৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি কালজয়ী আলোকবর্তিকা

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
ড. প্রণব কুমার পান্ডে ড. প্রণব কুমার পান্ডে
প্রকাশিত: ০৯:৩০ এএম, ০৭ মার্চ ২০২৪

প্রতি বছর ক্যালেন্ডারে যখন ৭ মার্চ আসে বাংলাদেশ ও এর জনগণ নিজেদের ইতিহাস এবং সমসাময়িক চ্যালেঞ্জের সংযোগস্থলে খুঁজে পায়, যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর উত্তরাধিকারকে প্রতিধ্বনিত করে। এই উল্লেখযোগ্য তারিখটি ক্যালেন্ডারে কেবল একটি দিন নয়; এটি একটি পুনরুজ্জীবনের আহ্বান এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের একটি মর্মস্পর্শী অনুস্মারক, যা জাতিকে স্বাধীনতার দিকে চালিত করেছিল।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এই ঐতিহাসিক দিনে বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনগণকে নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে একটি বিদ্যুতায়িত ভাষণ দেন। এই ভাষণে, (যা ‘৭ মার্চের ভাষণ' হিসেবে পরিচিত), একটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা এবং উচ্ছ্বাস অন্তর্ভুক্ত ছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বক্তব্যের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের সারমর্ম তুলে ধরেছিলেন। এই শক্তিশালী শব্দের মাধ্যমে তিনি পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করে দ্ব্যর্থহীনভাবে জোর দিয়ে বলেছিলেন যে এবারের লড়াই নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের সাথে স্বায়ত্তশাসনের লড়াই নয়, বরং সম্পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য একটি প্রাণবন্ত লড়াই।

যেহেতু বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ প্রতি বছর এই ঐতিহাসিক দিনটি স্মরণ করে, সেহেতু ৭ মার্চের মূল বক্তব্য হৃদয়ে ধারণ করে দেশের অগ্রগতি এবং সামনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। ৭ মার্চের দর্শনের পুনরুজ্জীবনের আহ্বান সময়ের করিডোরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সব সময়। ফলে, বাঙালি জাতিকে তার জন্মের দিকনির্দেশনা দেওয়া নীতিগুলোর প্রতি অনুরক্ত থাকতে হবে এবং বঙ্গবন্ধু'র কালজয়ী দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের দিকে যাত্রা চালিয়ে যেতে হবে।

বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই ঘোষণাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে, যা জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং স্বাধীনতার নিরলস অনুসরণের মঞ্চ তৈরি করেছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ জনগণের মধ্যে গভীরভাবে অনুরণিত হয়েছিল, যা তাদের মধ্যে অবিচারের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য একটি নতুন উদ্দেশ্য এবং দৃঢ় সংকল্পের অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল। সেই ঘোষণাটি কেবল অতীত থেকে সাহসী প্রস্থানের প্রতীকই নয়, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মের ভিত্তিও স্থাপন করেছিল।

রেসকোর্স ময়দানের ভৌত সীমার বাইরেও স্বাধীনতার চেতনায় প্রতিধ্বনিত হয় বঙ্গবন্ধুর বাণী। সেই বক্তৃতা জনগণকে উত্তেজিত করে এবং নিপীড়ক পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সেই ভাষণ সমবেত চিৎকার হয়ে উঠেছিল, যা আঞ্চলিক ও সাংস্কৃতিক সীমানা অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানের বৈচিত্র্যময় জনগণকে একটি সাধারণ কারণে স্বাধীনতার সন্ধানে একত্রিত করেছিল।

সেই প্রতীকী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির নিষ্পেষণের ইতিহাস এবং স্বায়ত্তশাসনের জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষাকে আন্তরিকভাবে তুলে ধরেছিলেন। তিনি ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় পার্থক্য অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতির আহ্বান জানান। সমসাময়িক বক্তৃতার একটি মাস্টারপিস হিসেবে বিবেচিত সেই ভাষণটিতে বঙ্গবন্ধু আত্মনিয়ন্ত্রণের অনস্বীকার্য প্রয়োজনের ওপর জোর দিয়েছিলেন, যা পরবর্তী সংগ্রামের ভিত্তি স্থাপন করেছিল এবং স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশের জন্মের সাথে সাথে শেষ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মূল থিম ছিল স্বাধীনতা, ন্যায়বিচারের মৌলিক অধিকার এবং এমন একটি জাতি প্রতিষ্ঠা করা যেখানে প্রতিটি নাগরিক মর্যাদা ও সমতার সাথে বাঁচতে পারে।

