করোনার পর মানবজাতিকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে যেসব ভাইরাস

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:১১ পিএম, ০৯ এপ্রিল ২০২০

আবদুল্লাহ আল মামুন

নভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। তবে সুস্থও হচ্ছেন অনেকে। ভাইরাসটির প্রতিষেধক আবিষ্কারে কাজ করছে বিশ্বের বেশিরভাগ গবেষক। তবে চেষ্টা চালালেও এখনও বিজ্ঞানসম্মত কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি কেউ। এর মধ্যে কয়েকটির ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চলছে।

সংক্রামক ও মহামারি ভাইরাসের এমন আক্রমণ পৃথিবীতে এটিই প্রথম নয়। এর আগেও কয়েকবার মরণঘাতী ভাইরাসের সম্মুখীন হয়েছে পৃথিবী। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় পুরাতন ভাইরাসগুলোর প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে গবেষকরা। কিন্তু নতুন নতুন রোগের জন্য তাদেরকে সময় দিতে হবে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কার করলেও নতুন রোগব্যাধিতে সাময়িক অসফল হয়ে যায় বিজ্ঞান।

আমাদের সবার মানে একটা প্রশ্ন জাগতে পারে, করোনাভাইরাস ডিজিজ-২০১৯ সংক্ষেপে কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার হলে এবং এর প্রাদুর্ভাব কমলে মানুষ কি আবার নতুন কোনো ভাইরাসের সম্মুখীন হবে? এক কথায় উত্তর দিতে গেলে হয়তো আরও বড় বিপদের মুখে রয়েছে মানবজাতি।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, পৃথিবী নামক এই গ্রহে আদিকাল থেকে মানুষ, ব্যাকটেরিয়া ও বিভিন্ন ভাইরাস বেঁচে রয়েছে। ইউরোপের বুবোনিক প্লেগ থেকে শুরু করে গুটিবসন্ত রোগের জন্য গবেষকরা প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে। কিন্তু এইসব রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসগুলো প্রাণীদের মাঝে সংক্রমণ সৃষ্টির নতুন নতুন উপায় তৈরি করছে।

আলেকজেন্ডার ফ্লেমিং যখন পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন, এরপর থেকে আমাদের কাছে অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে। আর অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়াগুলো নতুনভাবে বিকশিত হয়ে সাড়া ফেলছে। অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যাকটেরিয়ার এই যুদ্ধ অনবরত চলছে। আমরা রোগজীবাণুগুলোর সঙ্গে এতটা সময় ব্যয় করি যে এগুলো নতুন রূপে ফের বিকশিত হয়।

হাজার হাজার বছর ধরে অনুপস্থিত থাকা বা আগে কখনও দেখা যায়নি এমন মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের সংস্পর্শে এলে আমাদের কী হবে? এর কোনো উত্তর এখনও আমাদের কাছে নেই। তবে হয়তো খুব শিগগিরই এর উত্তর আমরা পেতে যাচ্ছি।

জলবায়ু পরিবর্তনের কথা আমরা সবাই জানি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে লাখ লাখ বছর ধরে বরফ-জমাট অবস্থায় থাকা মাটি (পারমাফ্রস্ট সয়েল) গলতে শুরু করেছে। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রের পানির উচ্চতা। আর বরফের সর্বনিম্ন মাটির ওই স্তরটিতে সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক কালের ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া। বরফের নিচে ব্যাকটেরিয়া প্রায় মিলিয়ন বছর বেঁচে থাকতে পারে।

বরফের নিচে হাজার হাজার বছর ধরে সুপ্ত থাকা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে আমরা সেভাবে অবগত নই। বরফ গলে যাওয়ায় প্রাণ ফিরে পাচ্ছে এগুলো। আর এসব ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস আমাদের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর, তার প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। কার্যত সারাবিশ্ব আজ করোনায় বন্দি।

