বর্জনের খেলায় জামায়াত ও ভারতীয় পণ্য

মোস্তফা হোসেইন
মোস্তফা হোসেইন মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশিত: ০৯:৫৭ এএম, ২৩ মে ২০২৪

বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো আবারও রাজপথের আন্দোলনে নামতে চায়। সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির ক্রমানুগতিক ব্যর্থতা কর্মীদের মধ্যে যে হতাশা তৈরি হয়েছে, এই মুহূর্তে কর্মীদের ধরে রাখাটাই বিএনপির বড় লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য অর্জনে তাদের অভ্যন্তরীণ আলোচনার বাইরে জোটগত বৈঠকও চলছে কয়েকদিন ধরে। প্রকাশিত সংবাদ ও সংবাদ পর্যালোচনার নিরিখে বলা যায়,তারা জামায়াত ও ভারত বিরোধিতার কৌশল নিয়ে ভাবছেন।

এর মধ্যে কঠোর ভারত বিরোধিতার বিষয়টি আপাতত পাশে সরিয়ে রাখার নীতিতে একমত তারা। বাস্তবতা হচ্ছে-মাঝে মধ্যে ভারতপ্রেমী হওয়ার উদাহরণ থাকলেও বিএনপি বরাবরই ভারতকে তাদের রাজনৈতিক শত্রুপক্ষ হিসেবেই বিবেচনা করে। আর এই বিবেচনার ফল সম্পর্কে নেতাদের চিন্তার গভীরতা নিয়ে সবসময়ই আলোচনা হয়। তারা যে অন্ধভাবে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন, তা বাস্তবে কতটা সম্ভব সেই বিষয়টি কি তারা ভেবে দেখেছেন?

মাস দুই আগে, বিএনপি নেতা রুহুল কবীর রিজভী সাহেব তার গায়ের কাশ্মিরি শাল আগুনে পুড়িয়ে মনে করেছিলেন, সেই আগুনের তাপ বোধহয় কর্মীদের উত্তেজিত করবে। বাস্তবতা কিন্তু তেমনটা হয়নি। কারণ তিনি শাল পুড়িয়ে যে কর্মীদের উত্তেজিত করতে চেয়েছেন সেই কর্মীদের রান্নাঘরের পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, হলুদ, জিরার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো ভারতীয়।

জামায়াতকে এক ব্যানারে আনার চেষ্টা করে কি সেই শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব হবে? অন্যদিকে বিএনপির ভিতরে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ আছে, তারাও কি এই উদ্যোগকে খুশি মনে গ্রহণ করবে? জামায়াতকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার যে ফল হয়েছে, তাদের ব্যানারভুক্ত করলে কি আলাদা কিছু হতো? কিংবা এখনও কি সম্ভাবনা আছে?

অর্থনৈতিক কারণেই শুধু তাদের কোনো কর্মীই নয়, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষেও ভারতীয় সব পণ্য বর্জন করে চলা সম্ভব নয়। এমনকি যিনি শাল পুড়িয়ে ভারত বিরোধিতার জাল ফেলার চেষ্টা করেছিলেন,সেই নেতার রান্নাঘরেও ভারতীয় পণ্যের সমাহার। ভারতীয় পণ্য বর্জন করতে হলে যে নিজেরই খাদ্য বর্জন করতে হবে।

বর্জনের কালচার সবসময়ই শুভ হয় না। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে আসছে একের পর এক। তারা এই বর্জন দিয়ে কতটা অর্জন করেছে তা চোখের সামনে দৃশ্যমান। তবে নির্বাচন বর্জন আর ভারতীয় পণ্য বর্জনের মধ্যে ফারাক অনেক। নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন হয় না। রাজনৈতিক মাঠে তাদের অবস্থান সেটাই প্রমাণ করে। কিন্তু নিত্যপণ্য বর্জনের ডাক দেওয়াটা যেমন তেমন ব্যাপার নয়।

আসলে বর্জনের সঙ্গে নিজেদের সক্ষমতার বিষয়টি জড়িত। একটা উদাহরণ দিতে চাই। বছর ত্রিশেক আগের কথা বলি। তখনও আমাদের মেয়েরা শাড়িতেই অভ্যস্ত ছিল। সেই শাড়ির প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করতো ভারতীয় উৎপাদিত কাপড়। তখন সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোতে বাজারের ব্যাগে করে ভারতীয় শাড়ি ফেরি করে বিক্রি করা হতো। দেশি শাড়ির ঘাটতি পূরণ হতো সেসব শাড়িতে।

