শারদীয় দুর্গোৎসব

অটুট থাকুক ধর্মীয় সম্প্রীতি

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ০৪ অক্টোবর ২০২২

দেশজুড়ে মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় এ ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে এখন সারাদেশে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।

আবহমানকাল থেকে বাংলা ভূখণ্ডে নানা জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মমতের অনুসারীরা পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে মিলেমিশে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য সংহত রেখেছে। এদেশ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি। আমাদের এ দেশ অর্জিত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবার মিলিত রক্তস্রোতের বিনিময়ে।

যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে এটাই ধর্মের শিক্ষা। ধর্ম মানুষকে সম্প্রীতি ও পরমত সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। ধর্মের সঠিক জ্ঞান অর্জন ও অনুশীলন মানুষের মনে সুন্দর অনুভূতির জন্ম দেয়। মানবতার কবি, অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলাম যিনি জাতি ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাই তো তিনি লিখেছেন, গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান।’ তিনি লিখেছিলেন ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,/সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।

নজরুল যে কতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তা ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধ থেকে আরও স্পষ্ট হয়। তিনি লিখেছেন: “নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু, তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয় না। তার মন বলে, ‘আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি, আমারই মতো একজন মানুষকে।’

আসলে কে কোন ধর্মের অনুসারী তা মূল বিষয় নয়, বিষয় হলো আমরা সবাই মানুষ। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই এক জাতি। আমার ধর্মের সাথে, আমার মতের সাথে আরেকজন একমত নাও হতে পারে, তাই বলে কি তার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ রাখার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে? তাই আবারো বলতে চাই, ইসলাম শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম, ইসলাম সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ধর্ম নয় আর আমাদের এই দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ, এখানে কোনোরূপ সন্ত্রাস ও জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত কোনো অপশক্তির স্থান নেই।

চামড়ার রং, ধন-সম্পদের পরিমাণ, সামাজিক মর্যাদা, বংশ ইত্যাদির দ্বারা মানুষের মর্যাদার মূল্যায়ন হতে পারে না। মর্যাদা ও সম্মানের সঠিক মাপকাঠি হলো ব্যক্তির উচ্চমানের নৈতিক গুণাবলি এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি তার কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা। বিশ্বমানব একটি পরিবার বিশেষ। জাতি, উপজাতি, বর্ণ, বংশ ইত্যাদির বিভক্তি কেবল পরস্পরকে জানার জন্য, যাতে পরস্পরের চারিত্রিক ও মানসিক গুণাবলি দ্বারা একে অপরের উপকার সাধিত হতে পারে।

মহানবির (সা.) মৃত্যুর অল্পদিন আগে বিদায় হজের সময় বিরাট ইসলামি সমাগমকে সম্বোধন করে তিনি (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়।

শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করলো। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ।’ (বায়হাকি) এই মহান শব্দগুলো ইসলামের উচ্চতম আদর্শ ও শ্রেষ্ঠতম নীতিমালার একটি দিক উজ্জ্বলভাবে চিত্রায়িত করেছে। শতধা বিভক্ত একটি সমাজকে অত্যাধুনিক গণতন্ত্রের সমতা ভিত্তিক সমাজে ঐক্যবদ্ধ করার কী অসাধারণ উদাত্ত আহ্বান।

ইসলাম ধর্মে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। যারা সামাজিক পরিমণ্ডলে বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, রক্তপাত ঘটায়, ধ্বংস যজ্ঞ এবং নৈতিকতা বর্জিত অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড চালায়, তারা কখনো শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী হতে পারে না।

পবিত্র কোরআনের সুরা আল বাকারার ২৫৬ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো বল প্রয়োগ নেই। কারণ সৎ পথ ও ভ্রান্তি উভয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে; সুতরাং যে ব্যক্তি তাগুতকে (পুণ্যের পথে বাধা সৃষ্টিকারী বিদ্রোহী শক্তিকে) অস্বীকার করে এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনে, সে নিশ্চয়ই এমন এক সুদৃঢ় মজবুত করে ধরেছে, যা কখনো ভাঙবার নয়।’

আল্লাহপাকের প্রেরিত নবীগণ আল্লাহর নির্দেশে পথহারা মানুষকে হেদায়াত দিতে থাকেন। যখন তারা স্বয়ং এ শিক্ষা দেন, তখন তারা শুধু ধর্মান্তর গ্রহণের কারণে কারও প্রতি বল প্রয়োগ বা জুলুম করা কিরূপে শিক্ষা দিতে পারেন? ধর্ম কখনো অশান্তি ও রক্তপাতের উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয় নাই। কোনো ধর্ম গ্রহণ বা বর্জন করলে ইসলামে এর কোনো ধরনের শাস্তির বিধান নেই। শাস্তি দেওয়ার মালিক হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তাআলা।