ফলে, ৭ মার্চ শুধু স্মরণ করার দিন নয়, এটি জাতির গতিপথ গঠনে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী আদর্শের স্থায়ী প্রাসঙ্গিকতা প্রতিফলিত করার দিন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি স্বাধীনতা সংগ্রামের বাইরেও বিস্তৃত ছিল বিধায় তিনি একটি ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তাঁর ভাষণে।

সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্যের ওপর জোর দেওয়া ছিল বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম ভিত্তি। তিনি এমন একটি বাংলাদেশের কল্পনা করেছিলেন যেখানে জাতি, ধর্ম বা অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের সমৃদ্ধির সমান সুযোগ থাকবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি সেই নীতিগুলোর ভিত্তি স্থাপন করেছিল যার লক্ষ্য ছিল আর্থ-সামাজিক বৈষম্য হ্রাস করা, সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং বৈচিত্র্য উদযাপন করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকারের মধ্যে ৭ মার্চের বক্তৃতার চেতনা বেঁচে আছে। জাতির ভাগ্য নির্ধারণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়ে জনগণের ক্ষমতায়ন ঘটাবে এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ছিল বঙ্গবন্ধু'র দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্ত। বছরের পর বছর ধরে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুসংহত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।

অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ছিল বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি স্তম্ভ। তিনি নির্ভরতার বন্ধন থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার এবং অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের পথ নির্ধারণের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার পর নবগঠিত দেশটি বিপুল অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, কিন্তু বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক নীতির ভিত্তি স্থাপন করেন, যা স্বনির্ভরতা ও টেকসই উন্নয়নের প্রসার ঘটায়।

আমরা যখন ৭ মার্চ পালন করছি, তখন বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কতদূর এগিয়েছে সেটি যেমন মূল্যায়ন করা আবশ্যক, ঠিক তেমনি যে ক্ষেত্রগুলোতে অব্যাহত প্রচেষ্টার প্রয়োজন তা চিহ্নিত করা আবশ্যক। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে শিক্ষা, অর্থনীতি, অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে, দারিদ্র্য, দুর্নীতি এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বের মতো চ্যালেঞ্জগুলো অব্যাহত রয়েছে, যা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সমর্থিত আদর্শের প্রতি নতুন প্রতিশ্রুতি দাবি করে।

১৯৭১ সাল থেকে বৈশ্বিক ভূদৃশ্য বিবর্তিত হয়েছে বিধায় বাংলাদেশকে একবিংশ শতাব্দীর জটিলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। ফলে, অন্য বছরের মতো এবারেও ৭ মার্চ একটি অনুস্মারক হিসেবে কাজ করবে, যা দ্রুত পরিবর্তিত বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য জাতিকে সহায়তা করবে। প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত এবং বিশ্বব্যাপী সংযুক্ত বাংলাদেশের বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি খুবই প্রাসঙ্গিক বিধায় তিনি সব সময় নতুন নতুন উদ্ভাবনকে আলিঙ্গন করতে এবং যুবকদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়ে আসছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ওঠানামার মতো প্রতিকূলতা কাটিয়ে বাংলাদেশ সহনশীলতার আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ৭ মার্চ শুধু স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতীক নয়, দেশের ডিএনএ-তে সহনশীল মনোভাবেরও প্রতীক। এই সহনশীলতা বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি অটল প্রতিশ্রুতির এমন একটি প্রমাণ, যা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে বাংলাদেশের যাত্রাকে রূপদান করে চলেছে।

পরিশেষে বলা যায়, ৭ মার্চ কেবল ক্যালেন্ডারের একটি তারিখ নয়, এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির একটি জীবন্ত প্রমাণ। যেহেতু বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ প্রতি বছর এই ঐতিহাসিক দিনটিকে স্মরণ করে, সেহেতু ৭ মার্চের মূল বক্তব্য হৃদয়ে ধারণ করে দেশের অগ্রগতি এবং সামনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। ৭ মার্চের দর্শনের পুনরুজ্জীবনের আহ্বান সময়ের করিডোরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সব সময়। ফলে, বাঙালি জাতিকে তার জন্মের দিকনির্দেশনা দেওয়া নীতিগুলোর প্রতি অনুরক্ত থাকতে হবে এবং বঙ্গবন্ধু'র কালজয়ী দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের দিকে যাত্রা চালিয়ে যেতে হবে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।