কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি এবং সংশোধিত শ্রম বিধিমালা

এরশাদুল আলম প্রিন্স
এরশাদুল আলম প্রিন্স এরশাদুল আলম প্রিন্স
প্রকাশিত: ০৯:০১ এএম, ০৯ ডিসেম্বর ২০২২

দেশের বিদ্যমান শ্রম আইন ২০০৬-এর অধীনে ২০১৫ সালে একটি শ্রম বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। সম্প্রতি ওই বিধিমালায় বেশকিছু পরিবর্তন ও সংশোধন করা হয়েছে। শতাধিক বিধির পরিবর্তন আনা হয়েছে। সংশোধিত বিধিমালায় বেশকিছু ইতিবাচক পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে বেশ কিছু ধারায় শ্রমিক স্বার্থবিরোধী নেতিবাচক পরিবর্তনও আনা হয়েছে।

সংশোধিত বিধির বেশ কিছু ধারায় নারী শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। এমনিতেই দেশের নারীরা কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। শিক্ষায় নারীরা এগিয়ে গেলেও কর্মক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ এখনও অনেক কম। এরপরও যারা আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারেন, নানা পারিবারিক ও সামাজিক কারণে এবং প্রতিবন্ধকতায় তাদের একটি বড় অংশ শেষ পর্যন্ত চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন।

এরপরও যারা টিকে থাকেন নানা আইনগত সুবিধার অপ্রাপ্তি ও চাকরিস্থলের ইতিবাচক মনোভাবের অভাবে শেষপর্যন্ত তারা আর চাকরিতে টিকে থাকতে পারেন না। এছাড়া নারীর স্বাভাবিক স্বাস্থ্যগত কারণও এর পেছনে একটি বড় কারণ। কিন্তু সে বাস্তবতাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু কাজের পরিবেশ ও সহকর্মী এবং সবার ইতিবাচক মনোভাব কর্মক্ষেত্রে নারীর টিকে থাকার সংগ্রামটি আরও সহজতর করতে পারতো। কিন্তু আমাদের দেশে সেটি হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে শ্রমিক, মালিক, সরকার ও সহকর্মী সবাই কিছু না কিছু ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে।

অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের খুব কম প্রতিষ্ঠানই কর্মক্ষেত্রে নারীর আইনগত অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো নারী শ্রমিকের আইনগত অধিকার দিয়ে থাকে তাদের বেশিরভাগই আবার বহুজাতিক কোম্পানি। অধিকাংশ দেশীয় সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো নারী শ্রমিকের অধিকারের ব্যাপারে উদাসীন।

কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার ও সুবিধার মধ্যে প্রধানতম বিষয় হচ্ছে তার মাতৃত্বকালীন সুযোগ-সুবিধা। এ ব্যাপারে বেশিরভাগ অফিস ও কল-কারখানাই উদাসীন। সুবিধা দেওয়া তো পরের কথা উপরন্তু মাতৃত্বকালীন ছুটি নিতে গেলে নারীদের চাকরি হারানোর ভয়ও থাকে। মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুবিধা চাইতে গেলে বাধ্যতামূলক চাকরিচ্যুতির হুমকির কথা প্রায়ই শোনা যায়। অথবা শিশু জন্ম নেওয়ার পরে আবার যোগদান করার জন্যও বলা হয় যাতে এ সময়ের চাকরিকালীন সুবিধাদি ওই নারী শ্রমিককে দিতে না হয়।

শিশুদের জন্য ডে কেয়ারের সুবিধা রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠান দেশে নেই বললেই চলে। কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি ছাড়া সব প্রতিষ্ঠানই এ বিষয়টি উপেক্ষা করছে। অথচ এদেশে অনেক বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী রয়েছে, রয়েছে বড় বড় শিল্পকারখানা এমনকি শিল্প এলাকাও, যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করে যাদের বড় একটি অংশ আবার নারী শ্রমিক। কিন্তু সেখানে একটি ডে কেয়ার নেই। ফলে শিশুর দেখাশোনার জন্য অনেক নারী কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। অথচ কর্মক্ষেত্রে এগুলো প্রতিষ্ঠিত আইনগত অধিকার। আন্তর্জাতিকভাবেও এ অধিকারগুলো স্বীকৃত। কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য এ সুবিধা দেওয়া কোনো অপশন নয়, এগুলো বাধ্যতামূলক। কিন্তু দিনের পর দিন এ বিধানের কোনো বাস্তবায়ন হয় না। সংশোধিত বিধির একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে গর্ভপাতের জন্য চার সপ্তাহের ছুটির বিধান (৩৮ ক)। এটি ইতিবাচক সন্দেহ নেই।

কিন্তু নতুন এ বিধিতে নারী শ্রমিকের মাতৃ্ত্বকালীন সুবিধা হিসাব করার এক অভিনব পদ্ধতি সংযোজন করা (৩৯ক) হয়েছে। এর মাধ্যমে নারী শ্রমিকরা এতদিন মাতৃত্বকালীন যে আর্থিক সুবিধা পেত তা অনেকাংশে হ্রাস করা হলো। বিদ্যমান শ্রম আইনে নারী শ্রমিকের বিগত তিন মাসের গড় মজুরিকে (বেতন, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা, হাজিরা বোনাসসহ অন্যান্য ভাতাসহ) ওই তিন মাসের প্রকৃত কর্মদিবস দিয়ে ভাগ করে যে অর্থ আসে, মাতৃত্বজনিত ছুটিকালে ওই নারী শ্রমিককে সে পরিমাণ আর্থিক সুবিধাই প্রদান করা হতো।

