চীনের ‘ঠান্ডা শিশির’ ও ডালিম প্রসঙ্গ

আলিমুল হক
আলিমুল হক আলিমুল হক
প্রকাশিত: ০৯:৩৫ এএম, ০৮ অক্টোবর ২০২২

আমার কাছে ফলের রাজা আম; আর আমের রাজা বাংলাদেশের দিনাজপুরের ল্যাঙরা। অবশ্য, আমার দ্বিতীয় পছন্দ ডালিম। আজকের লেখার সঙ্গে ডালিমের সংশ্লিষ্টতা আছে, আমের নয়। তাই ডালিম নিয়ে বলি। আম নিয়ে ভবিষ্যতে বলা যাবে।

ইংরেজিতে ডালিমকে বলে ‘পমেগ্রেনেট’। হিন্দি, ফার্সি ও পশতু ভাষায় এর নাম ‘আনার’; কুর্দি ভাষায় ‘হিনার’; আজারবাইজানি ভাষায় ‘নার’; সংস্কৃত ও নেপালি ভাষায় ‘দাড়িম’। মজাদার এই ফলটির আরও নাম আছে: বেদানা, দাড়িম্ব, রক্তবীজ, দাড়িম্বফল ইত্যাদি। কিন্তু নামে কী যায় আসে! খেতে কেমন, স্বাস্থ্যকর ও কল্যাণকর কি না, সেটাই বড় কথা।

ডালিম গাছ গুল্মজাতীয়। ৫ থেকে ৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। তুরস্ক, ইরান, সিরিয়া, স্পেন, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইরাক, লেবানন, মিশর, চীন, বার্মা, সৌদি আরব, ইসরায়েল, জর্ডান, ফিলিপিন্স, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শুকনো অঞ্চল, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, দক্ষিণ ইউরোপ এবং ক্রান্তীয় আফ্রিকায় ডালিম ব্যাপকভাবে চাষ হয়। তবে এর আদি নিবাস ইরান ও ইরাক।

jagonews24

অবশ্য যতদূর জানি, ককেসাস অঞ্চল থেকেই ভারত উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশে এর আগমন। ওদিকে স্পেন থেকে সম্ভবত ১৭৬৯ সালের দিকে, ডালিম যায় লাতিন আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়। এখন ক্যালিফোর্নিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের আরেক রাজ্য অ্যারিজোনায়ও এর চাষ হচ্ছে। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে ডালিমের চাষ হয় সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মার্চ থেকে মে-এর মধ্যে।

শুধু ফল হিসেবে নয়, ডালিম আয়ুর্বেদিক ও ইউনানী চিকিৎসায় পথ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ডালিমে বিউটেলিক অ্যাসিড, আরসোলিক অ্যাসিড এবং কিছু অ্যালকালীয় উপাদান থাকায়, এটি বিভিন্ন রোগ উপশমে ব্যবহৃত হয়। কবিরাজি মতে, ডালিম হচ্ছে হার্টের জন্য শ্রেষ্ঠ হিতকর ফল।এটি কোষ্ঠকাঠিন্যে আক্রান্ত রোগীদের জন্য উপকারী বলে মনে করা হয়। ডালিম গাছের শিকড়, ছাল ও ফলের খোসা দিয়ে আমাশয় ও উদরাময় রোগের ওষুধ তৈরি হয়।

jagonews24

ডালিমের ফুলও নির্দিষ্ট চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। দাবি করা হয় যে, গর্ভপাত ঠেকাতে ডালিম গাছের পাতা কার্যকর। এদিকে, এর শিকড় ক্রিমিনাশক। ডালিম গাছের ছাল শিশুদের পেটের রোগ নিরাময় করে। অনেকে মনে করেন, ডালিম শরীরে রক্ত বৃদ্ধি করে। আরও বলা হয়, ডালিম হচ্ছে প্রাকৃতিক ইনসুলিন। এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। মোদ্দাকথা, ডালিম গাছের পাতা থেকে শুরু করে শিকড় পর্যন্ত কোনোটাই ফেলনা নয়; এর পুরোটাই মানুষের জন্য কল্যাণকর।

