গণম্যাধ্যম
ক্ষমতার স্বার্থ ও সাংবাদিকতা

তথ্যের উৎস বা সূত্র প্রকাশ না করতে সাংবাদিকদের আইনগতভাবেই সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে বলে এক রায়ে অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ঘটনা, পারিপার্শ্বিকতা ও আইনি দিক পর্যালোচনা করে এটি বলতে দ্বিধা নেই যে সাংবাদিকদের তথ্যের উৎস প্রকাশ না করতে সুরক্ষা দিয়েছে আইন।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ গত ২১ জুন ওই রায় দেন। রোববার (২৩ অক্টোবর) ৫০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়। আদালত বলেছেন, দুর্নীতি ও দুর্নীতির চর্চা, মানি লন্ডারিংসহ জনস্বার্থ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশে সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে এখতিয়ার রাখেন গণমাধ্যম ও সাংবাদিকেরা।
আদালতকে কেন এটা বলতে হলো তারও একটি প্রেক্ষিত আছে। গত বছর ২ মার্চ - দুর্নীতি দমনে দুদক স্টাইল ২০ কোটিতে প্রকৌশলী আশরাফুলের দায়মুক্তি! - শিরোনামে একটি দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি নজরে আনা হলে হাইকোর্ট ওই বছরের ৮ মার্চ স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক প্রকৌশলী আশরাফুল আলম এবং তাঁর স্ত্রীকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।
উচ্চ আদালতকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। তবে একই সাথে প্রশ্ন উঠে, তথ্যের সূত্র জানতে এত আগ্রহ কেন? সারা পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় গণমাধ্যমকে গণ্য করা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে। নীতি নৈতিকতার জায়গা থেকে এটাই গ্রহণযোগ্য যে, সাংবাদিক কোথা থেকে তথ্য পেলেন, সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়, বিবেচ্য বিষয় হলো, তথ্যটি সত্য কি না। সাংবাদিকেরা যেহেতু জনগণের স্বার্থে তথ্য প্রকাশ করেন, সেহেতু তারা তথ্যের উৎস জানাতে বাধ্য নন।
এই রায়ে আদালত একই সঙ্গে হলুদ সাংবাদিকতা অননুমোদিত এবং আদৌ প্রশংসনীয় নয় বলে যে মন্তব্য করেছেন, পেশাদার সাংবাদিকরা তা সমর্থন করেন। সাংবাদিকের দায়িত্ব সত্য প্রকাশ করা, চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা নয়, মনগড়া কাহিনী প্রচার করা নয়। হলুদ সাংবাদিকতা যারা করেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিলে কোন সাংবাদিক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানই বিরোধিতা করবে না।
তথ্য সংগ্রহের জন্য সাংবাদিককে রাজনৈতিক নেতা, আমলা, ব্যবসায়ী এমনকি অপরাধীর সঙ্গেো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করতে হয়। ঘনিষ্ঠতা অর্জন হলে, তাদের বিশ্বাস করলে তবেই তারা একান্তে সাংবাদিককে অনেক গোপন তথ্য জানাবেন। আমি নিজেও বহুবার এরকম পরিস্থিতিতে পড়েছি। একবার কাঠগড়াতেও দাঁড়াতে হয়েছিল। কিন্তু কোন চাপেই তথ্যের সূত্র জানাইনি, জানাবও না। আদালতে দাঁড়িয়েও সাংবাদিক সূত্র প্রকাশ করতে বাধ্য নন।
যারা ক্ষমতা কাঠামোর ভেতর থাকে, তারা অভিযোগ করেন যে সাংবাদিকদের চোখে ভালো কোন খবর চোখে পড়েনা, শুধু নেতিবাচক খবর দেখেন। তারা ভুলে যান যে, ভালো কিছু করার জন্যই তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং সেটা খবর না। যখন এর ব্যত্যয় ঘটে তখনই খবর জন্ম নেয়। গণমাধ্যমের পক্ষে খারাপ খবরের চেয়ে ভাল খবর আর নেই। দুর্ঘটনা, দাঙ্গা, মহামারি, বন্যা, যুদ্ধ, গণমৃত্যু ইত্যাদি ভয়ঙ্কর তথ্যেই সাংবাদিকের বিচরণ। তবে সাংবাদিকে লিখতে বা বলতে হয় সাংবাদিকতার নিয়ম মেনে।
সংবাদ-উৎসারিত কোন কিছুই কল্পনাসৃজিত নয়, সাহিত্যও নয়। তা সম্পূর্ণ ভাবে বাঁধা ঘটনা ও তথ্যের কাঁটাতারে। যে কাঁটাতার তৈরি রয়েছে নৈতিক ও সামাজিক নিয়ম দিয়ে। তবে সবচেয়ে বেশি হয়েছে সাংবাদিকের সংযমবোধ দিয়ে। সাংবাদিক কোন তথ্য কতটুকু কীভাবে প্রকাশ করবেন তার একটা কাঠামো আছে, নৈতিকতার মানদণ্ড আছে, সাংবাদিকতার নীতিমালা আছে।
মাঠে নেমে সাংবাদিকতা করার জন্য আবেগ প্রয়োজন, কিন্তু সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। ব্যক্তিগত বিশ্বাস যাই থাকুক তাকে সরিয়ে রেখে সত্য প্রকাশে আবেগহীন হতে হয়। সংঘাত, সহিসতা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতে গেলে একটা বিশেষ সাহস দরকার হয়। কিন্তু সবক্ষেত্রেই একটি ভারসাম্যে ধরে রাখাটা জরুরি, যাতে বর্ণিত বিষয়ের বাস্তবতা নষ্ট না হয়। এটাই পেশাদারিত্ব। আলগা, অগোছালো, গন্তব্যহীন আবেগে কাজের কাজ হয় না।
ক্ষমতার সাথে সবসময় সাংবাদিকের দ্বন্দ্ব থাকে। সংবাদ মাধ্যম রাষ্ট্র ও রাজনীতির সমালোচনা করে, রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সমালোচনা করে, অনিয়ম ও দুর্নীতি তুলে ধরে, কর্পোরেটের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে তথ্য প্রকাশ করে। আর এ কারণেই ক্ষমতা কাঠামোর মানুষেরা খড়গহস্ত হয়। এরাই রাষ্ট্রকে দিয়ে নানা নিপীড়নমূলক আইন করে, চাপ প্রয়োগ করে।
দেশের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজ, সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দলের কর্মীরা এই বিষয়ে একমত যে গণমাধ্যমের এবং নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকা অবশ্যই দরকার। বাংলাদেশের সংবিধানে এই বিষয়ে যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তবে তা শর্তসাপেক্ষ এবং তা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রের হাতে বেশুমার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি বাধা আসে রাষ্ট্র থেকে। রাষ্ট্রের আইন ও আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলাকেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অপব্যবহার বলে চিহ্নিত করা হয়। আর হলো ভাবমূর্তি আর অনুভূতি যার কোন সীমি পরিসীমা নেই।
আমরা স্বাধীন সাংবাদিকতা চাই, পেশাদারিত্বের সাথে তা করতে চাই, চাই নীতি নৈতিকতা মেনে। কিন্তু ক্ষমতার স্বার্থ যেন সাংবাদিকের স্বাধীনতাকে খর্ব না করে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এমএস