কর্মচারীদের বলি, এটা স্বাধীন দেশ ব্রিটিশ কলোনি নয়

রিপন দে
রিপন দে রিপন দে
প্রকাশিত: ০২:৫৬ পিএম, ২৮ মার্চ ২০২০

‘সরকারি কর্মচারীদের বলি, মনে রেখো, এটা স্বাধীন দেশ। এটা ব্রিটিশের কলোনি নয়। পাকিস্তানের কলোনি নয়। যে লোককে দেখবে, তার চেহারাটা তোমার বাবার মতো, তোমার ভাইয়ের মতো। ওদের পরিশ্রমের পয়সায় তুমি মাইনে পাও। ওরাই সম্মান বেশি পাবে। কারণ, ওরা নিজেরা কামাই করে খায়।’

‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ঐ গরিব কৃষক। আপনার মাইনে দেয় ঐ গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমরা গাড়ি চড়ি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক। ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে।’

১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণে এভাবেই দেশের নাগরিকদের সম্মান দেয়ার কথা সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু যাদের মালিক বলেছিলেন এবং যাদের চাকর বলেছিলেন অথবা আমাদের সংবিধানে যাদের মালিক-চাকর বলা হয়েছে, তার কোনোটাই বাস্তব অবস্থানে নেই। ব্রিটিশদের শাসন থেকে মুক্ত হলেও দিন দিন আমাদের অবস্থা পড়ে যাচ্ছে গণ-আমলাতান্ত্রিক শাসনে। তারা যখন যা ইচ্ছে করছেন। আমরা কোথায় বসব, কখন বসব, কীভাবে চুল কাটব- এসব ঠিক করে দিচ্ছেন আমলারা। দেশের সংবিধান আমাদের স্বাধীনতা দিলেও তারা দিচ্ছেন না। এ নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে গত কয়েকমাসে। কিন্তু দিন দিন এই মাত্রা বেড়ে চলেছে। এখন ইচ্ছে করলে মধ্যরাতেও তারা ডাকাতের মতো মানুষকে তুলে নিতে পারেন। দেশের মালিক বাবার বয়সী মানুষকে রাস্তায় কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারছেন। সে দৃশ্য আবার বিকৃত চিন্তায় মোবাইলেও ধারণ করছেন।

দেশে বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ঘোষিত মুজিববর্ষ উদযাপন হচ্ছে। এর মধ্যে হানা দিয়েছে করোনাভাইরাস। এই মুজিববর্ষের সময়েই যশোরের মনিরামপুরে মাস্ক না পরায় গত শুক্রবার (২৭ মার্চ) বিকেলে তিন বৃদ্ধকে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান। তিনি কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখার ছবি মোবাইলেও ধারণ করেন। (জাগোনিউজ২৪)।

একজন বিসিএস পাশ কর্মকর্তা যখন তার বাবার বয়সী মানুষকে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন, আবার সেই ছবি ধারণ করেন- তাতে প্রমাণ হয় কতো তুচ্ছ করে তিনি সাধারণ মানুষকে দেখছেন। কতো অহমিকা তার মধ্যে ভর করেছে। তারা এতোটাই অন্ধ যে সংবিধানও মানছেন না।

কাউকে কান ধরে ওঠ-বস করানো সম্পূর্ণ বেআইনি, অসাংবিধানিক, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কান ধরে ওঠ-বস করানোর মতো অমর্যাদাকর দণ্ড প্রদান নিষিদ্ধ।

যশোরের এই ঘটনায় অনেক প্রশ্ন সামনে এসেছে। মাস্ক না পরা কি অপরাধ? সরকার কি মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছে?

করোনা পরিস্থিতিতে সারাদেশে মানুষকে ঘরে থাকার আহ্ববান জানানো হয়েছে এবং সেটা মানুষের প্রয়োজনে, মানুষের জীবন রক্ষার প্রয়োজনে। কিন্তু এই সুযোগে প্রশাসনের কিছু ব্যক্তি এতো উৎসাহী হয়েছেন যে, ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছেন- ‘আমরা ব্যটিংয়ে’। এর মানে কী? আমরা পেটাব? পেটাবেন কেন? মানুষকে ঘরে রাখার জন্য?

