রোহিঙ্গা সমস্যা: চীনা ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসুক বাংলাদেশ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৯:৫৮ এএম, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সামরিক জান্তা শাসিত মিয়ানমার থেকে খবর আসে কম। যা পাওয়া যায় তার সত্যতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন থাকে। তবে সাম্প্রতিককালে জান্তার বাহিনীর সাথে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সংঘাত তথা যুদ্ধের খবর বড় আকারেই আসছে। বাংলাদেশের অনেক সংবাদ মাধ্যম শিরোনাম করছে যে, রাখাইন রাজ্যে আরাকার আর্মির বিজয়, পালাচ্ছে জান্তা।

বেশ দ্রুতই বদলে যাচ্ছে মিয়ানমারের পরিস্থিতি। একের পর এক এলাকার দখল হারাচ্ছে সামরিক বাহিনী। বিজয় ঘোষণা করছে বিদ্রোহী গ্রুপগুলো। এই গ্রুপগুলোর অন্যতম শক্তিশালী হল আরাকান আর্মি। আরাকান আর্মি রাখাইন অঞ্চলের স্বাধিকারের জন্য লড়ছে। তবে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে বান্দরবানসংলগ্ন মিয়ানমারের চিনসহ আরও কিছু প্রদেশে। রাখাইনের পরিস্থিতি খুব নাজুক চেহারা পেয়েছে বলে বাংলাদেশে অবস্থানরত ক্যাম্পবাসী রোহিঙ্গারা জানাচ্ছেন। সেখানে লড়াইয়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের বসতিতে নিয়মিত অগ্নিসংযোগও করা হচ্ছে বলে খবর আসছে।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরের এই পরিস্থিতি নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে বাংলাদেশের জন্য। সীমান্ত এলাকায় নিয়মিতভাবে সেখানে এসে পড়ছে মর্টার শেল ও গুলি। বাংলাদেশ তাই সীমান্তে স্থলপথ ও নৌপথে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। কারণ রাখাইনে সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে লড়াইয়ের প্রভাব পড়ছে সীমান্তের এপারের জনগোষ্ঠীর মধ্যে। সাত দশক ধরে মিয়ানমারের ভিতরে সংঘাত চললেও এবারের সংঘাত থামাতে বেগ পেতে হচ্ছে জান্তা সরকারকে।

মিয়ানমারের অব্যন্তরীণ এই যুদ্ধ কি আবারও রোহিঙ্গা ঢল নামাবে বাংলাদেশের দিকে? এই প্রশ্নটিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজে ও জনপরিসরে। রাখাইনে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষে নিহত হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। দু’পক্ষের গোলাগুলি ও গোলাবর্ষণে রোহিঙ্গাদের বসতিও পুড়ছে। এতে করে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় ছন্দপতন ঘটার পাশাপাশি নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছে শরণার্থী কমিশনার কার্যালয়সহ নানা মহল।

২০১৭ সালে সামরিক জান্তা অত্যাচার করে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তবে এখনও সেখানে পাঁচ বা ছয় লাখের মতো রোহিঙ্গা রয়ে গেছে। এখনকার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করছেন বলে আশংকা করছে সব মহল। ২০১৭ সালের মতো ঢল না নামলেও নতুন করে রোহিঙ্গা আসতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে বলা হচ্ছে উদ্ভূত পরস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের আগমন ঠেকাতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

কতটা পারবে বিজিবি আমরা জানিনা। তবে এরকম একটা সতর্কতা দরকার ছিল ২০১৭ সালে। কীসের আশায় তখন সীমান্ত বন্যার পানির মতো খুলে দেয়া হয়েছিল সেটা সরকারই কেবল জানে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট হাজার হাজার রোহিঙ্গা হঠাৎ করে বাংলাদেশের দিকে আসতে থাকে এবং সেটি শেষ পর্যন্ত লাখ লাখে পরিণত হয়। নারী, পুরুষ এবং শিশুরা সঙ্গে করে নিয়ে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচারের কাহিনি। কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের ৩৪ টি ক্যাম্পে ১১ লাখ ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় যেটি গত ৭ বছরে বেড়েছে আরো প্রায় ২ লাখের মতো।

নতুন করে শুরু হওয়া যুদ্ধটি কোন দিকে যাচ্ছে তার ওপর নির্ভর করবে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি কি হবে। তবে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও কঠিন হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে। মাঝে চীনের সহযোগিতায় একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব হয়েছিলো, কিন্তু সেটি খুব একটা কাজে আসেনি। সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে এক বৈঠক শেষে চীনা রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের এটি বলার চেষ্টা করেছেন যে যদি রাখাইনে অস্ত্র বিরতি হয় তাহলে হয়তো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথটি সুগম হবে। কিন্তু চীন আসলে কতোটা আন্তরিকভাবে সমস্যার সমাধান চায় এবং চীনের সমর্থন যেহেতু মিয়ানমারের দিকে তাই চীনের চাওয়া নিয়ে একরকম সন্দেহ থাকছেই।

টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অপরাধীদের আখড়া হয়ে ইঠেছে। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে খুন-খারাপি একদম নিয়মিত ঘটনা। সেখানে কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অত্যন্ত বেগ পেতে হচ্ছে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া যতো দেরি হচ্ছে, অপরাধ ততো বাড়ছে। এসব নিয়ে কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছে। মানবিকতা দেখিয়ে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিলো রোহিঙ্গাদের এখন তারাই মানুষের গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় নতুন করে যদি আবারও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসা শুরু করে তাহলে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হবে।

রোহিঙ্গারা যেকোনো সময় বাংলাদেশের জন্য যেকোনো রকমের সমস্যা তৈরি করতে পারে। শুধু চীনরে মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে বলে মনে হচ্ছে না। চীন এ সমস্যাকে দেখতে চায় মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সমস্যা হিসেবে। অথচ এটি পরিষ্কারভাবে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এই চীনা ফাঁদ থেকে বাংলাদেশ বের হতে না পারলে প্রত্যাবাসন কোনোদিন হবে না। চীন মিয়ানমারের জান্তার সবচেয়ে বড় সমর্থক। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে কোনো অবস্থান নেয়নি। রোহিঙ্গাদের রাখতে বাংলাদেশকে কোনো অর্থনৈতিক সহযোগিতাও সেভাবে করেনি যেটা আমেরিকা বা ইউরোপীয় দেশগুলো করছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থান নিবে যে আর কাউকে ঢুকতে দেয়া হবে না। এবং একই সাথে ভাববে যে, চীনের তৈরি প্রত্যাবাসন কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসবে, এটাই এখন বড় প্রত্যাশা ।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।