষমতা ও পদের অপব্যবহার এবং সর্বোপরি স্বার্থসিদ্ধির সিঁড়ি হিসেবে নিজেদের ব্যক্তিত্ব ও প্রজ্ঞাকে বিসর্জন।

কথা হচ্ছে এসব কি নতুন? বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা কি আগে ঘটেনি? ক্ষমতার রাজনীতি সবসময়ই ছাত্রদের উসকে দিয়েছে এমন কোন্দলে। একটা সময় প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে ছাত্রদল, ছাত্রলীগের মারামারি ছিল নিত্য ঘটনা। ক্ষমতায় যে দল থাকতো সেই দলের ছাত্রসংগঠনের প্রতিপত্তি ছিল সর্বত্র। একটা লম্বা সময় ক্ষমতার বাইরে ছিল আওয়ামী লীগ। অস্ততিত্বের প্রয়োজনে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমের পাশাপাশি ক্ষমতাশীল দলের গরম সহ্য করে থাকতে হয়েছে।

নারীদের জন্য বড় একটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ইডেন ও বদরুন্নেসা কলেজ। সেইসব কলেজও বাদ ছিল না। বিশেষ করে ইডেন কলেজের চুলাচুলি বা মারামারি তো সবার মুখস্থ ছিল। একটা সময় ছাত্রদলের ইডেন কলেজের সভাপতির নাম জানতো না বাংলাদেশে এমন মানুষ কম ছিল। যারাই রাজনীতি নিয়ে সচেতন ছিল তাদেরই মাথায় থাকার কথা এই নামটি। ৯০/২০০০ সালের প্রায় প্রতিদিনই ছাত্রদলের এই নেত্রীর বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সংবাদ ছাপা হতো। সেই তিনি পরে বিএনপি’র সংসদ সদস্যও হয়েছিল।

তাহলে আজকে কেন আমাদের কাছে এই চেয়ার ছোড়াছুড়ি বা ব্যক্তিগত লিপ্সা চরিতার্থের কাজে সাধারণ মেয়েদের ব্যবহারের অভিযোগ আশ্চর্য লাগছে? লাগছে কারণ দুনিয়া পালটে গেছে। জগতের অনেক চাহিদা আপডেট হয়েছে অনেকগুলো ব্যাকডেটেড হয়েছে। বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক। পরিবর্তিত বাংলাদেশের সাথে ইডেনের এই মারামারি বড্ড বেমানান বলেই আমাদের অনেকের কাছে বিষয়টা অবাক করা। তবে এই আগানোর আলোচনায় অবশ্যই আমাদের ইতিহাসকে সাথে রাখতে হবে।

আজ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস। এই মাসেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সভায় গিয়ে বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন ও বাস্তবের কথা বলে এসেছেন। তিনি গোটা বিশ্বে নারী নেতৃত্বকে আরও শক্তভাবে বিশ্বাস ও মর্যাদা দিয়ে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণের প্রস্তাব দিয়ে এসেছেন। ঠিক এই সময়টাতে যদি তারই দলের তারই অভিভাবকত্বে থাকা প্রিয় ছাত্র সংগঠন সেই ’৯০ সালের মতো ধ্যান-ধারণা নিয়ে থাকে তাহলে কাদের হাতে দলকে ছাড়বেন তিনি? কোন বিশ্বাসে?

আফসোস যে সারা বিশ্বের নতুন প্রজন্ম ভাবছে নাসা জয়ের কথা। নতুন প্রজন্ম গবেষণায় ব্যস্ত এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন নিয়ে। ভাবছে করোনার মতো মহামারিকে কেমন করে আটকে দেওয়া যায় আগেই। আর আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মের একটি অংশ এখনও ব্যস্ত আছে ক্ষমতার রাজনীতিকে ব্যবহার করে নিজের দামি গাড়ি, বাড়ি, নারী সবকিছুকে নিশ্চিত করার লড়াইয়ে। তাদের মাথায় বিজ্ঞান ঢোকে না, ইতিহাস ঢোকে না, গবেষণা ঢোকে না। তাদের মগজে কেবল আছে পদ ও ক্ষমতার হিসাব। কিন্তু এভাবে কি চলবে?