যদিও কিছু ক্ষেত্রে এই পিটুনিকেও কেউ কেউ সাপোর্ট দিয়েছে, কারণ কিছু মানুষকে ঘরে ঢোকানো যাচ্ছে না। তবে এই কিছু মানুষের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাদের ঘরে যাওয়ার জন্য পিটুনি তো দূরের কথা, মুখে বলারও নৈতিক জায়গায় নেই রাষ্ট্র। এমন অনেকেই আছেন যারা একদিন ঘরে থাকলে ৪-৫ সদস্যের সংসারে চুলো জ্বলে না। এই মানুষগুলো করোনা থেকে বাঁচতে ঘরে থাকলে না খেয়েই মরে যাবেন। করোনা সবাইকে ধরবে কি-না নিশ্চিত নয়, কিন্তু খাবারের অভাবে এই মানুষগুলো যে মারা যাবেন, তা তো নিশ্চিত। এই দিনমজুর মানুষগুলো যখন পেটের ক্ষুধায় পাগল হয়ে বাইরে বের হচ্ছেন, তাদের পিটুনি দেয়া হচ্ছে। যে মানুষটি পেটের ক্ষুধায় বের হলেন, রাষ্ট্র তাকে খাবার না দিয়ে লাঠিপেটা করছে কোন ক্ষমতাবলে? এটা কি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ?

প্রশ্ন আবারও আসে সামনে, সরকার কি লকডাউন ঘোষণা করেছে? কারফিউ বা ১৪৪ ধারা দিয়েছে? সবাইকে কি মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছে? তাহলে কেন যাকে-তাকে যেখানে-সেখানে মারা হচ্ছে? কেন কানে ধরিয়ে ওঠ-বস করানো হচ্ছে? আর কাঁচাবাজার, মুদি দোকান, ফার্মেসি, ব্যাংক, এটিএম বুথ খোলা রেখেছে কাদের জন্য? এমনকি গার্মেন্টসসহ অনেক শিল্প কারখানাই তো খোলা আছে। যদি মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক হয়েই থাকে, তাহলে মাস্কের জোগান কই? বাজারে মাস্ক কই? ১০ টাকার মাস্ক যখন ১০০ টাকায় বিক্রি হলো- আপনারা তখন কোথায় ছিলেন? করোনার বিস্তাররোধে প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য যে আড়াই মাস সময় পেলেন তখন আপনারা কী প্রস্তুতি নিলেন? যে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান মাস্ক না পরার জন্য বৃদ্ধকে কানে ধরালেন, তার এলাকায় যখন মাস্কের সংকট তৈরি হয় বা ১০ টাকার মাস্ক ১০০ টাকায় বিক্রি হয়, তখন তিনি কোথায় ছিলেন?

এই দিনমজুরদের আপনারা দিতে পেরেছেন খাদ্য নিরাপত্তা? সবাই যখন সব কিনে মজুদ করেছিল, তখন এদের জন্য আপনাদের কী বার্তা ছিল? এদের বলেছিলেন আগামীর জন্য জমা করেন?

উত্তর দেবেন- আপনারা অনেক কিছু দিচ্ছেন বা দেবার পরিকল্পনা নিচ্ছেন। আপনারা সব সময় এমন দাবি করেন। কিন্তু স্বজনপ্রীতি আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আপনারা তা আগেও পারেননি। এবারও পারছেন না। সোজা বাংলায়- ভাত দেবার মুরোদ নাই, কিল মারার গোঁসাই।

এমন একটি ঘটনা হয়তো আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এড়িয়ে যেতে পারি। কিন্তু এইতো কয়দিন আগে আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল। ঘুষের দাবিতে থানায় এনে চাহিদামত ঘুষ না পেয়ে শানু হালদার নামের একজনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে বরগুনার আমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল বাশারের বিরুদ্ধে।

দৈনিক দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদন মতে, শানু হালদারের ছেলে সাকিব হোসেন অভিযোগ করছেন, ‘ওসি টাকা না পেয়ে আমার বাবাকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন।’

শুধু সাধারণ মানুষ নন, রক্ষা পাচ্ছেন না পেশাদার সাংবাদিকরাও। গত ১৩ মার্চ মধ্যরাতে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগ্যানের বাড়িতে হানা দিয়ে দরজা ভেঙে জেলা প্রশাসনের ৪০ জন মিলে তাকে তুলে নিয়ে যায়। পরে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় তাকে। এই ঘটনার পেছনে ছিলেন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনসহ ৪ কর্মকর্তা। ঘটনাটি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। (বাংলা ট্রিবিউন)

