দুর্গাপূজা

শুভশক্তি জাগানোর মগ্নতা

অনিল সেন
অনিল সেন অনিল সেন , কবি
প্রকাশিত: ০৯:৫৮ এএম, ২২ অক্টোবর ২০২৩

দুর্গা অর্থ দুর্গতিনাশিনী। দুর্গাপূজা মানে দুর্গতিনাশিনী শক্তির জাগরণ বা শুভ শক্তির জাগরণ। মানুষের ভেতরে দেবত্বকে জাগিয়ে তোলার সাধনা। বর্তমানে পূজা বলতে যা হয়; ঢাক ঢোল মন্ত্র পাঠ, তা নয়। এই পূজা হলো শুভশক্তিকে জাগিয়ে তোলার মগ্নতা। দুর্গাপূজা কেবলমাত্র উৎসবের নয়। উৎসবে উত্তেজনা থাকে। উচ্ছৃঙ্খলতা থাকে। সীমা লংঘন করার আশঙ্কা থাকে। সেটি সত্যিকারের পূজায় থাকে না।

বর্তমানে দুর্গাপূজা শারদীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। শরতের শারদীয় উৎসব। অথচ বলা হচ্ছে, তিনি মাতৃরূপে, পিতৃরূপে, শক্তিরূপে, শান্তিরূপে, বিদ্যারূপে আবির্ভূতা এক মহাশক্তি। উৎসব মনে করায় পূজাকে ঘিরে অনেক কিছুই হয় যা পূজার মধ্য পড়ে না। দেবীর প্রতি নিবেদিত প্রেমারতিও অনেক সময় এবং অনেক জায়গায় হয়ে উঠে অশ্লীল এবং তামসিক নৃত্যে। চন্ডিপাঠ এবং ভক্তিমূলক গান পরিবেশনের পরিবর্তে সাউন্ডবক্সে বাজানো হয় হিন্দি এবং বাংলা ছায়াছবির হালকা এবং চটুল গান। যা পরিবেশকে অস্থির করে।

প্রাচীন ভারতের ধর্ম-সংস্কৃতির দিকে নজর দেই তাহলে দেখব, দেবী পূজার মূল উৎস হচ্ছে সনাতন ধর্মের আদি শাস্ত্র বেদ। অভৃশ্য ঋষির কন্যা ব্রহ্মবাদিনী বাক সর্ব প্রথম তার অতীন্দ্র ধ্যাননেত্রে বা ধ্যানচোখে আবিষ্কার করেন দেবীসূক্ত। এই দেবীসূক্তই হচ্ছে মাতৃবন্দনার মঙ্গলসূত্র। কালনিয়ন্ত্রী মহাশক্তি শুধু পুরুষ দেবতারূপে পূজার পাত্র হননি, স্ত্রী দেবীর মাধ্যমেও মহাশক্তিকে আরাধনা করা হয়েছে যুগে যুগে। বেদে মূর্তিপূজার উল্লেখ নেই। কিন্তু দেবদেবীর কথা রয়েছে। এই দেবীপূজা পরবর্তী সময়ে দুর্গাপূজা নামে পূজিত হয়।

ভারতীয় মূর্তিপূজার সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের মূর্তিপূজার বেসিক পার্থক্য রয়েছে। সনাতন ধর্মের মূর্তিগুলোতে একেকটা ভাব বিদ্যমান এবং দর্শন রয়েছে। প্রাচীন কল্পতরু ঋষিরা চেতনার বিভিন্ন স্তরের অবগাহন করে মনোজগতে যা অনুভব করতেন তার একটা অনির্বচনীয় কাল্পনিক রূপ তৈরি করতেন। সেসব কাল্পনিক রূপ পরবর্তীতে মাটি বা পাথরের মূর্তির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। তেমনি দেবীশক্তি বাস্তব রূপ দেবী দুর্গা। যা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে মহাশক্তির প্রতীক। এই মহাশক্তির প্রতিমার মধ্য দিয়ে চিন্ময়ী ব্রহ্মশক্তিকে দর্শন করে। তাই এই পূজা প্রতিমাকে পূজা করা নয়, প্রতিমাতে পূজা করা।

বুঝতে সহজ হওয়ায় এই বিমূর্ত ভাবের মূর্তি সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাঙালি সনাতন ধর্মের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান এই পূজা। তবে এই মূর্তিটিকে যদি ঠিক ঠিক না বুঝতে পারা যা তাহলে এর মধ্যে যে বার্তা রয়েছে তা ধরা যাবে না। তাই এটি বোঝার জন্য পূজার দার্শনিক ব্যাখ্যা জানা দরকার। আগে বলেছি, দুর্গাপূজা মানে শুভ শক্তির জাগরণ। প্রত্যেকটা মানুষের ভেতরে শুভশক্তি বা দেবশক্তি সুপ্তাকারে থাকে। এই শক্তির জাগরণ ঘটলে মানুষ বিবেকবান হয়। ভালো মানুষ হয়। আর এই রকম মানুষ কারো অমঙ্গল করতে পারে না।