বলা বাহুল্য, চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতিতে ডালিম ও ডালিম গাছের ব্যবহার হয়ে আসছে প্রাচীন কাল থেকে। ডালিমের অনন্য সৌন্দর্য, সুগন্ধ, রং ও এর গুণাবলি চীনাদের কাছে প্রাচীনকাল থেকেই স্বীকৃত। চীনাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ফল কোনটি আমি ঠিক জানি না। তবে সাধারণভাবে চীনারা ডালিম খেতে পছন্দ করে। আর তাদের কাছে ডালিম খাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে ‘হানলু’ সৌরপদ।

jagonews24

চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদে। প্রাচীন চীনে হলুদ নদীর অববাহিকায় এই ২৪ সৌরপদের উৎপত্তি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ২৪ সৌরপদ ‘চীনের পঞ্চম মহান আবিষ্কার’ (Fifth Great Invention of China) হিসেবে স্বীকৃত। ইউনেস্কোও একে মানবজাতির অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

চীনের ২৪টি সৌরপদ বা সোলার টার্ম হচ্ছে: লিছুন (বসন্তের শুরু), ইয়ুশুই (বৃষ্টির পানি), চিংচ্য (পোকামাকড়ের জাগরণ), ছুনফেন (বসন্ত বিষুব), ছিংমিং (তাজা সবুজ), কুইয়ু (শস্য-বৃষ্টি), লিসিয়া (গ্রীষ্মের শুরু), সিয়াওমান (ছোট পূর্ণতা), মাংচুং (ফসল বোনার সময়), সিয়াচি (উত্তরায়ন), সিয়াওশু (কম গরম), তাশু (বেশি গরম), লিছিয়ু (শরতের শুরু), ছুশু (গরমের শেষ), পাইলু (শুভ্র শিশির), ছিউফ্যন (শারদীয় বিষুব), হানলু (ঠান্ডা শিশির), শুয়াংচিয়াং (প্রথম হিমেল হাওয়া), লিতুং (শীতের শুরু), সিয়াওসুয়ে (ছোট তুষার), তাসুয়ে (বড় তুষার), তুংচি (দক্ষিণায়ন), সিয়াওহান (ছোট শীত), তাহান (বড় শীত)।

jagonews24

প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। চীনে হাজার হাজার বছর আগে এই সৌরপদ-ব্যবস্থার উৎপত্তি। প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে। বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে— তা নাম দেখলেই আন্দাজ করা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে।

বলছিলাম, হানলু সৌরপদে চীনারা বিশেষভাবে ডালিম খায়। চীনা ভাষায় ‘হান’ মানে ‘ঠান্ডা’ এবং ‘লু’ মানে ‘শিশির’। ‘পাইলু’ বা ‘শুভ্র শিশির’ সৌরপদের তুলনায় হানলু-তে বেশি ঠান্ডা অনুভূত হয়। এ সময় যে শিশির পড়ে, তা তুলনামূলকভাবে বেশি ঠান্ডাও হয়। এ সৌরপদে কম বৃষ্টিপাত হয় এবং শরতের ফসল পাকে। হানলু সৌরপদের ব্যাপ্তিকাল ৮ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত।

jagonews24

হানলু-কে ‘কুয়াশাচ্ছন্ন শরৎ’ও বলা যায়। এ সময় তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে; দেশের অনেক অঞ্চল ঢাকা পড়ে ঘন কুয়াশার চাদরে। কোথাও কোথাও দেখা দেয় কুহেলিকা বা কুজ্ঝটিকা। এখানে বলে রাখি, কুহেলিকাও কুয়াশা, তবে কুয়াশার তুলনায় এর ঘনত্ব কম। ফলে কুয়াশাচ্ছন্ন এলাকার দৃশ্যমানতা তুলনামূলকভাবে কম থাকে।

হানলু মাছ ধরার উত্তম সময়। হানলু সৌরপদে অগভীর জলে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়; ধরাও সহজতর। এর কারণও আছে। এ সৌরপদে তাপমাত্রা অনেক কমে যায় এবং কুয়াশার কারণে জলের খুব গভীরে সূর্যালোক পৌঁছাতে পারে না। ফলে, জলের গভীরে ঠান্ডা বেশি হয়। তখন, মৎস্যকূল অগভীর জলে চলে আসে, যেখানে তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি।

jagonews24

হানলু সৌরপদে চীনারা চন্দ্রমল্লিকা থেকে তৈরি ওয়াইন পান করে। চন্দ্রমল্লিকার ইংরেজি ক্রিসেন্থেমাম (Chrysanthemum)। এটি একটি অতি পরিচিত ফুল। চীনে সবচেয়ে বেশি প্রজাতির চন্দ্রমল্লিকা পাওয়া যায়। হানলু সৌরপদের আইকনিক ফুল হচ্ছে এই চন্দ্রমল্লিকা। শরতের শুষ্কতা কাটাতে, এই সৌরপদে চীনের বহু অঞ্চলের মানুষ ক্রিসেন্থেমাম ওয়াইন পান করে। চীনে প্রাচীনকাল থেকেই এ কথাটি প্রচলিত আছে: চন্দ্রমল্লিকা, পরিয়া কোকোস মাশরুম (poria cocos mushroom) ও পাইন ওলেওরেসিন (pine oleoresin) থেকে তৈরি ওয়াইন পান করলে মানুষের যৌবন দীর্ঘস্থায়ী হয়।