কিন্তু সংশোধিত বিধিমালা অনুযায়ী, শ্রমিকের মোট মজুরিকে ২৬ কর্মদিবস দিয়ে ভাগ করে যা হয় ওই নারী শ্রমিককে সেই পরিমাণ আর্থিক সুবিধাই দেওয়া হবে। এতে আর্থিক সুবিধার পরিমাণ অবশ্যই কমে যাবে। কোনো পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, এসব সুবিধা ৬ শতাংশ এর চেয়েও বেশি কমে যেতে পারে। প্রসূতি নারীদের আর্থিক সুবিধা হ্রাস করার এই হিসাব পদ্ধতি নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রের অধিকারকে আরও সংকুচিত করলো।

বিদ্যমান শ্রম আইনের ৪৮ ধারা অনুযায়ী ছুটি নেওয়ার আগের তিন মাসের গড় বেতন হিসাব করে ওই তিন মাসের প্রকৃত কর্মদিবস দিয়ে ভাগ করে একজন প্রসূতিকালীন নারী শ্রমিককে বেতন ও মজুরি দেওয়া হতো। এছাড়া ওই তিন মাসে ওই নারী শ্রমিক যে কদিন বৈধ ছুটি পেত সে কদিন বাদ দিয়ে গড় হিসাব করা হতো। এতে তার আর্থিক সুবিধা আরও বেড়ে যেতে।

এছাড়া ওই তিন মাসের ওভারটাইমের টাকাও এর সঙ্গে যোগ হতো। কিন্তু নতুন বিধিমালায় পূর্ববর্তী তিন মাসের পরিবর্তে একমাসের গড় হিসাব করে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাও আবার প্রকৃত কর্মদিবস দিয়ে ভাগ না করে ২৬ দিয়ে ভাগ করে তার গড় হিসাবে ছুটিকালীন মজুরি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে করে ওই প্রসূতি নারী শ্রমিকের বেতন বা মজুরি অবশ্যই কমে যাবে। এটি অযৌক্তিক ও নারী শ্রমিকের স্বার্থবিরোধী। এছাড়া ২৬ দিয়ে ভাগ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। মাসে চারদিন (৩০-৪) বাদ দেওয়ার ভিত্তি কি? দেশের সাপ্তাহিক সরকারি ছুটি হিসাব করলেও ২২ দিন কর্মদিবস হিসাব করতে হবে, ২৬ দিন নয়।

একইভাবে একজন প্রসূতি নারী মাতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়ার ঠিক আগের মাসে ওভার টাইম করবেন না বা করলেও কম করবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিন মাসের ওভারটাইম হিসাব না করে শুধু শেষ মাসের ওভারটাইম হিসাব করার বিষয়টি নারীদের বঞ্চিত করার মানসেই করা হয়েছে। এছাড়া এর অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। এটি বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এছাড়া আইনে ইতোমধ্যে প্রদত্ত একটি ইতিবাচক অধিকার খর্ব করা যায় না। এটি একটি সাধারণ নীতি। নতুন বিধিতে তাই করা হয়েছে।

আইনানুযায়ী প্রসূতি নারীর জন্য সন্তান প্রসবের আগে আট সপ্তাহ ও পরে আট সপ্তাহের ছুটির বিধান আছে। আইন বলছে, কোনো প্রতিষ্ঠান জ্ঞাতসারে প্রসবের আট সপ্তাহের মধ্যে ওই শ্রমিককে কাজে যোগদান করাবেন না। কিন্তু নতুন বিধান বলছে, প্রসব আকাঙ্ক্ষিত তারিখের পরে হয়ে থাকলে পরবর্তী আট সপ্তাহের ছুটির সঙ্গে ওই ছুটি সমন্বয় করা হবে। এটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে প্রসব পরবর্তী দুই মাস ছুটি কমে যেতে পারে (প্রসবের দুই মাস আগেই তাকে কাজে যোগদান করতে হবে)। এছাড়া এই বিধানের আর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

শ্রম আইনের ৯৯ (৩) অনুসারে শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প খাতসহ অন্যান্য শিল্প খাতের শ্রমিকদের জন্য সরকার কর্তৃক একটি কেন্দ্রীয় শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন করার কথা রয়েছে। শ্রমিকদের কল্যাণমূলক কাজে সে অর্থ ব্যয় হবে। আগে এ সুবিধা পাওয়ার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে একজন শ্রমিককে কতদিন কাজ করতে হবে তা নির্দিষ্ট ছিল না। কিন্তু বর্তমান বিধানে একজন শ্রমিককে ওই সুবিধা পেতে হলে কমপক্ষে ৯ মাস কাজ করতে হবে। ফলে অনেক শ্রমিকই এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে, যা বিদ্যমান আইনের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।

এছাড়া আরও কয়েকটি বিষয় এ বিধানে সংযুক্ত করার প্রয়োজন থাকলেও তা করা হয়নি। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দুজন বিশেষজ্ঞসহ পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করতে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও এ বিষয়ে এ বিধানে কিছু বলা হয়নি। নারীর জন্য নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই শ্রমিক তথা নারী শ্রমিকের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় এমন যেকোনো বিধান পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

লেখক: আইনজীবী, কলাম লেখক।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দুজন বিশেষজ্ঞসহ পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করতে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও এ বিষয়ে এ বিধানে কিছু বলা হয়নি। নারীর জন্য নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই শ্রমিক তথা নারী শ্রমিকের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় এমন যেকোনো বিধান পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।