বর্তমানে দুর্গাপূজা শারদীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। শরতের শারদীয় উৎসব। অথচ বলা হচ্ছে, তিনি মাতৃরূপে, পিতৃরূপে, শক্তিরূপে, শান্তিরূপে, বিদ্যারূপে আবির্ভূতা এক মহাশক্তি। উৎসব মনে করায় পূজাকে ঘিরে অনেক কিছুই হয় যা পূজার মধ্য পড়ে না। দেবীর প্রতি নিবেদিত প্রেমারতিও অনেক সময় এবং অনেক জায়গায় হয়ে উঠে অশ্লীল এবং তামসিক নৃত্যে। চন্ডিপাঠ এবং ভক্তিমূলক গান পরিবেশনের পরিবর্তে সাউন্ডবক্সে বাজানো হয় হিন্দি এবং বাংলা ছায়াছবির হালকা এবং চটুল গান। যা পরিবেশকে অস্থির করে।

মানুষের ভেতরে শুভ এবং অশুভের দ্বন্দ্ব চিরকালীন। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় দ্য কনফ্লিক্ট বিটুইন গুড অ্যান্ড ইভিল। মানুষ হিসেবে কর্তব্য শুভশক্তিকে জাগিয়ে অশুভ বা অসুরশক্তিকে নাশ করা। মানুষের ভেতরে শুভ শক্তির বিজয় ঘটলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ তথা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত হবে। দেবী দুর্গার মাথার উপরে শিবঠাকুরকে দেখানো হয়েছে। শিব মানে কল্যাণ।

বর্তমানে একটি বাস্তব শব্দের নাম দুর্গা। এই পূজায় অনেক মূর্তির সমাহার রয়েছে। কারণ শুভশক্তির সংরক্ষণে সমন্বিত শক্তির প্রয়োজন। ভারতের মূর্তিপূজা নিছক মূর্তিপূজা নয়। তাই যুগাচার্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, পুতুল পূজা করে না হিন্দু/ কাঠ মাটি দিয়ে গড়া/ মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময় হেরে/ হয়ে যাই আত্মহারা। বুঝতে বাকি থাকে না, এ শুধু মাটির তৈরি মূর্তিপূজা নয়, এর মধ্যে চিন্ময়ী রূপ বিদ্যমান। চিন্ময়ী রূপ দেখতে পারেন কেবল ভক্তরা। তবে সেটি সাধারণ ভক্তের পক্ষে সম্ভব নয়। সীমাহীন ব্যাকুলতা এবং নিধিদ্ধাসনের মাধ্যমে তা সম্ভব। সেটা হোক পাথর বা মাটির গড়া মূর্তি।

বোধনের মধ্য দিয়ে যার শুরু। বোধন অর্থ জাগিয়ে তোলা। প্রাণশক্তি প্রতিষ্ঠিত করা। তবে শরতে যে দুর্গাপূজা হয় তা অকাল বোধন বা অসময়ের বোধন। শাস্ত্র মতে, পূজার উপযুক্ত সময় শরৎকাল নয়, বসন্তকাল। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অসময়েও শুভ শক্তির জাগরণের ভীষণ প্রয়োজন পরে। যেমনটা প্রয়োজন পড়েছিল রামচন্দ্রের। তিনিই প্রথম অসুরশক্তিকে বধ করতে অকালে অর্থাৎ শরতকালে দেবীদুর্গাকে মর্তে্য আহ্বান করেছিলেন। সে প্রয়োজনীয়তা এখন সব সনাতন ধর্মের মানুষের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে না বুঝে!

