শুভ ভ্যালেন্টাইনস ডে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
![শুভ ভ্যালেন্টাইনস ডে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2023March/sapnil-cover-20240215114741.jpg)
আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসা যে বিপুল উৎসাহে প্রবাহমান, তার উদযাপন দেখতে আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কিংবা রবীন্দ্র সরোবরের আশপাশটায় একটু ইতিউতি উঁকিঝুঁকি মারাটাই যথেষ্ট। উঁকিঝুঁকি বলছি এই কারণে যে ভালোবাসার পূজারীদের বিপুল উপস্থিতিতে এদিন অন্য কারো পক্ষে এসব জায়গায় যাওয়াতো দূরে থাক, এসব জায়গার আশপাশেও ঘেষা সম্ভব হয় না।
এ পর্যায়ে যদি প্রশ্ন কারা হয় মানুষের মূল প্রবৃত্তিটা কি, প্রত্যাশিতভাবেই উত্তরটা হবে মানুষ সহজতভাবেই ভালো। সে ভালো হয়েই জন্মায়, ভালোই থাকতে চায়, কিন্তু একটা সময় পারিপার্শ্বিকের চাপে তাকে হয়তো খারাপ হতে হয়। আমার ধারনটা অবশ্য একেবারেই এর উল্টো।
আমি বিশ্বাস করি মানুষ প্রবৃত্তিগতভাবেই বন্য। তাকে নানাভাবে ভালো রাখার আর সঠিকের পক্ষে থাকার শিক্ষা দেওয়া হয়, কিন্তু সেই শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আমার এই উক্তির পক্ষে আমার যুক্তিও আছে যথেষ্টই। পৃথিবীতে যত ধর্ম গ্রন্থ আছে আর আছে যত শিক্ষা পদ্ধতি, সবগুলোতেই, সব সময়ই মানুষকে ভালো হবার শিক্ষা দেওয়া হয়, শেখানো হয় ভালোবাসতে। অথচ বাস্তবতা এই যে অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ উল্টো পথে হাঁটে যার উদাহরণ ইতিহাসে যেমন আছে, আছে তেমনি ঘটমান বর্তমানেও। আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার হলোকাস্ট কিংবা একাত্তরে বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যার প্রসঙ্গটা টেনে আনতে পারি।
অনেকেই হয়তো বলবেন শিক্ষিত জার্মান জাতি উগ্র জাতীয়তাবাদের ঘোরে হলোকাস্টে জড়িয়েছিল আর বর্বর পাকিস্তানীদের কথা বলার আর কি-ই বা আছে? তাহলে আজকের গাজা? শিক্ষায়-দীক্ষায় দুনিয়ায় অগ্রগণ্য বলে একবাক্যে স্বীকৃত যে ইহুদীরা মার্কিনমুলুকে বসে রাজনীতি আর অর্থনীতির কলকাঠি নেড়ে চলেছে পেছনে বসে এতটা অবলীলায়, যাদের ভেতর থেকে নোবেল বিজয়ীর সংখ্যা গুণে শেষ করা ভার, সেই শিক্ষিতের দেশ ইসরাইলের সেনাবাহিনী কিভাবে এহেন নির্মন বর্বরতায় খালি করে চলেছে হাজারো প্যালেস্টাইনি মায়ের বুক। এমনকি শিক্ষিত ইসরাইলীরাও পাশ্চাত্যের মিডিয়ার সামনে কি অবলিলায়ই না তাদের সেনাবাহিনীর শিশু গণহত্যার পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২২ হাজার মানুষ মুত্যুবরণ করছেন লিভার সিরোসিস আর লিভার ক্যান্সারে ভুগে। অথচ এদের একটা বড় অংশকেই এমনি করুণ পরিণতির বরণ করতে হতো না যদি এদেশে নিয়মিতভাবে, সুলভে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের সুবিধাটা থাকতো।
তবে ভালোবাসা দিবসের মানুষের কদাকার দিক নিয়ে লেখালেখিটা আমার একেবারেই উদ্দেশ্য নয়। বরং এর বিপরীত বাস্তবতাটা নিয়ে লেখাটাই লক্ষ্য। পৃথিবীতে এই স্রোতের বিপরীতে এমন কিছু ভালো মানুষ আছেন যাদের ভালোবাসায় পৃথিবীটা এখনও বাসযোগ্য রয়ে গেছে। তেমনি একজন মানুষের সম্পর্কে কটি কথা লিখতেই কলমটা ধরা। এই মানুষগুলো এমনই যে এরা লাভ-ক্ষতি, অতশত হিসেব না কষেই অবলীলায় দশ লক্ষ বাস্তুচ্যুত নির্যাতিত রোহিঙ্গাকে তার বিশাল আচলের নিচে আশ্রয় দিতে পারেন।
