৭ মার্চের ভাষণ

বজ্রকণ্ঠের ঘোষণায় বাঙালির মুক্তির সনদ

মোহাম্মদ হানিফ হোসেন
মোহাম্মদ হানিফ হোসেন মোহাম্মদ হানিফ হোসেন , রাজনীতিক
প্রকাশিত: ০৪:১০ পিএম, ০৬ মার্চ ২০২৩

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ নেতৃত্বের অনন্যতার প্রতীক ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। বাঙালির জন্য ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও অসাধারণত্ব ছিল বহুমাত্রিক। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিচার করলেও ভাষণটির শ্রেষ্ঠত্ব অগ্রগণ্য। ১৯ মিনিটের এই ভাষণে শব্দ ছিল ১০০৭টি। অলিখিত এই ভাষণটি ছিল বাঙালির ওপর পাকিস্তান ২৩ বছরের শোষণ ও বঞ্চনার দলিল। সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে কী কী করণীয় তার দিক-নির্দেশনা ছিল এই ভাষণে।

ছিল স্বাধিকার আন্দোলনকে জনযুদ্ধে রূপান্তরিত করার কৌশল ও তার রূপরেখা। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা হয়েও বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে জনগণের করণীয় তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। আমি যদি হুকুম দেবার না পারি... মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ’ এই তেজোদীপ্ত বাক্য কেবল একজন রাজনৈতিক নেতার নয়, একজন দেশস্রষ্টার কণ্ঠেই ধ্বনিত হওয়া সম্ভব।

সেদিন তাঁর অন্তর থেকে ছুঁয়ে আসা আত্মবিশ্বাসই বলে দিয়েছিল বাংলার মানুষ কি চায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন- বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই মূলত ‘ডি ফ্যাক্টো’ স্বাধীনতার ঘোষণা। এই ভাষণের পর থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। তাই পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছিল।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো এখনও শুনি ৭ মার্চের সেই ভাষণ। এ যেন মহাকাব্য। যে কাব্যের নির্ভয় উচ্চারণ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ একটি দেশকে মুক্ত ও স্বাধীন করতে এর চেয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ আর কী হতে পারে। কি ছিল সে ভাষণে? এই বজ্রকণ্ঠের প্রেরণার উৎসই বা ছিল কি? কেনই বা মন্ত্রমুগ্ধের মতো মানুষ এখনও শোনে সেই ভাষণ। ভাষণ শুনে ভাবি, বিস্ময়ে বিমোহিত হই, মুগ্ধ হই। রেসকোর্স ময়দানে স্মরণকালের ওই জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের জন্য জীবনপণ করেছিলেন।

আসলে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বাংলার মানুষকে এতো বেশি আর কেউ চিনতো না, ভালোবাসতো না। জনগণ সবসময় তাঁর প্রতি দিয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। এই দেওয়া-নেওয়ার সেতুবন্ধনে বঙ্গবন্ধুকে দুর্গমপথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ২৪ বৎসরের রাজনৈতিক জীবনে ১৩ বছরের বেশি জেলে ছিলেন। কয়েকবার ফাঁসির মুখোমুখি হয়েছেন।

একজন সাধারণ ঘরের সন্তান এবং একজন সামান্য রাজনৈতিক-কর্মী হিসেবে জীবন শুরু করে মাত্র দুই যুগেই সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে একাত্তরে তিনি হয়েছেন জাতির পিতা। বিদেশি এক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন ‘আপনার যোগ্যতা কি?’

জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি। ‘আর অযোগ্যতা কি?’ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, আমি আমার জনগণকে বেশী ভালোবাসি। ভালোবাসার দাবিকে প্রতিদান দিয়ে পূর্ণতা আনতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই কখনও বাঙালির দাবির প্রশ্নে কোনোদিন আপস করেননি। কি ভাষা আন্দোলনে, কি স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায়, কি গণতন্ত্রের জন্য।

আসলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বজ্রকণ্ঠের সাহস জুগিয়েছে জনগণ। জনগণ ভোট দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু যেভাবে চেয়েছিলেন। তিনি ভোট চেয়েছিলেন যেকোনো কিছুর বিনিময় ৬ দফা বাস্তবায়ন এবং এদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে। বঙ্গবন্ধুর কাছে ৭ মার্চ ছিল জনগণকে দেওয়ার দিন। ভালোবাসা এবং রক্তের ঋণ শোধের জন্য বঙ্গবন্ধু সেদিন হয়ে ওঠেন মরিয়া এবং কৌঁসুলি। বঙ্গবন্ধু প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বলেই আত্মপ্রত্যয় অনুভব করেছিলেন- ‘আমরা যখন রক্ত দিতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখবার পারবা না’।

