যে ভোটে জোটের জট নেই

মোস্তফা হোসেইন
মোস্তফা হোসেইন মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশিত: ০৯:৩৫ এএম, ২৯ নভেম্বর ২০২৩

শক্ত প্রতিপক্ষকে নির্বাচনে পরাজিত করার কৌশল হিসেবে সমমনা দলের জোটবদ্ধ হওয়ার রেওয়াজ আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, শক্তিশালী প্রতিপক্ষ না থাকলে জোটের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জোট বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যে আবারও এই প্রশ্নটি জোরালো হয়েছে। তিনি বলেছেন,‘শরিক সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত আমাদের এখনও হয়নি। আমরা এখনও ঠিক করিনি শরিকদের আসলে আমাদের প্রয়োজন আছে কিনা।’

তাঁর এই বক্তব্যের প্রথম অংশ জোট বিষয়ে তাদের কম গরজের বিষয়টি ইঙ্গিত করে। সাধারণত অন্য সময় জোটগত সিদ্ধান্ত অনেক আগে থেকেই নেয়া হয়ে থাকে। এবারও জোটগত নির্বাচন হবে এমন ইঙ্গিত আগে থেকে পাওয়া যাচ্ছিলো। কারণ নির্বাচন বিষয়ে যখন জোরালো কথাবার্তা চলছিলো, তখন ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক জোটের সভা অনুষ্ঠান করেছেন। যা জোটের অস্তিত্বকে প্রমাণ করে।

অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোর যোগাযোগের বিষয়টিও উল্লেখ করা যায়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, তরীকত ফেডারেশন, জেপি, সাম্যবাদী দল ও গণতন্ত্রী পার্টি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে বলে ইসিকে জানিয়েছে। জোটের শরিক দলগুলোর ঘোষণা এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সাম্প্রতিক বক্তব্যকে এক সূত্রে গাঁথা যাচ্ছে না। যারা নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা নির্বাচন কমিশনের কাছে দিয়েছে, তারা কি মূল দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো কথাবার্তা না বলেই এই ঘোষণা দিয়েছেন?

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সাম্প্রতিক বক্তব্য অনুযায়ী জোটগত নির্বাচনের সম্ভাবনা যেমন ক্ষীণ তেমনি এটি আওয়ামী লীগের পূর্ব ঘোষণা থেকে সরে আসারও ইঙ্গিত দেয়। তারা ইতিপূর্বে জোটগত ভাবে নির্বাচন করবে না এমন কোনো ঘোষণা দেননি।

অন্যদিকে ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকও একাধিকবার করা হয়েছে। জোটের বৈঠক অনুষ্ঠানের পর স্বাভাবিক কারণেই মনে করা হচ্ছিলো-জোটগতভাবেই নির্বাচন হতে যাচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জোটের প্রয়োজনীয়তা কমে আসছে। সেক্ষেত্রে জোটভুক্ত দলগুলোকে হয়তো নতুন করে ভাবতে হতে পারে।

বিএনপি নির্বাচনে আসবে এমন কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার প্রয়োজনে বহুদলীয় অংশগ্রহণের প্রমাণ হিসেবে দলগুলোকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করতে পারে আওয়ামী লীগ। এতে করে নির্বাচন সম্পর্কে বহির্বিশ্বে যে ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে সেটা কিছুটা হলেও লাঘব করবে। যদিও আসন্ন নির্বাচনে ক্ষুদ্র কয়েকটি দল জোটগতভাবে নির্বাচনের কথা বলেছে ইতিপূর্বে। তবে সেগুলো অভিন্ন মার্কায় হবে না, সেটা প্রায় নিশ্চিত। কারণ তাদের জোট গঠন এবং নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। আর হলেও সেই জোটকে আওয়ামী লীগ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করার কারণ নেই। ফলে আসন্ন নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের ভূমিকা কি হবে তা অধিক অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এর মধ্যে ২৬ নভেম্বর আওয়ামী লীগ ২৯৮ আসনে তাদের দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। গত নির্বাচনে শরিক দলকে ছেড়ে দেওয়া বাঘা বাঘা আসনগুলোয় এবার আওয়ামী লীগ তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ায় জোটগত নির্বাচনের বিষয়টি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জোটগতভাবে নির্বাচন করলে হয়তো ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোর প্রার্থীদের বলা হতো মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য। কুষ্টিয়া ও নারায়ণগঞ্জের মোট দুটি আসন বাদ রেখে প্রার্থী মনোনয়নের পর জোটবদ্ধ নির্বাচনের সম্ভাবনাকে আরও কমিয়ে দিয়েছে।