হানলু সৌরপদে চীনের উত্তরাঞ্চলের আকাশে সাদা মেঘ দেখা দেয়; গাছ-গাছালির পাতা ধারণ করে লাল রং। সময়টা হাইকিংয়ের জন্য উত্তম। কেউ কেউ এক ধরনের বিশেষ উদ্ভিদ সাথে নিয়ে পাহাড়ে আরোহণ করেন। তারা বিশ্বাস করেন, এর মাধ্যমে অপশক্তির কবল থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। এই বিশ্বাস ও প্রথার উৎপত্তি পূর্বাঞ্চলীয় হান রাজবংশ (Eastern Han Dynasty) আমলে। আজও কোনো কোনো চীনা এ প্রথা অনুসরণ করেন।

jagonews24

চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় হুনান প্রদেশের তুং জাতির লোকেরা হানলু সৌরপদে বিশেষভাবে ‘কিপার’ নামক এক ধরনের তেলসমৃদ্ধ মাছ খায়। বলা হয়, হানলু সৌরপদে কিপারের সঙ্গে চাল থেকে তৈরি ওয়াইন, লবণ, আঁঠালো ভাত, মরিচের গুঁড়া, পাপড়িকা গুঁড়া ও আদা বিশেষভাবে সুস্বাদু।

চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ হুনান টি সিড অয়েল উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। টি সিড অয়েল হচ্ছে উদ্ভিজ্জাত ভোজ্যতেল। এই তেল উৎপন্ন হয় ক্যামেলিয়ার সিড বা বীজ থেকে। হানলু সৌরপদে কৃষকরা পাহাড় থেকে এ বীজ সংগ্রহ করেন। এ সৌরপদের আগে ক্যামেলিয়ার বীজ তোলা নিষিদ্ধ। যুগ যুগ ধরে হুনান প্রদেশে এই রীতি অনুসৃত হয়ে আসছে।

jagonews24

একটি গল্প বলে আজকের লেখার ইতি টানবো। প্রায় ৮০০ বছর আগে চীনের এক সম্রাটের উপপত্নী ক্ষুধামন্দা রোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসকরা তাকে ভালো ভালো ওষুধ খেতে দেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। তখন রাজপ্রাসাদের বাইরের একজন সাধারণ চিকিৎসক দিলেন এক অভিনব প্রেসক্রিপশন। রাতের খাবারের আগে চিনির সিরায় ডুবিয়ে পাঁচ থেকে দশটি সিদ্ধ হথর্ন ফল খেতে হবে।

চিকিৎসকের পরামর্শ মতো হথর্ন খাওয়া শুরু করলেন সম্রাটের উপপত্নী। মাত্র ১৫ দিনের মধ্যেই তার মুখের রুচি ফিরে এলো। বলা বাহুল্য, চীনে আজও হারবাল ওষুধ হিসেবে হথর্নের ব্যবহার আছে। আর হানলু সৌরপদে চীনারা বিশেষভাবে হথর্ন খেয়ে থাকে। চীনা ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসারে, হথর্ন শুধু ক্ষুধামন্দা দূর করে না, এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস হার্ট সুস্থ রাখে।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি), বেইজিং।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এমএস

হানলু সৌরপদে চীনের উত্তরাঞ্চলের আকাশে সাদা মেঘ দেখা দেয়; গাছ-গাছালির পাতা ধারণ করে লাল রং। সময়টা হাইকিংয়ের জন্য উত্তম। কেউ কেউ এক ধরনের বিশেষ উদ্ভিদ সাথে নিয়ে পাহাড়ে আরোহণ করেন। তারা বিশ্বাস করেন, এর মাধ্যমে অপশক্তির কবল থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। এই বিশ্বাস ও প্রথার উৎপত্তি পূর্বাঞ্চলীয় হান রাজবংশ (Eastern Han Dynasty) আমলে। আজও কোনো কোনো চীনা এ প্রথা অনুসরণ করেন।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।