এ কয়েকটি ঘটনা হয়তো সংবাদপত্রে বা প্রচারে আসার কারণে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু অবিচারের এমন বেশিরভাগ ঘটনা থেকে যাচ্ছে আড়ালে। ব্রিটিশরা চলে গেলেও অনেক আমলা যেন এখন অঘোষিত জমিদার। আমরা প্রজা। এরা ভুলে যান যে এই দেশের সাধারণ মানুষের রক্ত-ঘামের ট্যাক্সের টাকায় তারা লেখাপড়া করেন। তাদের সন্তানসহ মা-বাবার মুখে যে খাবার তুলে দেন, তাও এই দেশের মেহনতী মানুষের ট্যক্সের টাকায়। এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, কোনো সুলতানা পারভীন বা সাইয়েমা হাসান নন।

কিছুটা আশার কথা হলো, আলোচনায় আসে এমন প্রতিটি ঘটনার বিচার হচ্ছে, যদিও অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। শুধু প্রত্যাহারের মধ্যেই সব সীমাবদ্ধ। তবে এখন সময় এসেছে কঠোর দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়ার। সেই সাথে আমলাদের মনোজগতে বদলে দেয়ার। তারা যে চিন্তা-চেতনা লালন করছেন, তার থেকে বের হয়ে এলেই হয়তো তারা গণতান্ত্রিক দেশে জনগণ যে মালিক তা মাথায় রাখবেন।

বাঙালিকে কেউ কোনোদিন লাঠির ভয়ে দমিয়ে রাখতে পারেনি। না ব্রিটিশরা, না পাকিস্তানিরা, না জিয়াউর রহমান বা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদরা। বরং মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে আপনাদের পালাতে হবে।

দেশে বর্তমানে জরুরি অবস্থা না থাকলেও লকডাউন ঘোষণা না করলেও অঘোষিত লকডাউন অবস্থা চলছে। সেটা মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্যই। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে কঠোর হতে হচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে আড্ডাবাজ বা যারা অকারণে ঘুরে তাদের শাসানো যায় বা প্রয়োজনে কঠোর হতে পারেন। কিন্তু পেটানো যায় না। অথচ এমন কিছু মানুষকে পেটানো হচ্ছে যারা একদিন বাইরে বের না হলে তাদের পরিবারের সবার খাবার বন্ধ থাকবে। চুলায় আগুন জ্বলবে না। এরা দিনে আনে দিনে খায়। আপনারা এদের খাবারের নিশ্চয়তা দিতে পেরেছেন? যদি এদের খাবারের নিশ্চয়তা দিতে পারেন নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই মানুষগুলো বের হবে না। কারণ এই দেশে আইন খুব সহজে এই সাধারণ মানুষরাই মানে।

সভ্য সমাজে গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ে দেশের জগণকে রাস্তায় কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, যখন তখন লাঠিপেটা করা শুধু অপরাধ নয়, বর্বরতা। পুলিশের কিছু অতিউৎসাহী কর্মকর্তা ঘোষণা দিয়েই এই কাজ করছেন। এদের থামানোর দায়িত্ব পুলিশ বিভাগের। এদের কয়েকজনের জন্য সবার দুর্নাম হোক, একটা বাহিনীর দুর্নাম হোক নিশ্চয় আপনারা চান না।

প্রতিটি পেশার মানুষের একটা শিক্ষার মানদণ্ড আছে। কিন্তু বাংলাদেশের অনেকে কর্মকর্তার মধ্যেই তার প্রতিফলন নেই। যদিও এদের নিয়ে আহমদ শরীফ তার ‘শিক্ষা সংস্কৃতি প্রগতি’ বইয়ে বলে গেছেন, ‘আমাদের দেশে মানুষ লেখাপড়া করে শুধু পেশা পরিবর্তনের জন্য। অর্থাৎ আগে বাপ-দাদা কৃষিকাজ করতো, এখন ছেলে শিক্ষিত হয়ে একটা চাকরি করে। এর বাইরে শিক্ষার তাৎপর্য খুব কম।’ দ্বিতীয় কথা তিনি বলেছেন, ‘এ দেশে পাঠ্যপুস্তকে নৈতিক শিক্ষা চালু করেও লাভ হয় না। কারণ শিক্ষার্থীরা পাস করার জন্য কিংবা ভালো রেজাল্ট করার জন্যই শুধু নৈতিক শিক্ষা বইটা পড়বে। এর বাইরে না।’

দেশের মানুষের প্রতি, আইনের প্রতি বিসিএস ক্যাডার কর্তাদের অবজ্ঞা আহমদ শরীফের কথাগুলোকেই যেন প্রতিফলিত করছে।

লেখক: সাংবাদিক

এইচএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।