এদিকে শরিক দলগুলোর মধ্যে আশা আকাঙ্ক্ষা ছিলো তারা নৌকায় নির্বাচন করবে। নৌকা মার্কায় নির্বাচন করলে তাদের বিজয় নিশ্চিত হতে পারে এই ধারণা এখনও তারা পোষণ করে। আবার দলগত অবস্থানের কারণে এককভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সক্ষমতা তাদের নেইও। সেই অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই তাদের দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে। বিএনপি নির্বাচনে না আসাটা তাদের জন্য দুঃসংবাদই বটে।

সমালোচকরা এক ধাপ এগিয়ে বলছে এবারের ভোট তো আর জোটের নয়। জোট দিয়ে আর কী হবে। সবশেষে প্রত্যাশা হচ্ছে- নির্বাচনী জোট না হোক ভোটার ও রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে আসুক, নির্বাচন অর্থবহ হোক।

অনেকে মনে করেন ২০১৮ পরবর্তী ৫ বছরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক ছোটগুলোর সামনে বড় একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিলো। তারা এই সময় নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করতে পারতো। কিন্তু তারা সেই সুযোগ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতা পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে এবারের নির্বাচনে। যদিও নির্বাচনের ক্ষেত্রটা ওরা ওইভাবে তৈরি করতে পারেনি। এইবার জোটের বাইরে নির্বাচন করার মাধ্যমে তারা নিজেদের দলকে সম্প্রসারিত করার একটা সুযোগ পাচ্ছে। তবে ৫ বছরের তুলনায় নির্বাচনে তাদের প্রাপ্তি কমই হবে।

এদিকে সদ্য নিবন্ধনপ্রাপ্ত তৃণমূল বিএনপিও ঘোষণা করেছে তারা জোটগতভাবে নির্বাচন করছে। প্রগিতিশীল ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থীরা তৃণমূল বিএনপির ব্যানারে নির্বাচন করবে বলে নির্বাচন কমিশনকে তারা জানিয়েছে। অর্থাৎ তৃণমূল বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক সোনালী আঁশ তাদের নির্বাচনী লড়াইয়ে প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হবে। যেহেতু প্রগতিশীল ইসলামী ঐক্যজোট নিজেই নিবন্ধিত দল নয় তাই তাদের তৃণমূলের প্রতীক ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে তারা তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবেই গণ্য হবেন। বাস্তবতা হচ্ছে-তৃণমূলের বাইরের প্রার্থীরাও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও এটি অফিসিয়েলি আর জোট হিসেবে চিহ্নিত হবে না।

যে কারণে এবারের নির্বাচনে জোটগত যে বৈশিষ্ট্য তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা থাকছে না। নব্বুইয়ের দশকে তিন জোট খ্যাত রাজনৈতিক প্লাটফরমগুলো যেভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে হৈচৈ ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো পরিবর্তিত পরিস্থিতে এই মুহূর্তে জোটের রাজনীতি সেই ভূমিকা পালন করতে পারছে না। আর সেই জন্য বিএনপির নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে যাওয়াকেই সবাই কারণ হিসেবে দেখছেন।

এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের একসময়ের ঘোষণা নৌকা মার্কায় তাদের জোটের ৭টি দল অংশগ্রহণ করবে বলে যে মন্তব্য করেছিলো সেটিও অকার্যকর হয়ে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।

সমালোচকরা এক ধাপ এগিয়ে বলছে এবারের ভোট তো আর জোটের নয়। জোট দিয়ে আর কী হবে। সবশেষে প্রত্যাশা হচ্ছে- নির্বাচনী জোট না হোক ভোটার ও রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে আসুক, নির্বাচন অর্থবহ হোক।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।