২০১৬ সালের আগস্টে সাইবেরিয়ান তুন্দ্রার প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইয়ামাল উপদ্বীপে ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে ১২ বছর বয়সী একটি শিশু মারা যায়। এছাড়া আক্রান্ত প্রায় ২০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

বিষয়টি নিয়ে গবেষকরা জানায়, ৭৫ বছর আগে বরফে আচ্ছাদিত ইয়ামাল উপদ্বীপে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত একটি হরিণ (রেইনডিয়ার) মারা যায়। আর এটি বরফের নিচে চাপা পড়ে। অধিক তাপমাত্রার কারণে বরফ গলে অ্যানথ্রাক্সের ব্যাকটেরিয়াগুলো বের হয়ে আসে ও পানি, মাটির সঙ্গে মিশে আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকেই ওই শিশুটি আক্রান্ত হয়ে যায় মারা যায়।

গবেষকরা জানায়, ওই অঞ্চলের প্রায় দুই হাজার হরিণ অ্যানথ্রাক্সে মারা গিয়েছিল। কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হয়েছিল এ ভাইরাসে।

উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে প্রতি গ্রীষ্মে প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার করে বরফ গলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গলতে গলতে বরফের সবচেয়ে নিম্নের স্তরে পৌঁছে গেছে।

আর্টিক সার্কেলের তাপমাত্রা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা বিশ্বের অন্যান্য স্থানের চেয়ে প্রায় তিনগুণ। আর তাপমাত্রায় আর্টিক সার্কেলের বরফ খুব দ্রুত গলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বরফে সুপ্ত অবস্থায় থাকা সংক্রামক জীবাণুগুলো দ্রুত বের হয়ে আসতে পারে।

এ বিষয়ে ফ্রান্সের আইক্স-মার্সেইল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজির অধ্যাপক জ্যান-মিশেল ক্লাভারি বলেন, ‘পারমাফ্রস্ট সয়েল হলো ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার জন্য একটি ভালো সংরক্ষাণাগার। সেখানে নেই কোনো অক্সিজেন। শুধু রয়েছে প্রচণ্ড শীত ও অন্ধকার। পারমাফ্রস্ট স্তরে সুপ্ত থাকা অনেক প্যাথোজেনিক ভাইরাস প্রাণীদের সংক্রমিত করতে পারে। এছাড়া সেখানে এমন কিছু রয়েছে যা অতীতে বিশ্বব্যাপী মহামারি সৃষ্টি করেছিল।’

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ এবং প্রাণীর মরদেহ পারমাফ্রস্ট সয়েলে (মাটি) সমাহিত করা হয়েছে। সুতরাং এটি অনুমেয় যে বরফ গলে অন্যান্য সংক্রামক জীবাণু মুক্ত হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা যাওয়াদের গণকবর দেয়া হয় আলাস্কার তুন্দ্রা অঞ্চলে। বিজ্ঞানীরা ওইসব গণকবর থেকে আরএনএ’র (RNA) কিছু নমুনা সংগ্রহ করে। নমুনাগুলোতে ভাইরাসটি পাওয়া যায়। এমনকি গুটিবসন্ত ও ইউরোপের বুবোনিক প্লেগের আক্রান্ত রোগীদের সাইবেরিয়ায় সমাহিত করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

২০১১ সালের রাশিয়ার গবেষক বরিস রেভিচ ও ম্যারিনা পোডোলিয়ানার এক গবেষণা থেকে জানা যায়, পারমাফ্রস্ট সয়েল স্তরের বরফ গলার ফলে মারাত্মক সংক্রমণ ভেক্টররা ফিরে আসতে পারে। এমনকি যেসব জায়গায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমাহিত করা হয়েছে, সেসব স্থানেই এসবের প্রাদুর্ভাব প্রথমে থাকবে।

