মেগাসিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

সান ফ্রান্সিস্কো মডেল এবং বাংলাদেশি উদাহরণ

মো. হাসিবুর রহমান
মো. হাসিবুর রহমান মো. হাসিবুর রহমান , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:১৫ এএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩

কল্পনা করুন, ঢাকা শহরের দুই কোটির বেশি মানুষ, সবাই একতলা বা সর্বোচ্চ দ্বিতল ভবনে থাকছেন। তাহলে বাড়তি কত লাখ ভবন দরকার হবে? সেসব ভবন বানাতে কত শত কিলোমিটার নতুন জায়গার দরকার হবে!

একই সঙ্গে ভাবা দরকার, বিপুল এ জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজ থেকে যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হচ্ছে, তার সর্বশেষ গন্তব্য কোথায়? বিপুল পরিমাণ বর্জ্য প্রতিদিন কোথায় যাচ্ছে? এখন থেকে ৫০ বছর পরে এ শহরের জনসংখ্যা কত হবে? এর ফলে কী পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হবে এবং সেগুলো যাবে কোথায়?

এসব হলো একটি মেগাসিটির সুবিধা এবং অসুবিধার দুটি উদাহরণ। ঢাকার মতো মেগাসিটিগুলোতে যেমন বিপুল জনগোষ্ঠীর আবাসন এবং জীবিকার ব্যবস্থা হয়েছে, তেমন সেখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ। মেগাসিটি যেমন জীবন সহজ করেছে, তেমন এর চ্যালেঞ্জগুলো মানুষের জীবন পুরোপুরি ধ্বংসই করে দিতে পারে।

২০২২ সালে জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে দেওয়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের তথ্য থেকে জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি থেকে প্রতিদিন গড়ে ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টন বর্জ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেগুলো ফেলা হচ্ছে ল্যান্ডফিলে (ময়লার ভাগাড়)। এর বাইরে আরও ১৫-২০ ভাগ, অর্থাৎ আরও প্রায় ১ হাজার টন বর্জ্য রাস্তাঘাটে পড়ে থাকছে। কিছু চলে যাচ্ছে ড্রেনে, বন্ধ হচ্ছে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা। কিছু অংশ চলে যাচ্ছে নদীতে, দূষণে মরে যাচ্ছে শহরের লাইফলাইন হয়ে থাকা নদীগুলো।

প্রশ্ন হলো, প্রতিদিন এভাবে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদন হতে থাকলে এই মেগাসিটি আর কতদিন এর ভার বইতে পারবে? দক্ষিণ সিটির দিকে আমরা তাকালে দেখতে পাই, মাতুয়াইলের ল্যান্ডফিল বিশাল আকারের এক পাহাড়ে রূপ নিয়েছে মাত্র কয়েক বছরে। আরও দশ বছর পর এ ল্যান্ড ফিল কি আর বর্জ্য নিতে পারবে? একই পরিস্থিতি উত্তর সিটিরও।

এ প্রশ্নের একটি জবাব বের করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। চীনা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে উত্তর সিটি চুক্তি করেছে বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। আমিনবাজারের ওই প্ল্যান্টে প্রতিদিন তিন হাজার টন (উত্তর সিটির প্রায় সব) বর্জ্য পোড়ানো হবে। ৩০ একর জায়গা জুড়ে হওয়া প্ল্যান্ট থেকে প্রতিদিন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ৪২ মেগাওয়াট।

এ পদ্ধতির নতুন সংকট হলো, বর্জ্য পোড়ানোর পরে কী পরিমাণ ধোঁয়া নির্গত হবে, ঢাকার উপকণ্ঠের প্ল্যান্ট নতুন করে কতটা বায়ুদূষণ করবে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বলা হয়েছে, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তিই যদি সমাধান হতো, তাহলে বিশ্বজুড়ে তেল-কয়লা পোড়ানোর পরিবর্তে রিনিউয়েবল এনার্জির কথা আসতো না। আবার প্ল্যান্ট থেকে যে পরিমাণ ছাই তৈরি হবে, সেগুলো কোথায় যাবে তারও বিশেষ কোনো সদুত্তর কোথায় দেখা যায়নি। এসব ছাই বাতাসে উড়ে কোথায় যাবে, সে গন্তব্যও অজানা। ফলে এটি হয়তো বর্জ্যের আকার কমাবে, কিন্তু প্রকৃত সমাধান মিলবে বলে মনে হয় না।

রিসাইকেলেই মুক্তি

বর্জ্যের এ সংকট সারা বিশ্বজুড়েই রয়েছে। দ্য ইকোনমিস্টের দেওয়া তথ্য বলছে, বর্তমানে এ বর্জ্যের প্রায় পুরোটাই পুড়িয়ে বা পুঁতে ফেলা হয় অথবা খোলা জায়গায় ফেলে রাখা হয়। এগুলো পচে উৎপাদন হয় গ্রিন হাউজ গ্যাস। চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবেশ। সেখান থেকে নির্গত হওয়া কেমিক্যাল চলে যায় নদীতে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে তা দ্বিগুণ হবে। ফলে স্বাভাবিকভাবে এ সমস্যাও বাড়বে কমপক্ষে দ্বিগুণ।