আমরা দেখতে পাই হজরত নূহ (আ.) সমসাময়িক লোকদের ধর্মপথ ও পুণ্যের দিকে আহ্বান করেন। তিনি কখনো কারও প্রতি অত্যাচার করেন নাই। হজরত নূহ (আ.)-এর বাণী শুনে লোকজন বলেছিল, ‘হে নূহ! যদি তুমি এই ধর্ম হতে বিরত না হও এবং তোমার চালচলন পরিবর্তন না কর, তবে নিশ্চয়ই তোমাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হবে।’ (সুরা শোয়ারা: রুকু ৬)

হজরত ইব্রাহিম (আ.) শান্তি, প্রেম, সহানুভূতি ও গাম্ভীর্যের সাথে মানুষজনকে সত্যের পথে আহ্বান করেন। তার হাতে তো কোনো তরবারি ছিল না, ছিল না জুলুম করার কোনো উপকরণ। তার জাতির লোকজন তাকে বললো, ‘যদি তুমি তোমার বিশ্বাস ও প্রচার পরিত্যাগ করো, তাহলে ভালো কথা, নচেৎ তোমাকে আমরা প্রস্তরাঘাতে হত্যা করে ফেলবো।’ (সুরা মারইয়াম: রুকু ৩) অনুরূপভাবে, হজরত লুত (আ.) ও হজরত শোয়েব (আ.) এর প্রতিও বিরুদ্ধবাদীগণ একই নীতি অবলম্বন করেছিল।

আমরা সবাই জানি, আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করানো ধর্মীয় দৃষ্টিতে যদিও সবচেয়ে বড় অপরাধ কিন্তু এজন্য জাগতিক কোনো শাস্তির শিক্ষা ইসলামে পাওয়া যায় না। কোরআন শরিফে আল্লাহর শরিক করার তথা তাঁকে অবমাননা করার অনেক উদাহরণ দেওয়া আছে। কিন্তু কোথাও তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করানোর অপরাধে বা আল্লাহর প্রতি এক পুত্র-সন্তান আরোপ করার অপরাধে কোনো রকম জাগতিক শাস্তির বিধান দেওয়া হয়নি। মহানবি (সা.) নিজেও আল্লাহ তাআলার অংশীদার দাঁড় করানোর কারণে কাউকে কখনও শাস্তি দেননি। এসব বিষয়ের মীমাংসা হবে পরকালে আর স্বয়ং আল্লাহ তাআলা এসবের বিচার করবেন, কোনো বান্দা করবে না।

একইভাবে পবিত্র কোরআনে মহানবিকে (সা.) কাফেরদের পক্ষ থেকে যেসব ভাষায় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হতো তারও অনেক উদাহরণ দেওয়া আছে। (নাউজুবিল্লাহ মিন যালিকা) কিন্তু কোরআনের কোনো একটি স্থানেও এসব অবমাননাকর কথার জন্য জাগতিক কোনো শাস্তির নির্দেশ বা বিধান দেয়া হয়নি।

একজন বিশ্বাসী মুসলমানের অন্তর এসব কটূক্তির কারণে ক্ষত-বিক্ষত হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু এসব গর্হিত অপরাধের বিহিত একমাত্র আল্লাহর হাতে। এসব অন্যায় কাজের বিচারের ভার স্বয়ং আল্লাহ নিজের কাছে রেখেছেন। বিশ্বাসের-স্বাধীনতা হচ্ছে সব মানুষের মৌলিক অধিকার। ইসলাম ধর্মের বিধান মতে ‘ধর্ম’ হচ্ছে নিজ, পছন্দের একটি বিষয়। এ ধর্ম একটি সুস্পষ্ট ও শান্তির ধর্ম।

এই ধর্ম গ্রহণের পরেও চাইলে কেউ এটা ত্যাগ করতে পারে, কোনো জোর নেই, তবে এর বিচার সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজ হাতেই রেখেছেন। ধর্মে যদি বলপ্রয়োগের বিধানই থাকতো, তাহলে মহানবি (সা.) মক্কা বিজয়ের পর অমুসলমানদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য বাধ্য করতেন এবং মক্কায় বসবাসের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি! এতে প্রমাণিত হয় যে, ধর্মের জন্য বলপ্রয়োগ ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলামের আদর্শ হলো শত্রুর সাথেও বন্ধুসুলভ আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।

আমার ধর্মের সাথে, আমার মতের সাথে আরেকজন একমত নাও হতে পারে, তাই বলে কি তার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ রাখার নির্দেশ কোন ধর্মে রয়েছে? আমাদের এই দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ, এখানে কোনোরূপ সন্ত্রাস ও জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত কোনো অপশক্তির স্থান নেই।

যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মের সাথে শান্তিপূর্ণ অবস্থানের দৃষ্টান্তই আমরা লক্ষ্য করে আসছি। আমরা আশা করব এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। সম্প্রীতির চিরায়ত সেই বন্ধন ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী সবার মাঝে অটুট থাকবে-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

সনাতন ধর্মাবলম্বী সবার প্রতি রইল শারদীয় দুর্গোৎসবের শুভেচ্ছা।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মের সাথে শান্তিপূর্ণ অবস্থানের দৃষ্টান্তই আমরা লক্ষ্য করে আসছি। আমরা আশা করব এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। সম্প্রীতির চিরায়ত সেই বন্ধন ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী সবার মাঝে অটুট থাকবে-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।