বাংলাদেশের বাস্তবতা কী বলে? প্রাকৃতিক নিয়মেই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। আর এই পরিবর্তনের ধারায় যে বা যারা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না তারাই কালের স্রোতে হারিয়ে যায় বা যাবেই। এই যে ছাত্র রাজনীতির আজকে আকাল চলছে। একটি বড় প্রজন্ম আজকে ছাত্র রাজনীতিকে অপছন্দ করছে এর কারণ কী? কারণ তারা মনে করছে গতানুগতিক ধারার ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে।

আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় যখন বৈশ্বিক রাজনৈতিক কাঠামোই পরিবর্তন হচ্ছে তখন দলীয় রাজনীতির হিসাবটাও পাল্টানো সময়ের দাবি। এই যে পদ-পদবি দখল করার জন্য কেনাবেঁচার কার্যক্রম এই ব্যবসা করে আর বেশিদিন টিকে থাকা যাবে না। আমাদের নীতিনির্ধারকদের আসলেই ভাবার সময় এসেছে। বড় দলগুলোকে ভাবতে হবে লেজুরবৃত্তির ছাত্রনেতা দিয়ে তারা নিজ দলীয় আদর্শ বা রাজনীতি কোনোটাই আর টিকিয়ে রাখতে পারবে না। পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের জ্ঞান বা দক্ষতার উন্নয়নের দিকে নজর দিতেই হবে।

বাস্তবতা হচ্ছে আগামী দিনের ছাত্র রাজনীতি হওয়া উচিত ছাত্রদের নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে। সেই সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে ছাত্রদের সাথে মিশে গিয়ে সমাধানের রাস্তাকে সুগম করাই হওয়া উচিত ছাত্র সংগঠনের কাজ। ছাত্ররা বিচ্ছিন্ন থাকে তাই তাদের ইস্যুগুলোকে সংগঠিত আকারে উপস্থাপন করার কাজটি করলেই কেবল সাধারণ ছাত্রদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।

ইডেন কলেজের যেসব কাহিনি সামনে আসছে এর সবগুলোই সেই পুরোনো ধাঁচের কাহিনি। কোনোটাই নতুন বা চমকের কিছু না। সমস্যা হচ্ছে ছাত্রলীগ এখনও নিজেদের রাজনৈতিকভাবে আধুনিক করতে পারেনি। তাদের দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে গত ১৪ বছরের বেশি। ২০২৩ এর নির্বাচনেও তারা ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছে বা বাস্তবতাও হয়তো আছে। কিন্তু এতো লম্বা সময়ে তারা নিজেদের দলের ভিতরের রাজনৈতিক সংস্কৃতি উপেক্ষা করেছে বলেই মনে হচ্ছে। এমন ভঙ্গুর অবস্থান নিয়ে তারুণ্যের দল হওয়া কঠিন। এক প্রধানমন্ত্রীর কাঁধে ভর করে আর কতদিন চলবে?

২০৪১ সালে যদি বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে হয় সেখানে এই দেশের ৬০ শতাংশ তরুণকে সাথে নিতেই হবে। আর সেই তারুণ্যকে কাছে টানার একটি অন্যতম প্ল্যাটফর্ম হতে পারতো ছাত্রলীগ। মেধা, মনন ও চর্চায় তাদের কার্যক্রম হওয়া উচিত ছিল চমকে যাওয়ার মতো। নতুন প্রজন্মের পছন্দের তালিকাটিকে না জেনে রাজনীতি করতে নামলে হোঁচট খেতে সময় লাগে না। মৃত সময়কে বুকে আগলে রাখলে কেবল শোকের আবহই পাওয়া যাবে, আনন্দের উৎস আর দেখা দেবে না।

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

ইডেন কলেজের যেসব কাহিনি সামনে আসছে এর সবগুলোই সেই পুরোনো ধাঁচের কাহিনি। কোনোটাই নতুন বা চমকের কিছু না। সমস্যা হচ্ছে ছাত্রলীগ এখনও নিজেদের রাজনৈতিকভাবে আধুনিক করতে পারেনি। তাদের দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে গত ১৪ বছরের বেশি। ২০২৩ এর নির্বাচনেও তারা ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছে বা বাস্তবতাও হয়তো আছে। কিন্তু এতো লম্বা সময়ে তারা নিজেদের দলের ভিতরের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করেছে বলেই মনে হচ্ছে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।