তবে পুরো সমস্যার একটি একটি পুরোপুরি সমাধান বের করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিস্কো। তারা দৈনিক পাওয়া প্রায় ৩০০ ট্রাক বর্জ্যের পুরোটাই রিসাইকেল করে। স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে, রিসাইকেল কোনো নতুন ধারণা নয়। কিন্তু একটি মেগাসিটি প্রতিদিন যে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য তৈরি করে, সেখানে যত ধরনের উপাদান থাকে, তা ম্যানেজ করা নিঃসন্দেহে বিরাট চ্যালেঞ্জের। এখানেই সফলতা দেখিয়েছে সান ফ্রান্সিস্কো।

তারা তাদের সেই বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্টের নাম দিয়েছে রিকোলোজি। রিকোলোজির পাবলিক রিলেশন ম্যানেজার রবার্ট রিড ইকোনমিস্টকে জানান, তারা প্রতিদিন ১২ ধরনের ৫৫০ টন বর্জ্য আলাদা করেন। এ কাজটির জন্য পুরোপুরি অটোমেটেড সিস্টেমের উপর নির্ভর করা হয়। বিশাল আকারের প্ল্যান্টে কনভেয়ার বেল্ট, ম্যাগনেট এবং রোবটিকসের ব্যবহারের মাধ্যমে খুব সহজেই করা হয় এ কাজ। হাল আমলে এআই কাজটি আরও সহজ এবং মানসম্পন্ন করেছে।

আমরা যদি পুরো বর্জ্যকেই প্রক্রিয়াজাত করে পুনরায় ব্যবহারে ফিরিয়ে আনতে পারি, সেটি নিঃসন্দেহে লসের কিছু হবে না। এখন বর্জ্য সামাল দিতে যে পরিমাণ খরচ হয়, সেটি হয়তো কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু এর বদলে প্রাণ-প্রকৃতি বেঁচে যাবে শতাব্দির জন্য। বিশাল বিশাল রিসাইকেল প্ল্যান্ট করতে অবশ্যই বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে।

তিনি বলেন, কোনো কিছুই বর্জ্য নয়। সবই রিসাইক্লিং ম্যাটেরিয়াল যেগুলো ফিরে যায় কারখানায়, নতুন পণ্য তৈরির জন্য। একই সঙ্গে পচনশীল অংশ থেকে তৈরি করা হয় জৈব সার। বিশেষ ধরনের বায়োলজিক্যাল এজেন্ট ব্যবহার করে এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা হয়।

এবার এটি মেলানো যাক বাংলাদেশের সঙ্গে।

প্রতিদিন কেবল ঢাকা শহরে যে সাত হাজার টন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে, এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো প্লাস্টিক এবং পলিথিন জাতীয়। এগুলোই পরিবেশের মূল ‘কিলার’। বিপুল পরিমাণ পলিথিন এবং প্লাস্টিক যদি আমরা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া থেকে রক্ষা করতে পারি তাহলে সেটি কত বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

একটি বাংলাদেশি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক।

প্লাস্টিক রিসাইকেল কারখানার কথা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। সেসব কারখানা নতুন করে দূষণ ছড়ায়, সে খবরও আসে। কিন্তু একটি কারখানা পরিবেশবান্ধব উপায়ে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক যে রিসাইকেল করতে পারে তা করে দেখিয়েছে আরএফএল গ্রুপের টেল প্লাস্টিকস। একটি ব্র্যান্ড পুরোপুরি রিসাইকেল প্লাস্টিকের উপর ভর করে দাঁড়াতে পারে, তাও করে দেখিয়েছে টেল।

প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্টরা জানান, তাদের কারখানায় বছরে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টন প্লাস্টিক রিসাইকেল করার সক্ষমতা রয়েছে। এবং রিসাইকেল প্লাস্টিকের উপর ভর করেই সাফল্যের সঙ্গে ব্র্যান্ডটির ব্যবসা চলছে। নিশ্চয়ই এর পেছনে একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ রয়েছে। সারাদেশ থেকে ব্যবহৃত বা নষ্ট হয়ে যাওয়া প্লাস্টিক সংগ্রহ, প্ল্যান্টে নিয়ে আসা এবং প্রক্রিয়া করা নিঃসন্দেহে বিরাট কর্মযজ্ঞ। কিন্তু এটি যে লসজনক নয়, সেটি প্রমাণিত।

একইভাবে আমরা যদি পুরো বর্জ্যকেই প্রক্রিয়াজাত করে পুনরায় ব্যবহারে ফিরিয়ে আনতে পারি, সেটি নিঃসন্দেহে লসের কিছু হবে না। এখন বর্জ্য সামাল দিতে যে পরিমাণ খরচ হয়, সেটি হয়তো কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু এর বদলে প্রাণ-প্রকৃতি বেঁচে যাবে শতাব্দির জন্য। বিশাল বিশাল রিসাইকেল প্ল্যান্ট করতে অবশ্যই বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। তেমন বিনিয়োগের সামর্থ্য যে বাংলাদেশের আছে, সেটি এরই মধ্যে প্রমাণিত। প্রয়োজন কেবল আমাদের সিদ্ধান্ত আর সদিচ্ছা।

লেখক: সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।