২০০৫ সালে নাসার গবেষকরা আলাস্কার বরফ আচ্ছাদিত একটি অঞ্চলে ৩২ হাজার বছরের পুরোনো ব্যাকটেরিয়া সফলভাবে পুনরুদ্ধার করেন। যেগুলো সুপ্ত অবস্থায় ছিল। এই ব্যাকটেরিয়াটি কার্নোব্যাক্টেরিয়াম প্লিস্টোসেনিয়াম নামে পরিচিত। যা প্লাইস্টোসিন যুগ থেকে সুপ্ত রয়েছে। বরফ গলার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো পানির সঙ্গে মিশে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে বলে ধারণা গবেষকদের।

এর দুই বছর বাদেই অ্যান্টার্কটিকার বেকন এবং মুলিনস উপত্যকায় একটি হিমবাহের পৃষ্ঠের নিচ থেকে আট মিলিয়ন বছরের পুরোনো ব্যাকটেরিয়া পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় বিজ্ঞানীরা। গবেষকরা জানায়, এগুলো এক লাখ বছরের পুরোনো ব্যাকটেরিয়া।

তবে সমস্ত ব্যাকটেরিয়া পারমাফ্রস্ট সয়েল থেকে ফিরে আসতে পারবে না। শুধুমাত্র এমন সব ব্যাকটেরিয়া যেগুলো নতুন করে বীজ গঠন করতে সক্ষম, শুধুমাত্র সেসব ব্যাক্টেরিয়া ফিরে আসতে পারে।

২০১৪ সালে রাশিয়ার বিজ্ঞানী ক্যালভেরিয়ের নেতৃত্বাধীন একটি দল সাইবেরিয়ান তুন্দ্রা অঞ্চলের ১০০ ফুট গভীর থেকে দুটি ভাইরাস পুনরুদ্ধার করে। যা ছিল ৩০ হাজার বছরের পুরোনো। এই দুটি এত বড় ছিল যে তা সাধারণ মাইক্রোস্কোপে দেখা গিয়েছিল। গবেষকরা ভাইরাস দুটিকে প্রাণঘাতী ও দৈত্য ভাইরাস হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।

ভাইরাস দুটি পুনরুদ্ধার করা হলে খুব দ্রুত এগুলো সংক্রামক হয়ে উঠবে। তবে মানবজাতির সৌভাগ্য এই বিশেষ ভাইরাসগুলো কেবল এককোষী অ্যামিবাকে সংক্রমিত করে।

ক্যালভেরিয়ের নেতৃত্বাধীন দল গবেষণার পর জানায়, অন্যান্য ভাইরাসও একইভাবে মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে। ক্যালভেরিয়ের জানান, আর্টিক অঞ্চলের শুধুমাত্র পারমাফ্রস্ট স্তরগুলো গলা বাকি রয়েছে। এই অঞ্চলে খনির কাজে খনন যে হারে করা হচ্ছে, তাতে এই প্রাচীন স্তরটি খুব দ্রুত উন্মোচিত হতে পারে। যদি তা হয়, তাহলে এটি মানবজাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।

২০১৪ সাল থেকে ক্যালভেরিয়ের পারমাফ্রস্ট স্তরগুলোর ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ বিশ্লেষণ করছেন। যা মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে। তিনি এমন অনেক প্রমাণ পেয়েছেন, যা মানুষের জন্য বিপজ্জনক। ক্যালভেরিয়ের দলটি কয়েকটি ডিএনএ সিকোয়েন্সও পেয়েছেন, যেগুলো হার্পিস ভাইরাস থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়।

গবেষকরা আরও বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের সন্ধান পেয়েছে ও আরও অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। উষ্ণতার ফলে মরণঘাতী এসব ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ফিরে এসে মানবজাতিকে হুমকির মধ্যে ফেলবে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা। এমনকি শুধুমাত্র পারমাফ্রস্ট স্তর নয় অন্যান্য স্থান থেকেও জীবাণু উত্থিত হতে পারে বলে ধারণা তাদের।

লেখক : সাংবাদিক

এইচআর/বিএ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।