সেই ভারতীয় শাড়ি ঘোষণা দিয়ে বর্জন করতে হয়নি। আমাদের বাজারে এখন ভারতীয় শাড়ি নেই বললেই চলে। গ্রামে আর ভারতীয় শাড়ির ফেরিওয়ালা দেখা যায় না। এর কারণ-শাড়ি উৎপাদনে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। নিজেদের চাহিদা পূরণের সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে মূল্য এবং গুণগত মানও ভারতীয় শাড়ির তুলনায় ভালো। সাধারণ মানুষ সানন্দে বাংলাদেশের শাড়ি গ্রহণ করেছে। এরজন্য কোনো রাজনৈতিক স্লোগান প্রয়োজন হয়নি। কেউ কাশ্মিরি শালও পোড়ায়নি।

এখানেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রনোদিত এবং বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য। যারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন, তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়-আপনাদের শাসনামলে কি ভারতীয় পণ্য বর্জন করে বিকল্প ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন? কিংবা এখনও যে ডাক দিলেন বিকল্প পথের দিশা কি আপনারা দিতে পেরেছেন? অবস্থাটা এমন-আপনারা মুখে বর্জনের ডাক দিয়ে ঘরে গিয়ে ঠিকই ভারতীয় পণ্য ব্যবহার করছেন।

সুতরাং এমন অবাস্তব ডাকে কি অর্জন হয়েছে তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। সমালোচকরা বলে,ঈদের পর আন্দোলনের ডাকের মতোই ফ্লপ করেছে তাদের ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন। আর এখন বাধ্য হয়ে ঈদের পরে আন্দোলনের মতো এটাকেও মাটিচাপা দেওয়ার কৌশল গ্রহণ করছেন।

সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতকে সঙ্গী করার বিষয়টি নিয়ে বিএনপি দলের ভিতরে এবং শরিকদের সঙ্গেও কথা চলছে। নির্বাচন বিরোধী আন্দোলনকালে জামায়াত বিএনপির সঙ্গেই ছিল। শুধু ব্যানারটা ছিল ভিন্ন। ২০১৮’র নির্বাচনে জোটবদ্ধ নির্বাচন না করলেও জামায়াতকে ছাড় দিতে দ্বিধা করেনি। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির বন্ধুত্ব কোনো রাখঢাকের ব্যাপার নয়। বাকি আছে একই ব্যানারেই আনা।

শুধু রাজনীতি নয়, যে কোনো বিষয়েই আমাদের স্মরণ করতে হয় সেই প্রবাদের কথা-বল বল নিজের বাহুবল। রাজাকারদের একই ব্যানারের আওতায় এনেই কি সরকারবিরোধী আন্দোলনে সাফল্য আসবে? আন্দোলন করতে হলে সাংগঠনিক শক্তি ও নিয়ম শৃংখলা সবার আগে বিবেচ্য। বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো কত নড়বড়ে হয়েছে সেটাও দেখতে হবে। বছরের পর বছর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন হয় না। জাতীয় সম্মেলনও বন্ধ। কর্মীরা এখনও টিকে আছে শুধু আশায় আশায়। সেই আশার আলোও ক্রমাগত ক্ষয় হচ্ছে।

জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনও বর্জন করেছে বিএনপি। স্থানীয় কর্মীদের রাজনীতি করার সুযোগটিই গেছে বাতিল হয়ে। ফলে দলীয় অর্জনটা কি হয়েছে। দুই শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করার অর্জনই দেখা যায়। আর দেখা যায়-স্থানীয় পর্যায়ের কর্মীরা কোনো না কোনো চেয়ারম্যান প্রার্থীর হয়ে কাজ করছে। কারণ তাদের এলাকার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। এটা তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রয়োজনেই হয়। সেই প্রার্থীরা আবার অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। ফল দাঁড়ালো কি? নেতাকে বহিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অসংখ্য কর্মীকেও বাতিল করা হলো। সর্বশেষ সংবাদে দেখা গেছে অনেক বিএনপি নেতা এখন উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জন্য ভোট চাইছেন।

এই অবস্থায় জামায়াতকে এক ব্যানারে আনার চেষ্টা করে কি সেই শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব হবে? অন্যদিকে বিএনপির ভিতরে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ আছে, তারাও কি এই উদ্যোগকে খুশি মনে গ্রহণ করবে? জামায়াতকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার যে ফল হয়েছে, তাদের ব্যানারভুক্ত করলে কি আলাদা কিছু হতো? কিংবা এখনও কি সম্ভাবনা আছে? মানুষ জানে জামায়াতের ছাতার নিচে বিএনপির অবস্থান। মুখে নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বললেও তারা জামায়াতের মতো যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের দলটিকে বগলদাবা করে রেখেছে।

এখন দেখার বিষয় তারা কি নিজের ক্ষয় মেনে জামায়াতের ভরসায় আবার মাঠে নামতে যাচ্ছে কি না।

লেখক : সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।