কেন শিক্ষার্থীদের আস্থা হারাচ্ছে ছাত্র রাজনীতি?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৯:২৬ এএম, ০৬ এপ্রিল ২০২৪

বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি হবে কি হবে না- এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। শিক্ষার্থীদের চরম বিরোধিতার মুখে আদালতের রায় নিয়ে ছাত্রলীগ এখন সেখানে রাজনীতি আবার শুরু করার প্রচেষ্টা নিয়েছে। বুয়েট একটি স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে শেরে বাংলা হলের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ খুন হওয়ার পর সেখানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এ সিদ্ধান্তের পর গত সাড়ে চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কোনো অঘটন ঘটেনি। বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও বুয়েটসহ দেশের সব ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও সহাবস্থান দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

কিন্তু বুয়েটের শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই ছাত্র রাজনীতি চাচ্ছে না। বুয়েটের ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে দাবি করেছেন ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। তাদের ভাষ্য, তারা নিজ নিজ প্রাতিষ্ঠানিক ইমেইল ব্যবহার করে ছাত্র রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে অনলাইনে ভোটগ্রহণ করেন। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়টির সব ব্যাচের ৫ হাজার ৮৩৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫ হাজার ৬৮৩ জনই ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে স্বাক্ষর দিয়েছেন।

এই জরিপের গুণাগুণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে এটা বুঝতে অসুবিধা নেই যে, বুয়েটের অধিকাংশ শিক্ষার্থী ছাত্র রাজনীতি চায় না। শুধু বুয়েট নয়, জরিপ করলে এরকম ছাত্র রাজনীতিবিরোধী অভিমত আসবে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজপড়ুয়াদের দিক থেকে।

এখন ঢালাওভাবে ছাত্র রাজনীতিবিরোধী শিক্ষার্থীদের হিযবুত তাহরীর বা শিবির ট্যাগ লাগানো হচ্ছে। কিন্তু ছাত্রলীগ কিংবা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব উপলব্ধি করতে চাচ্ছে না যে কেন ছাত্রলীগ দেখলে সবাই ভয় পাচ্ছে। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বুয়েটে ৫ হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলন করছে। তারা কি সবাই হিযবুত তাহরীর করে? প্রশ্নই আসে না’।

বাংলাদেশের ক্যাম্পাসসমূহে এখন যে রাজনীতি চলে সেটা হলো শাসক সংগঠনের রাজনীতি। এই রাজনীতি যে বিপরীত মতকে গণতান্ত্রিক পরিসর ছাড়তে একেবারেই রাজি নয় সেটা সবাই জানে। ছাত্র রাজনীতির কতটা হিংসাত্মক হয়ে গেছে তার বিপজ্জনক উদাহরণ সব ক্যাম্পাসে আছে। এর বড় কারণ হলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন এবং কলেজসমূহের শিক্ষকরা শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধাচরণ না করার অভ্যাসটি মজ্জাগত করে ফেলেছেন।

কথায় কথায় অতীতের গৌরব টেনে আনা হয়। বলা হয় সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্র রাজনীতি বড় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এটা বলা হয় না যে, ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির কারণে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন আর কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। বলতে গেলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সব আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র রাজনীতি এখন কাঠগড়ায়। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তার ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছাত্র রাজনীতিবিমুখ করছে।

গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসগুলোয় একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতামূলক ও সুস্থ ধারায় না থাকায় বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিটা উঠছে। কারণটা পরিষ্কার, এখন ছাত্র রাজনীতির নামে যা হয় এক কথায় শিক্ষা স্বার্থ ও শিক্ষার্থীবিরোধী। ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সোচ্চার নয় ছাত্র সংগঠনগুলো। ছাত্র রাজনীতির নামে চলে হল বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি। নিপীড়ন, ছিনতাই এবং ধর্ষণের আভিযোগও কম নয়।

দলগুলোর লেজুরবৃত্তি আর চাঁদাবাজ তৈরির কারখানা হয়ে উঠেছে অনেক ছাত্র সংগঠন। দেশে যে একটা সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ নেই সেটার প্রভাবেই ছাত্রদের কাছ থেকে ছাত্র রাজনীতি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এখনকার ছাত্রছাত্রীরা অনেক বেশি সচেতন। তারা জানে কে কী করছে। প্রত্যেকটি দল ও নেতার আমলনামা সবার জানা। ছাত্র রাজনীতির নামে কমিশন খাওয়া, প্রশাসনের সহযোগিতায় নানারকম দুর্নীতির যে অভিযোগ ছাত্র সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে রয়েছে তারা এসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল।

বিভিন্ন ন্যায্য আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীরাই একত্রিত হয়েছে। তারা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করেছে, বিভিন্ন ক্যাম্পাসে যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন করেছে, উপাচার্যদের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধের আন্দোলন করেছে, সময় মতো ক্লাস পরীক্ষা দিতে চেয়ে আন্দোলন করেছে। কোনোটিতেই শাসক দলের ছাত্র সংগঠনকে তারা তাদের পাশে পায়নি। এটা এই আমলে যেমন সত্য, সত্য ছিল বিএনপির আমলেও।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ, প্রখ্যাত হোক বা অখ্যাত, নতুন বা পুরোনো, দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের সৃষ্টি করা বিশৃঙ্খলার খবর ইদানীং প্রায়শই শিরোনামে আসছে। ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনা বাড়়ছে, হিংসাত্মক হানাহানি চলছে, পড়ুয়ারা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, শিক্ষক-অধ্যাপকরাও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। তাই এখন এটা এক জাতীয় প্রশ্ন যে, এটা কোন ধরনের ছাত্র রাজনীতি? এই রাজনীতিতে ছাত্রদের কোন কল্যাণ হয়? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বা কোন উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারছে এই রাজনীতির মাধ্যমে?

দেশের শিক্ষাঙ্গনের এই পরিস্থিতি বহু চর্চিত একটি প্রশ্নকে আবার খুব বড় করে তুলে ধরছে— ছাত্র রাজনীতির কি আদৌ কোনো প্রয়োজন রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে? কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির নামে যা চলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আসলে তাণ্ডব, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতার নামান্তর। ছাত্র রাজনীতির এতখানি গুণগত অধঃপতন এ দেশে আগে কখনও দেখা যায়নি। অভূতপূর্ব নিম্নগামিতার সাধনা শুরু হয়েছে যেন।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/ফারুক/এমএস

দেশের শিক্ষাঙ্গনের এই পরিস্থিতি বহু চর্চিত একটি প্রশ্নকে আবার খুব বড় করে তুলে ধরছে— ছাত্র রাজনীতির কি আদৌ কোনো প্রয়োজন রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে? কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির নামে যা চলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আসলে তাণ্ডব, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতার নামান্তর। ছাত্র রাজনীতির এতখানি গুণগত অধঃপতন এ দেশে আগে কখনও দেখা যায়নি। অভূতপূর্ব নিম্নগামিতার সাধনা শুরু হয়েছে যেন।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।