কদিন আগে সংক্ষিপ্ত সফরে আমার চেন্নাই যাওয়া পড়েছিল। উদ্দেশ্য একটা এমওইউ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট পরিচালিত শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে স্পেশালাইজড হাসপাতালের সাথে এমওইউটি স্বাক্ষরিত হলো ভারতবর্ষের বিখ্যাত ডা. রেলা ইনস্টিটিউট এন্ড মেডিকেল সেন্টারের। এর লক্ষ্য দেশে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে স্পেশালাইজড হাসপাতালে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, নিয়মিত লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রোগ্রাম চালু করা যেখানে দেশের চিকিৎসকরা দেশে বসে দেশের লিভার রোগীদের লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন করবেন নিয়মিতভাবে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২২ হাজার মানুষ মুত্যুবরণ করছেন লিভার সিরোসিস আর লিভার ক্যান্সারে ভুগে। অথচ এদের একটা বড় অংশকেই এমনি করুণ পরিণতির বরণ করতে হতো না যদি এদেশে নিয়মিতভাবে, সুলভে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের সুবিধাটা থাকতো। তাছাড়া যে দেশের মহাশূন্যে উড়ে নিজেদের স্যাটেলাইট আর সাগরতলে ডুব দিয়ে বেড়ায় নিজস্ব সাবমেরিন, যে দেশ আজ স্বল্পোন্নতের তালিকায় নামটা কাটিয়ে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গ্র্যাজুয়েশন নিশ্চিত করে এখন পৃথিবীর তাবৎ উন্নয়নপ্রত্যাশী দেশের জন্য উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত, তার যদি নিজস্ব লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন প্রোগ্রাম না থাকে, তাহলেতো এ সব কিছু কেমন যেন অপূর্ণ রয়ে যায়। লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনকে বলা হয় মাদার অব সার্জারিজ। সাথে এটি মাদারস অব টিম ওয়ার্কও বটে। একটি দেশ স্বাস্থ্যখাত যে টাশিয়ারী স্বাস্থ্যসেবায় একটি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে তার একটি বড় প্রমাণ সেই দেশের লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের সক্ষমতা।
বাংলাদেশের মানুষগুলোর কথা ভেবে এবার সেই জায়গাটায় হাত দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে স্পেশালাইজড হাসপাতাল আরো দু একটি হাসপাতালসহ দেশের আরো দু একটি হাসপাতালে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন চালু করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতিহাস বলে তিনি যখনই কোনো কাজে হাত দিয়েছেন সেখানে সোনা ছাড়া অন্য কিছু ফলেনি, সাফল্য বৈ অন্য কোনো কিছু আসে নি। চেন্নাইয়ের ঐ এমওইউ সাইনিং সেরিমনিতে ভারতের উচ্চপদস্থ আমলা আর মিডিয়ার মুখে তার প্রশংসা আর তার প্রতি আস্থায় গর্বে আমার বুকটা ফুলে ফেপে বিশ হাত হয়েছে।
যে কোনো বিবেচনাতেই আমি নিশ্চিত যে চব্বিশে না হোক পঁচিশ থেকে বাংলাদেশের ধুকতে থাকা লিভার রোগীদের নতুন একখানা লিভার জুড়ে নিতে আর ভারতে না ছুটলেও চলবে। প্রতি বছর মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকা এই বাইশ হাজার মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় ভালোবাসার উপহার আর কি-ই বা হতে পারে? এদেশের প্রত্যেক লিভার রোগী আর তাদের সেবায় নিয়োজিত দেশের প্রত্যেক লিভার বিশেষজ্ঞর পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিনম্র শ্রদ্ধায় আজকের এই দিনে জানাই শুভ ভ্যালেন্টাইনস ডে।
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/এএসএম