পাথর বা মাটির মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব কিনা?এমন প্রশ্নের হতেই পারে। সনাতন ধর্মের মানুষেরা মনে করেন সম্ভব। কারণ বেদ বলছে, ব্রহ্ম নিরাকার হলেও সর্বব্যাপী। সব বস্তুতে তিনি আছেন। ব্রহ্ম বা ঈশ্বর চাইলে সবই হয়- এমন বিশ্বাস তো হিন্দুরা ধারণ করে। মূর্তিগুলোকে যে উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয় সেগুলো কোনো না কোনো বস্তু। সনাতন ধর্মের মানুষের বিশ্বাস, সাধনার মাধ্যমে সবকিছুই সম্ভব। তা হোক আধ্যাত্মিক, মানসিক বা শারীরিক। এমন নজির শুধু ভারতবর্ষে বা সনাতন ধর্মের মানুষের মধ্যেই নয় পৃথিবীজুড়ে ভুরিভুরি প্রমাণ আছে। কালী সাধক রামপ্রসাদ সেন। নজরুল ইসলামকেও বাদ দেয়া যায় না! তা ছাড়াও অতি নিকটে সর্বধর্ম সমন্বয়ক রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব দেখিয়ে দিয়েছেন, পাথরের মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে জগদ্ধাত্রী মহাশক্তিকে কীভাবে নিজের মধ্যে দর্শন করা যায়। তার এই অতিমানবীয় দৃশ্য দেখে অবাক হয়েছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশব চন্দ্র সেন, রাজনারায়ণ বসু, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণসহ তখন নিরাকারবাদী ব্রহ্ম সমাজের প্রখ্যাত ব্যক্তিরা।

তাই বলা যায়, পাথর বা মাটির তৈরি মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব নয়। এ ছাড়াও বৈজ্ঞানিকভাবেও বিষয়টি ভাববার অবকাশ রাখে। বিজ্ঞান বলছে, সব পদার্থের মধ্যে শক্তি আছে। আন্তঃআণবিক শক্তির মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছোট-বড় সব ধরনের বস্তু গঠিত হয়। আলবার্ট আইনস্টাইনের বিজ্ঞানের এই তথ্য আবিষ্কারের কয়েক হাজার বছর আগে চন্ডিগ্রন্থে উচ্চারিত হয়েছে, ‘যা দেবী সর্বেভূতেষু শক্তি রূপেণ সংস্থিতা'। অর্থাৎ এই দেবীই সবকিছুতে শক্তিরূপে অবস্থান করছেন।

সনাতন ধর্মে প্রকৃতিকে ভালবেসে সবকিছু শালীনভাবে পালন করার নির্দেশনা থাকলেও দুর্গাপূজার মতো একটি অনুষ্ঠানে কেন উচ্ছৃঙ্খলতা হবে? কেন শাস্ত্র মোতাবেক বিশুদ্ধ বা সাত্ত্বিক ভাবে পূজা করা হয় না? রাজা সুরথ দুর্গাপূজা করার কথা বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে উল্লেখ করেন। গবেষণায় জানা যায়, ১৫৮৩ সালে রাজশাহীর তাহেরপুরে রাজা কংস নারায়ণ প্রথম দুর্গা পূজার প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে ১৬১০ সালে কলকাতার রাজা সাবর্ণ রায় চৌধুরী দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। প্রচলিত ধারায় এই দুর্গাপূজা সর্বজনীনতা পায়। সেই ধারা এখনো চলছে। তবে সেই সময়ে উৎসবের নামে উচ্ছৃঙ্খলতা হতো না। একদম শাস্ত্রীয় মতে সাড়ম্বরে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো।

দুর্গাপূজায় তিনটি পর্ব রয়েছে- মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা। চন্ডিতে দেখা যায়, মহালয়ায় পিতৃপক্ষ শেষ করে দেবীপক্ষের দিকে যাত্রা শুরু হয়। এদিন থেকে মণ্ডপে মণ্ডপে অধিষ্ঠান করেন দেবী। এই দিন চণ্ডী পাঠের মধ্য দিয়ে দেবীদুর্গাকে আবাহন জানানো হয় মর্তে্য বা পৃথিবীতে। কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় মহাশক্তির প্রতীক দেবী দুর্গা মায়ের মতোই আসেন। এ জন্যই তাকে বলা হয় মাতৃরূপেন সংস্থিতা। অর্থাৎ দুর্গা তখন মা হয়ে যান। শত্রুর বিনাশ করে সৃষ্টিতে কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করাই তার উদ্দেশ্য। তবে তিনি একাই লড়াইয়ে নামেন না । সঙ্গে থাকেন জ্ঞানের প্রতীক সরস্বতী, ঐশ্বর্যের প্রতীক লক্ষ্মী, সিদ্ধিদাতা গণেশ, পৌরুষের প্রতীক কার্তিকসহ অনেকে। এমনকি প্রকৃতিও (কলাবঊ)।

শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, দেবীর পূজার শ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে বসন্তকাল। চৈত্রমাসের শুক্লাষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত। এই সময়টাতে এখন পূজিত হয় দেবী বাসন্তী। অকাল বোধন হওয়াতে শরতকালের দুর্গাপূজাই এখন সনাতন ধর্মের মানুষের কাছে প্রধান হয়ে উঠেছে।
লেখক: সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।