সব ধরনের প্রস্তুতি যখন চূড়ান্ত তখনই তিনি শত্রুকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’

শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারকে সরাসরি বিকল করে দিয়ে বাংলার ক্ষমতা সেদিন নিজের হাতে নিয়েছিলেন, যা অর্জনের অধিকার জনগণ বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিল। বলা চলে মার্চ থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অনানুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু সেদিন সরকারি কর্মকর্তা, রেডিও-টেলিভিশন-পুলিশ বাহিনীকে তার নির্দেশ ছাড়া অন্য কারও (পাকিস্তান সরকারের) নির্দেশ পালন করতে নিষেধ করেন।

পাকিস্তান সরকারকে ট্যাক্স বন্ধ, বাংলাদেশ থেকে সম্পদ পাচার বন্ধ- এসব দুঃসাহসী ঘোষণা দিয়েছিলেন। জনগণ বঙ্গবন্ধুর সে নির্দেশ পালন করেছিল অক্ষরে অক্ষরে। রেডিও-টেলিভিশন প্রচার করতো বাংলার অবিসংবাদিত বজ্রকণ্ঠের প্রতিটি নির্দেশ। বঙ্গবন্ধু সেদিন শুধু স্বাধীনতার ঘোষণাই দেননি, দিয়েছিলেন বাঙালি জাতিসত্তার সার্বিক ‘মুক্তি’র আভাস। এর অর্থ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয় বরং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। বঙ্গবন্ধু অনুভব করেছিলেন স্বাধীনতা’র চাইতে ব্যাপকতর তাৎপর্যের শব্দ হচ্ছে মুক্তি। কারণ, তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অনুপ্রেরণার উৎস।

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি বিশ্বের সেরা ভাষণের একটি। জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো (UNESCO) বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্য বা গ্লোবাল হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা ভাষণটির অফিসিয়াল বিশ্ব স্বীকৃতি। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি এমন এক মহাকাব্য, যার স্বীকৃতির প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। তবু বিশ্ব সংস্থার এই স্বীকৃতির মাধ্যমে দুনিয়াব্যাপী গবেষণা হবে, বিশেষ করে জ্ঞানান্বেষী তরুণ সমাজের মনে এটি স্থান পাবে।

এই ভাষণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ আব্রাহাম লিংকনের Gettysburg Address মতোই বিশ্ব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক ভাষণ হিসেবে গৃহীত ও সমাদৃত এবং শ্রুত। আব্রাহাম লিংকনের সেই ভাষণের প্রেক্ষাপট আমেরিকা গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার। সেটি ছিল সাদা-কালোর যুদ্ধ। সে সময়ে লিংকন ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ তিনি ২ মিনিটের একটি লিখিত ভাষণ দেন। যার সারমর্ম ছিল Govt. of the people, by the people and for the people.

আর বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রুর উদ্দেশে চার্চিলের বক্তব্য ছিল- আমরা তোমাদের জলে-স্থলে এবং আকাশে হত্যা করবো।’ কালো মানুষদের অধিকার আদায়ে আপসহীন লড়াইয়ে মার্কিন মানবাধিকার কর্মী মাটিন লুথার কিংয়ের বিখ্যাত ভাষণ I have a Dream ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। আরেক মাকির্নি ‘জন এফ কেনেডির Ask not what your country can do for you. ভাষণ বদলে দিয়েছিল আমেরিকানদের ভাগ্য। এ ভাষণগুলোর মধ্যে যা আছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে তার চাইতে অনেক সুদূরপ্রসারী বক্তব্য রয়েছে। রয়েছে বাঙালির অতীত বঞ্চনার ইতিহাস এবং তার অনুপস্থিতিতে একটি বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৌশল, একটি জাতি স্বাধীনতা অর্জনের দিক-নির্দেশনা। বাঙালির মুক্তির সনদ।

লেখক : রাজনীতিক

এইচআর/এমএস

পাকিস্তান সরকারকে ট্যাক্স বন্ধ, বাংলাদেশ থেকে সম্পদ পাচার বন্ধ- এসব দুঃসাহসী ঘোষণা দিয়েছিলেন। জনগণ বঙ্গবন্ধুর সে নির্দেশ পালন করেছিল অক্ষরে অক্ষরে। রেডিও-টেলিভিশন প্রচার করতো বাংলার অবিসংবাদিত বজ্রকণ্ঠের প্রতিটি নির্দেশ। বঙ্গবন্ধু সেদিন শুধু স্বাধীনতার ঘোষণাই দেননি, দিয়েছিলেন বাঙালি জাতিসত্তার সার্বিক ‘মুক্তি’র আভাস।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।