রাজনীতি

নির্বাচন সামনে রেখে শান্তি ও সম্প্রীতির সংকট

মোনায়েম সরকার
মোনায়েম সরকার মোনায়েম সরকার , রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:০৩ এএম, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

চলতি বছর ডিসেম্বর মাসেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আভাস দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ দলগতভাবে এই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও জানা গেছে। আগামী নির্বাচন আগের দুটি নির্বাচনের মতো হবে না বলেও সব মহল থেকেই বলা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দলের যারা নির্বাচন করতে চান, তাদের মানুষের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, সবাইকে নিজ নিজ যোগ্যতায় নির্বাচনে জিততে হবে, তিনি কাউকে জিতিয়ে আনার দায়িত্ব নেবেন না।

আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে লড়ার লোকের অভাব নেই। এখন যারা এমপি আছেন, তাদের বাইরেও অনেকে আছেন, যারা প্রার্থী হওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন। কাকে রেখে, কাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে, যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে তার বিরুদ্ধে এক আসনে কয়জন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হবেন, তা আগাম বলা যাবে না। তবে এটা নিশ্চিত, উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইও এবার আওয়ামী লীগের জন্য খুব সহজ হবে না।

আওয়ামী লীগ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হলেও বিএনপি কি করবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না, গ্রহণযোগ্য হবে না। আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশ বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করার বিপক্ষে। বিএনপি নির্বাচনে যেতে চায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। ঐক্যবদ্ধ প্রবল গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন হবে বলে বিএনপি আশাবাদী। তাদের এই আশাবাদের কোনো বাস্তবভিত্তি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা খুঁজে পান না।

সরকার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করবে, নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে- তারপর বিএনপি নির্বাচনে যাবে, সরকার মোটেও তার জন্য বসে নেই। বিএনপি একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে ছিল। খালেদা জিয়া নিজেই বলেছিলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়। এখন বিএনপির মতো বদলেছে কিন্তু সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানই বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার সেই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। সংসদে তো বিএনপির একজন সদস্যও নেই। এই বাস্তবতায় বিএনপির দাবি পূরণের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

শেখ হাসিনা এখন একাই সবদিক সামলান বলে শোনা যায়। তিনি আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, জাতীয় পার্টির সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিও সামলাচ্ছেন বলে অনেকে মনে করেন। শোনা যাচ্ছে, বিএনপি যদি দলীয়ভাবে সরকার পতনের পর নির্বাচনে যাওয়ার গো ধরে বসে থাকে, তাহলে বিএনপির ভাঙন অনিবার্য।

বিএনপির অনেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উকিল আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়া হওয়ার জন্য প্রস্তুত। সরকার যে বিএনপিতে নির্বাচনের পক্ষের নেতাদের মদত দেবে তাতে সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগ এবার প্রয়োজনে ১০০-১২০ আসন ছেড়ে দিয়ে বিজয়ী হওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে বলেও প্রচার আছে।

অবশ্য সব কিছুর আগে দরকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখন যেভাবে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে তাতে সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা বাড়ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা মাঠ ছাড়বে না, আর ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিও মাঠের দখল নিতে মরিয়া। দুই দলের কেউ কাউকে ছাড় না দেওয়ার মহড়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে দেশে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়ে কার্যত সংঘাতময় পরিবেশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। এখনো বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়নি ঠিকই, কিন্তু হবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। অনেক উন্নয়নও হয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায়। কাজেই আওয়ামী লীগের এখন যে রকম আত্মবিশ্বাসী থাকার কথা, তা কি আছে? আওয়ামী লীগ কেন বিএনপির কর্মসূচির পেছনে হাঁটছে? বিএনপির কর্মসূচি বিএনপি করুক। যদি রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দলটি আবার অগ্নিসন্ত্রাস বা হিংসাত্মক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সেটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। দলগতভাবে পাল্টা ব্যবস্থা নিলে সেটা সামাল দেওয়া সহজ না-ও হতে পারে।

১১ ফেব্রুয়ারি শনিবার ছিল ইউনিয়ন পর্যায়ে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি। বিএনপি এই কর্মসূচি ঘোষণার পর আওয়ামী লীগও ইউনিয়ন পর্যায়ে একই ধরনের কর্মসূচি দেয়। আওয়ামী লীগ অবশ্য স্বীকার করে না যে তারা বিএনপির পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে।

দুই দলের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছিল, কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বিএনপি দাবি করছে, প্রতি জেলায় তাদের কর্মসূচিতে হামলা হয়েছে। আবার আওয়ামী লীগ বলেছে, কয়েকটি জেলায় তাদের শাস্তি সমাবেশে বিএনপি হামলা করেছে। দুই পক্ষের দুই শতাধিক আহত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। প্রাণহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি, এটাই বড় স্বস্তির।

পরের দিন প্রায় সবগুলো জাতীয় দৈনিকে বিভিন্ন স্থানে দুই দলের হামলা ও সংঘর্ষের খবর ছাপা হয়েছে। সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কয়েকটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি কর্মীরা। বিএনপির পদযাত্রায় শ্রীপুর উপজেলার বরমীবাজারে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে এক যুবকের ছবিও গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে।

এই যুবককে শনাক্ত করা গেলে তার রাজনৈতিক পরিচয়ও জানা যাবে। তবে হামলা বা সংঘর্ষের জন্য কোন দল বেশি দায়ী, কোন দলের দায় কম- সেই বিতর্কে না গিয়ে আমি বরং বলতে চাই, দুর্বুদ্ধির পরাজয় হোক, রাজনৈতিক নেতৃত্বের শুভবুদ্ধির জয় হোক।

রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ-আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের পথে না হেঁটে কেন মাঠের শক্তি পরীক্ষায় নামতে চায় তা আমার বোধে আসে না। এতে তো বিপদ বাড়ে নিরীহ সাধারণ পথচারীসহ নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত মানুষের।

বিএনপির যদি এই ভরসা দৃঢ় থাকে যে সরকার তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে, সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই, মানুষের সমর্থন বিএনপির দিকেই, তাহলেও বিএনপির উচিত অযথা উত্তেজনা তৈরি না করে ভোটের প্রস্তুতি নেওয়া এবং ভোটের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার যে কোনো মেকানিজম ঐক্যবদ্ধভাবেই রুখে দেওয়ার জন্য মানুষকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা।

মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ করা ছাড়াও এখন মানুষকে সচেতন করার শান্তিপূর্ণ অনেক বিকল্প উপায় আছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ছাড়াও মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছানোর অনেক উপায় এখন আছে। তা সত্ত্বেও বিএনপি কেন পুরোনো ধারার আন্দোলনেই নিজেদের সীমিত রাখতে চাইছে? সবাইকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে অভ্যস্ত হতে হবে।

এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়, বাসস্থান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনা প্রায় নিয়মিতভাবেই ঘটছে। এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক প্রতিবাদ সমাবেশে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বারবার সাম্প্রদায়িক হামলাকারীদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স দেখানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু এ ঘোষণার বাস্তবায়ন আমরা কোথাও দেখছি না।

সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি জাতীয় ঐক্য মঞ্চ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, এ মঞ্চ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে এ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যাতে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে, তার নিশ্চয়তা প্রদান করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে হবে।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় মতুয়া সম্মেলনসহ সারাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণের ওপর নতুন করে যে হামলা, হুমকি, দেববিগ্রহ ভাঙচুর ও ধর্ম অবমাননার ঘটনা শুরু হয়েছে, তার প্রতিবাদে পরিষদের নেতৃত্বাধীন সংখ্যালঘু ঐক্যমোর্চা এ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছিল।

অনুষ্ঠানে রানা দাশগুপ্ত আরও বলেছেন, সরকার সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও জাতীয় সংখ্যালঘু সুরক্ষা কমিশন গঠন করা এবং বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, পার্বত্য শান্তি চুক্তি, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন এবং সমতলে আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করার অঙ্গীকার করেছিল।

আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের আগেই যদি অঙ্গীকারগুলোর বাস্তবায়ন না করা যায়, ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী যদি মনে করে তারা আরও একবার প্রতারিত হয়েছেন এবং এ প্রতারণার প্রতিবাদে তারা নির্বাচনে যাবে কি যাবে না, এমন সিদ্ধান্ত যদি নেয়, তার জন্য নির্বাচনে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, সেজন্য সংখ্যালঘুদের কোনোভাবেই দায়ী করা যাবে না।

সমাবেশে অন্য বক্তারা বলেছেন, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ আবার পুর্ণোদ্যমে শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে সারাদেশের ঘটনাগুলো যেভাবে এগোচ্ছে তাতে মনে হয় সামনের দিনগুলো তাদের জন্য নিদারুণ শঙ্কার। যে কোনো সময় ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন তারা।

সংখ্যালঘু নেতারা ঢাকা মহানগরের যাত্রাবাড়ী এলাকার ধলপুরের তেলেগু সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের উচ্ছেদের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অপপ্রয়াসের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়া বিনা নোটিশে তাদের উৎখাতের যে কোনো অপপ্রয়াস বেআইনি, অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারমূলক। তারা এহেন বেআইনি কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন।

নির্বাচন কেন্দ্র করে অতীতে সংখ্যালঘুদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন হয়েছে। কোনোটারই কোনো বিচার বা প্রতিকার হয়নি। ভোট এলে তাই সংখ্যালঘুদের মধ্যে অনিরাপত্তাবোধ বেড়ে যায়। দেশত্যাগী হওয়ার কথাও কেউ কেউ ভাবতে থাকে।

আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়া, না দেওয়াকে ইস্যু করে সংখ্যালঘুদের জীবনে অহেতুক দুর্ভোগ যাতে নেমে না আসে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারেরই। সরকার এ ব্যাপারে সচেতন আছে তো? আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সরকার এবং আওয়ামী লীগকে একসঙ্গে অনেক কিছুই করতে হবে। ভোটে জেতার জন্য যোগ্য প্রার্থী, ভালো প্রার্থী যেমন দরকার, তেমনি গ্রহণযোগ্য ভোটের জন্যও দরকার শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও সম্প্রীতির পরিবেশ।

লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

আওয়ামী লীগের এখন যে রকম আত্মবিশ্বাসী থাকার কথা, তা কি আছে? আওয়ামী লীগ কেন বিএনপির কর্মসূচির পেছনে হাঁটছে? বিএনপির কর্মসূচি বিএনপি করুক। যদি রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দলটি আবার অগ্নিসন্ত্রাস বা হিংসাত্মক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সেটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। দলগতভাবে পাল্টা ব্যবস্থা নিলে সেটা সামাল দেওয়া সহজ না-ও হতে পারে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।